নক্ষত্রের রাত ও আমার বোন
এই লেখাটি ইতিমধ্যে 1332বার পড়া হয়েছে।
অনেকদিন পর যেন আমি আবার আমার শৈশবে ফিরে এলাম। হঠাৎ করেই এস.এস.সির সার্টিফিকেট প্রয়োজন হয়ে পড়লে, আমি তা স্কুল থেকে তুলতে আসি।
ইস! কী মজার স্কুল।
সার্টিফিকেট তুলতে এসে দেখি আমার মনের নিংড়ানো সেই সুন্দর স্কুলটি আর নেই। একসময় সেখানে ছিল লম্বা টিনের ঘর, অ্যাসেম্বিলিতে দাঁড়িয়ে সবাই একসঙ্গে গাইতাম, “আমার সোনার বাংলা ….।” আজ সেখানে বিশাল তিনতলা বিল্ডিং। স্কুলের এরিয়াও অনেক বেড়েছে। সার্টিফিকেট তুলতে এসে দেখি, আমার সময়ের সেই স্যার-আপারা কেউ নেই। আছে শুধু এক বুড়ো দপ্তরি। তারও চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে।
কাজ শেষ করে যখন বেরিয়ে আসছি, তখন কেউ একজন ডেকে উঠল, “রবিন……” গলার স্বরটা মনে হলো বহুদিনের পরিচিত। আমি থমকে দাঁড়ালাম। দেখি অনেক ছেলে-মেয়ে। এদের মধ্যেই হয়তো কেউ কাউকে ডেকেছে।
কিন্তু হুবহু সেই একই কন্ঠ।
আমি ফিরে গেলাম আজ থেকে বিশ বছর পূর্বে। তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি।
আমাদের কোয়ার্টারে নতুন এক ফ্যামিলি এসেছে। তাদের সাথে থাকে অপূর্ব এক মেয়ে। প্রথম প্রথম তাকে শুধু আমি দূর থেকেই দেখতাম। একদিন বিকেলে সে এবং তার মা আমাদের বাসায় বেড়াতে আসে।
তখন জানতে পারি বাবার বদলির কারনে ঐ মেয়ে ট্রান্সফার হয়ে আমাদের স্কুলে চলে এসেছে। সামনের জানুয়ারীতেই সে স্কুলে যাবে।
মেয়েটি আমাকে বলল, ‘তোমার নাম কি?’
-রবিন, তোমার নাম কি?
-মৌমিতা। কোন ক্লাসে পড়?
-এইটে (জানুয়ারীতে আমি এইটে উঠব তাই অগ্রীম বলেছিলাম), তুমি?
-টেনে।
-তাহলে তো তুমি আমার চেয়ে বড়।
-হু, অসুবিধা নেই। আমাকে তুমি করেই বলবে। আমি তোমার বন্ধু।
এরপর থেকে আমরা একসঙ্গে স্কুলে যেতাম। ফিরতামও একই সঙ্গে। তখন আমাদের কোর্য়াটার আর স্কুলে প্রচুর গাঁদা ফুল গাছ লাগানো হতো। চারিদিকে শুধু হলুদ ফুল ফুটত।
জানুয়ারি মাস। তাই পড়াশুনার চাপও অনেক কম। একদিন আমরা স্কুল ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে অনেক দূরে বিলে শীতের পাখি দেখতে গিয়েছিলাম। মৌমি বলত, ‘জানিস এই পাখি গুলো শীতের দেশ থেকে আসে।’
আমি বলতাম, ‘যাহ! এখানেইতো কত শীত।’ আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতাম না।
মৌমি বিলের মাঝে ঢিল মারত। তাতে কিছু পাখি উড়ে দূরে চলে যেত। ও বলত, প্রতিটি মানুষের ভিতরে একটি পাখি লুকিয়ে থাকে। সে উড়ে যেতে চায়। ভাবে কোথাও আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা।
একবার অনেক রাত পর্যন্ত ব্যাডমিন্টন খেলেছিলাম। মৌমির সঙ্গে আমি কখনই পারতাম না। কর্কের বাজিতে খেলা হতো। আমি প্রতিবার কর্ক খুইয়ে ফেলতাম।
একদিন খেলা শেষ করে ওকে যখন কর্ক দিলাম তখন বলেছিলো, ‘তুই আমার ভাই হবি। তাহলে সব কর্ক তোকে আমি দিয়ে দেব।’ বলেই কেঁদেছিলো। পরে জেনেছিলাম, মৌমির বড় ভাইকে সন্ত্রাসীরা মেরে ফেলেছিলো। ওর বাবা মেয়ের জন্য ভয়ে ঐ এলাকা ছেড়ে চলে আসেন।
একবার কেরাম খেলা নিয়ে ওর সঙ্গে প্রচন্ড ঝগড়া বাঁধে। আমি রাগে বলেছিলাম, ‘আমি তোর ভাই না, তুইও আর আমার বোন না।’ আমি কখনই ওর সঙ্গে তুই তোকারি করতাম না। রাগ হয়েছিলো বলে করেছিলাম।
মৌমি খুব ভালো ছাত্রী ছিল। বোর্ডে মেয়েদের মধ্যে তৃতীয় হলে ওর বাসায় অনেক মানুষের ভীড় হয়েছিলো। আমার পরিষ্কার খেয়াল আছে, রেজাল্টের দিন রেজাল্ট আনতে আমরা দুজন সকাল থেকে স্কুলের চত্ত্বরে বসেছিলাম। দু’টার দিকে হেডস্যার বারান্দায় এসে মৌমিকে ডাক দিলেন। জানলাম মৌমির অসাধারণ রেজাল্টের কথা। আমি খুশীতে চিৎকার করে উঠলাম। তারপর দু’জন দৌড়ে গেটের কাছে যাই। সেখানে একটি বট গাছের নীচে একলোক বাক্স করে আইসক্রিম বিক্রি করছিল। আমার কাছে কোন টাকা ছিলনা। মৌমির কাছে শুধুমাত্র আটআনা ছিল। সেটা দিয়েই একটি আইসক্রিম কিনে দুইজন ভাগ করে খাই। মৌমি দুই কামড় দিয়ে আমাকে দেয়। আমি কয়েক কামড় দিয়ে লাল আইসক্রিমটা ওর দিকে ছুঁড়ে দেই। ও তখন বটগাছের ঝুলে পড়া ডাল ভেঙ্গে আমার দিকে তেড়ে এল। এই বট গাছটা এখনও আছে।
বাসায় এসে দেখি অনেক মানুষ। পত্রিকা থেকেও লোক এসেছে। ওদের বাসায় এর পরেও অনেক মানুষ এসেছিল, যখন মৌমি চোখ বন্ধ করে অন্যজগতে চলে গিয়েছিলো।
এইচ.এস.সি পড়ার সময় ওর ব্রেন টিউমার ধরা পড়ে। ওর বাবার অত সামর্থ্য ছিল না যে তাকে দেশের বাইরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাবে। মৌমি খুব শক্ত মেয়ে ছিল।
মাথা ব্যাথা নিয়েও সে অনেক রাত পর্যন্ত ব্যাডমিন্টন খেলতে পারত। একবার খেলতে খেলতে সে ঘাসের উপর শুয়ে পড়েছিলো। আমি ভাবলাম ও হয়তো অজ্ঞান হয়ে গেছে। কাছে গেলে বলে উঠল, ‘তুই আমার পাশে শুয়ে ঐ আকাশের দিকে তাক।’ তখন আকাশে শীতের হালকা কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে। তার মাঝেও অনেক তারা ঝলমল করত। মৌমি বলত, ‘রাতে যখন নক্ষত্রের নীল আলো পৃথিবীতে নেমে আসে তখন রাতজাগা পাখি কর্কশ করে ডেকে দূর আকাশে মিলিয়ে যাবে।হয়তো কোন একদিন আমিই হব সেই তারা।’
আমি কেঁদে ফেলেছিলাম।
মৌমি ধমক দিয়ে বলত, ‘এই কাঁদবি না।’ তারপর আমার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলেছিলো, ‘অনেক রাতে যদি কখনও ঘুম ভেঙ্গে যায়, তখন জানালার ধারে দাঁড়িয়ে রূপালী চাঁদ দেখবি। ভাববি অন্য পৃথিবী থেকে আমিও এ সময় চাঁদ দেখছি। আমরা দুজন একসঙ্গে চাঁদ দেখব। আর যদি তোর জানালা দিয়ে চাঁদ না দেখা যায় তাহলে আকাশে নিশ্চয়ই অনেক তারা দেখতে পাবি। মনে করবি অনেক তারার ভীড়ে আমিও এক তারা হয়ে দূর আকাশে মিশে আছি। আর তোকে দেখছি। দেখবি তোর মন ভালো হয়ে যাবে।’
তখন হঠাৎ করেই হু হু করে শীতের ঠান্ডা বাতাস বয়ে গিয়েছিল।
আজও আমি শীতের রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে জানালার পাশে এসে দাঁড়াই। আকাশে অনেক তারা ঝিলমিল করে। জানি মানুষ মরে কখনও তারা হয় না। তবুও আমার ভাবতে ইচ্ছে করে অনেক তারার ভীড়ে মৌমিও সেখানে আছে। সে নীল আলো পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেয়। সেই মায়াবী আলোতে হঠাৎ হঠাৎ কোন রাত জাগা পাখি ডেকে দূর আকাশে মিলিয়ে যায়। আর আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে মৌমিকে দেখি, ঠিক যে রকম করে ও আমাকে দেখে।
মাঝে মাঝে মনে হয় দূর আকাশ থেকে মৌমি ফিসফিস করে বলছে, ‘আমার ভাই হবি, ভাই।’
নিজের অজান্তেই আমার বুকটা দুমড়ে মুচড়ে ওঠে।
১,৪৯৩ বার পড়া হয়েছে
darun
ইংরেজী ?
সক্ষত্রের মত সবার মত যেন আলোকিত হয়….
আপনাকেও শুভ কামনা।
আপনার স্মৃতিচারণটি দারুন একটি গল্পে রূপ নিয়েছে।
আপনার স্মৃতিটি আমার কাছে খুব ভাল লাগল।
The memory is sad
ভাল লাগা জানিয়ে গেলাম ।
অসাধারন এক স্মৃতিচারনের গল্প পড়লাম আনোয়ার ভাই।এটা পেলাম শেষের দিকের পেজে।এখন আপনি আর এরকম গল্প লিখেন না কেন?
অনেক ভাল লাগা আপনার স্মৃতিচারণ গল্পে।
চিন্তা করলাম ব্লগের প্রথম লিখা পড়ে আসি। ভাল লাগল
অনেক সুন্দর।।
মুহাম্মদ আনোয়ারুল হক খান, গল্পের পাশাপাশি আপনার পরিচয় পেলাম, বিশেষ ব্যক্তিত্বঃ নবিজী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, আমারও তাই , খুব ভাল লাগল।
পুরনো লেখা পড়তে এলাম, আপনার স্মৃতিচারন মুলক লেখাটি দারুন একটি গল্পে রূপ নিয়েছে।
লিখা ইজ ফাইন …….দারুণ মুগ্ধ হলাম পড়ে