পরিধিতে প্রতিবিম্ব
এই লেখাটি ইতিমধ্যে 1127বার পড়া হয়েছে।
‘আমি তোমাকে নিশ্চিত করছি, এবারের মিশনের উপরই তোমার কমিশন নির্ভর করবে।’ মহামান্য কিরিজা মেপে মেপে কথা বলছিলেন। ‘প্রতিটি মানুষকেই তার জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে মানবিক আবেগকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে কর্তব্যকেই বেছে নিতে হয়।’ অত্যন্ত ধীরগতিতে মহামান্য কিরিজা মানুষের কর্তব্যের প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্ব সহকারে য়োমাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন। সবশেষে তিনি বললেন ‘আশা করি তুমি তোমার মিশন ভালোভাবেই শেষ করতে পারবে।’ তিনি অত্যন্ত শীতল দৃষ্টিতে য়োমার দিকে তাকিয়ে কথা শেষ করলেন।
গ্রানাইটের আসন ছেড়ে দিয়ে য়োমা উঠে দাঁড়াল। ‘আমার অর্ধযুগের কর্মজীবনের ইতিহাসে ব্যর্থতার নজির নেই মহামান্য কিরিজা।’ বলেই অত্যন্ত প্রাচীন ভঙ্গীতে দ্রুততার সাথে হাত তার কপাল পর্যন্ত উঠিয়ে বলল, ‘আইনত ওদের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই।’ তারপর ক্ষীপ্রতার সাথে উল্টোদিকে ঘুড়ে সামনের লম্বা কড়িডোরের পথ ধরে এগিয়ে যেতে লাগল।
য়োমা তার ক্ষুদ্র কর্মজীবনে বহু মিশন সফলভাবে শেষ করেছে। আন্তঃনক্ষত্রীয় মহাকাশযানের দলপতি হতে শুরু করে রসায়ন শাস্ত্রের বড় বড় দুটি আকিস্কার, পদার্থবিজ্ঞানের যুগান্তকারী আবিস্কার কুরু ইঞ্জিন আর গনিত শাস্ত্রেও য়োমা সমীকরণ তৈরী করে সে মানুষের ইতিহাস নতুন করে লিখতে বাধ্য করেছে। তবুও এবারের মিশনটির ব্যাপারে মহামান্য কিরিজা য়োমার উপর পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারছেন না।
য়োমা এরই মধ্যে দরজার কাছে এসে পড়েছে। তার চোখ জ্বল জ্বল করছে। এ দিনটির জন্য সে প্রতিটি মূহুর্ত হিসেব করে খরচ করেছে। কখনও কোন ভুল করেনি। মহামান্য কিরিজিা তার বয়বৃদ্ধ দৃষ্টিতে য়োমার চলার পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি যদি য়োমার চোখ দেখতে পেতেন তাহলে সাফল্যের ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত হতে পারতেন। কারন য়োমা নামের অপূর্ব সুন্দরী এই মেয়েটির চোখে মুখে এখন কোন ভালবাসার আভাই নেই, সেখানে শুধুই ভয়ংকর নিষ্ঠুরতা!
২
শহরতলীর এ জায়গাটি বেশ নীরব। সবেমাত্র সন্ধ্যে নেমেছে। য়োমা লম্বা হাইওয়ের উপর দাঁড়িয়ে দূরে একটি বাড়ি দেখছে। আর মাত্র কয়েকঘন্টার মধ্যে সে তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন কাজটির সুন্দর পরিসমাপ্তির সঠিক পরিকল্পনা করে ফেলেছে।
‘তাহলে রওনা হওয়া যাক।’ য়োমা নিজেকে বলল। ধীরপায়ে দূরে আবছা হয়ে যাওয়া একটি বাড়ি দেখা যাচ্ছে। সেখানে বাস করে এমন একজন, যে একসময় য়োমাকে প্রচন্ড ভালবাসত, যাকে মেরে ফেলতে পারার উপর য়োমার কমিশন প্রাপ্তি নির্ভর করছে।
দরজার সামতে দাঁড়াতেই দরজা খুলে গেল। য়োমা বিচক্ষণতার সাথে চারদিকে খেয়াল রেখে ভিতরে পা দিল। ভিতরে একজন মানুষ প্রাচীন চতুস্পদ প্রাণী নিয়ে খেলা করছে। ‘ইরিতাশ।’ য়োমা ডাক দিল।
ইরিতাশ হাঁটুগেড়ে বসে খেলছিল। ডাক শুনেই তাকাল এবং জীবনের সবচেয়ে বড় অবাক হল। তার হাত থেকে ছাড়া পেয়ে চতুষ্পদ প্রাণীটি য়োমার পায়ের কাছে মুখ ঘষতে লাগল। য়োমাও হাঁটুগেড়ে বসে প্রাণীটির পিঠের লোমশ শরীরের উপর হাত বুলিয়ে বলল ‘কি ব্যাপার, অবাক হচ্ছ?’
‘আমি ভুল দেখছি নাতো?’ ইরিতাশ সত্যিই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। ‘অবশ্যই না।’
তারপর বেশ খানিকটা সময় কেউ কারও সঙ্গে কথা বলতে পারেনি। পরিবেশ হালকা হলে য়োমা বলল, ‘জানো আমি তোমাকে কত খুঁজেছি, ইন্টার গ্যালাকটিক ওয়েব নিউজে কতবার তোমাকে আহবান করেছি, কিন্তু পাইনি। কী হয়েছিল তোমার?’ য়োমা মিথ্যে আবেগ মিলিয়ে তার মিশনের প্রাথমিক পর্ব শুরু করল।
‘তুমি ঠিক বলছ? সত্যি তুমি আজও আমাকে মনে রেখেছ?’
‘হ্যাঁ ইরিতাশ সত্যি!’ স্থির গলায় য়োমা মিথ্যা কথা বলতে শুরু করল।
এরই মধ্যে ইরিতাশ উঠে য়োমার কাছে চলে এল। দুচোখ ভরে সে তার য়োমাকে দেখতে লাগল, খুঁজতে লাগল হারানো ভালবাসা।
‘তুমি খবর দিয়েছিলে আমার সাথে সরাসরি কথা বলবে বলনি কেন? আর কেনই বা তুমি সেদিন আসনি? আমি তোমার জন্য কত সময় ধরে অপেক্ষা করেছিলাম, জানো?’ য়োমা তার চোখেমুখে পরিস্কার ভালবাসার সুর ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করল, যুদিও তার কোন প্রয়োজন ছিল না।
‘ভয়ে, সন্দেহে। যদি তুমি আমাকে ফিরিয়ে দাও।’ ইরিতাশ সত্যি কথাটিই বলল।
য়োমা তার আশ্চর্য নরম কোমল হাত ইরিতাশের দিকে বাড়িয়ে দিল। ইরিতাশ গভীর আগ্রহ নিয়ে য়োমার হাতদুটি চেপে ধরল। তার হাত কাঁপছে, মনে হচ্ছে কিছুক্ষনের মধ্যেই অবশ হয়ে যাবে। বহুদিন আগেও এই মেয়েটিকে দেখলে তার একই রকম অনুভূতি হতো। তার বুকের গভীরে একটি সুতীব্র অনুভূতির শুধুমাত্র একজনের জন্যেই রয়েছে। যে অনুভূতির জন্য মানুষ বেঁচে থাকে, হয়তো অপেক্ষাও করে। কেউ জানতে পাওে, কেউ হয়তো পারে না। তুবও কি ভালবাসা থেমে থাকে?
‘তোমার বাড়িতে এই যে চতুস্পদ প্রাণী, কোথায় পেয়েছ?’ একটি উত্তেজক পানীয় পান করার পর য়োমা ইরিতাশের সাথে কথা বলছিল। এ বাড়িতে সে পা দিয়েছে প্রায় দু’ঘন্টা হলে।
‘কোথা থেকে আবার? আমি নিজে তৈরী করেছি।’
‘তৈরী করেছ কীভাবে?’
‘কেন? জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে।’
‘কিন্তু আমি তো জানি তুমি একজন পদার্থবিদ। পদার্থবিদ্যার সুনীতি সূত্রের ব্যবহারিক প্রমাণ তোমার নিজেরেই করা। য়োমা ইরিতাশের কাজের ধরণ বুঝতে পারল না।
‘এত কথা না বলে তুমিতো শুরুতেই আমাকে মেরে ফেলতে পারতে?’ চমকে উঠল য়োমা। ভাল করে তাকিয়ে দেখল ইরিতাশের হাতে একটি লেজার গান।
‘তুমি, তুমি… কি করে বুঝলে?’ য়োমা থতমত খেয়ে গেল।
‘এইমাত্র আমি বুঝতে পারলাম তুমি মিথ্যে বলছ।’ তারপর হিংস্র দৃষ্টিতে য়োমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মিথ্যেবাদী, আমি ইচ্ছে করলে এখনই তোমাকে শেষ করে দিতে পারি কিন্তু করব না কারণ আমি তোমাকে আজও ভালবাসি। খবরদার লেজার গান বের করার চেষ্টা করলে আমি তোমাকে জলন্ত অঙ্গারে বদলে দেব।’ তারপর ধীরপায়ে উঠে হাত ইশারা করে য়োমাকে বের হয়ে যেতে নির্দেশ দিল। যতক্ষন পর্যন্ত য়োমার ছায়া দেখা যাচ্ছিল ঠিক ততক্ষন পর্যন্ত সে য়োমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর হাঁটুগেড়ে প্রার্থনার ভঙ্গিতে অনেকক্ষণ বসে রইল। হঠাৎ এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল। তাঁকে অবশ্যই প্রমাণগুলো নষ্ট করে পালিয়ে যেতে হবে। পালাবার জায়গাও ইতিমধ্যে ভেবে রেখেছে, যেখানে অন্য ইরতাশরা থাকে।
দৌড়ে সে তার ল্যাবে চলে গেল। দরজায় হাত দেবার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত সে জানত না ভিতরে অপূর্ব সুন্দরী এক মেয়ে অতি যতেœ লেজার গান তাক করে রেখেছে শুধুমাত্র ইরিতাশের জন্য!
‘আমি জানতাম তুমি পালাবে। আর শেষ মূহুর্তে সব প্রমাণ নষ্ট করবে। তাই প্রথম থেকেই এখানে অপেক্ষা করছি।’ নিষ্ঠুর চোখে শীতল গলায় য়োমা কথা বলতে শুরু করল।
‘তুমি এখানে কী করে এলে?’
‘আমি প্রথম থেকেই এখানে, এতক্ষন পর্যন্ত তুমি আমার ত্রিমাত্রিক অবয়বের সাথে কথা বলেছ।’
‘কিন্তু একা আমাকে মেরে তোমাদের কী লাভ?’ ইরিতাশ বাঁচতে চাইল। ‘ধীরে ধীরে তোমাদের সবাইকেই মেরে ফেলব। তোমাদের কারওই বাঁচার অধিকার নেই।’
‘কেন?’
‘কারণ তোমাদের জন্ম মানুষের সত্যিকারের ভালবাসার মাধ্যমে হয়নি। তোমাদের জন্ম হয়েছে ল্যাবরেটরীতে।’
‘তবুওতো আমরা মানুষ। ফিরে পেলে আমরাও খাবার খাই, পরিণত বয়সে আমাদের বুকেও ভালবাসার বীজ ফুটে।’
‘কিন্তু তোমরা ক্লোন।’
‘ক্লোন মানুষ।’ ইরিতাশ প্রতিবাদ করল।
‘না, শুধুই ক্লোন।’
‘তুমি আমাকে মারতে পার কিন্তু আমাদের প্রজন্মকে কখনই থামাতে পারবে না। পৃথিবীর আনাচে কানাচে সর্বত্রই বিরাজ করছে হাজার হাজার ক্লোন মানুষ। তারা একদিন ঠিকই তাদের অধিকার বুঝে নিবে।’
‘তা হবার নয়, কখনই হবে না।’
‘আমি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী উইলমুট এর ক্লোন। আরও সতেরজন উইলমুট এ মূহুর্তে পৃথিবীতে হাজার হাজার ক্লোন তৈরী করছে।’
কথা শেষ হবার আগেই য়োমার হাত থেকে একটি তীব্র আলো ছুটো গেল ইরিতাশের দিকে। ইরিতাশের ছিন্ন ভিন্ন দেহ ছিটকে পড়ল ল্যারেটরীর এক কোনায়। য়োমার চোখে মুখে এক পরিতৃপ্তির আভা।
শেষকথা
য়োমা তার রেশমী চুল ভালভাবে সাজিয়ে নিল। গোলাপী রঙের পোশাকে তাকে আরও মায়াময় মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে স্বর্গের কোন এক দেবী এ মূহুর্তে পৃথিবীতে নেমে এসেছে। শেষবারের মতো সে তাকে আয়নায় দেখে নিল যদি সে ভালোভাবে নিজেকে খেয়াল করত তবে সে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী মাদাম কুরীর সাথে বেশকিছু মিল খুঁজে পেত। কিন্তু ঘুনাক্ষরেও য়োমা তা ভাবতে পারেনি।
তারপর দ্রুত হাঁটা দিল সামনের বিশাল হলঘরের দিকে যেখানে মহামান্য কিরিজা তাকে কমিশন দেওয়ার জন্য গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন।
সে জানত না আজ রাতেই কোন এক ইরিতাশের কমিশন প্রাপ্তির নির্ভর করবে শুধু য়োমার জন্য।
১,১৯১ বার পড়া হয়েছে
Fine, tobe Aro Choto hole valo hoto na!
Thanks.
কারন য়োমা নামের অপূর্ব সুন্দরী এই মেয়েটির চোখে মুখে এখন কোন ভালবাসার আভাই নেই, সেখানে শুধুই ভয়ংকর নিষ্ঠুরতা!
আনোয়ার ভাই আমি তো মনে করি আপনি সফট একজন মানুষ।য়োমাকে কেন তার ভালবাসার খুনী বানালেন তারপরে শুধু কমিশনের জন্য বিখ্যাত হওয়ার জন্য।বাস্তবে য়োমারা নিজেকে ধ্বংস করে ফেলবে বিখ্যাত হওয়ার জন্য কার ও প্রান নিশ্চয় নিবেনা।তারপর ও গল্প গল্পই ।
আপনার সায়ন্স এর সাথে সব মিশেল আছে দেখছি রোমাঞ্চ হরর থ্রিলার ফিকশন।আপনি এই চার ক্যাটাগরি সব ভাল লিখতে পারবেন।
চমৎকার গল্প।লিখতে থাকেন আমরা পড়তে থাকব রোমাঞ্চের ভান্ডার আরও সমৃদ্ধ হবে।অসংখ্য ধন্যবাদ অসস্ভব সুন্দর গল্পটি লেখার জন্য।শুভকামনা রইল সবসময়।
সুন্দর কল্প কাহিনী । ভাল লাগল । লিখে যান অবিরত । শুভ কামনা ।
চমৎকার কাহিনী।
আনোয়ারুল ভাইকে অভিনন্দন এমন একটি গল্প উপহার দেয়ার জন্য । ভালো থাকবেন ।
ভাল লেগেছে…….
শুভ কামনা।