পৃথিবীর জন্য ভালবাসা
এই লেখাটি ইতিমধ্যে 730বার পড়া হয়েছে।
গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এই অঞ্চলের সমুদ্রের পাশে এমনিতেই সূর্য ওঠার ঘন্টাখানিক পর সমুদ্রের পাড়ের বালির উপর দাঁড়িয়ে থাকা অত্যন্ত দুরুহ। তারপরও আমি এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকি। দাঁড়িয়ে থাকতে আমার ভালো লাগে। কারণ প্রতিদিন এসময় য়োমা এসে সমুদ্রের বালু থেকে ইউরেনিয়াম পরিশোধন করে। এই ইউরোনিয়ামই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে।
আজ অনেকক্ষন হবার পরও যখন দেখলাম য়োমা আসছে না, তখন আমি বুকের ভিতর একটু চিনচিন ব্যাথা অনুভব করতে থাকি। যখন একেবারে নিঃসন্দেহ হলাম আজ আর সে আসবে না, তখন আমি তার বসতিতে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম।
মধ্যউপত্যকা পেড়িয়ে য়োমাদের বসতিতে যখন পৌঁছালাম তখন প্রায় দুপুর। আমাকে দেখে য়োমা দৌঁড়ে চলে এল।
‘শুনেছ, কী ঘটেছে?’ ওর চোখ তখন জ্বল জ্বল করছে। ওর সঙ্গে বেশির ভাগ সময়েই আমি কোন কথা বলি না। শুধু তাকিয়ে থাকি। তাকিয়ে থাকতে আমার ভালো লাগে। আমার ভাবান্তর না দেখে য়োমা তার দু’হাত দিয়ে আমার দু’হাত চেপে ধরে চিৎকার করে বলল, ‘মানুষ আসছে!’
‘মানুষ আসছে!’ আমার মুখ থেকে অস্ফুট শব্দ বের হয়ে এল। তারপর একটু থেমে, ‘তুমি কী করে নিঃসন্দেহ হলে যে মানুষ আসছে?’ বললাম। আমার অবিশ্বাসী মন সহজে বিশ্বাস করতে চাইল না।
‘মহামান্য কিরি বলেছেন।’ য়োমা বলল।
মহামান্য কিরি হচ্ছেন ওদের বসতির সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষ। সম্ভবত সমগ্র পৃথিবীতে যে তিনটি বসতি (প্রতিটাই সমুদ্রের পাড়ে) রয়েছে, যেখানে মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা যায়, তাদের মধ্যে মহামান্য কিরি হচ্ছেন সবচেয়ে বিজ্ঞ ও জ্ঞানী মানুষ। পৃথিবী যদি এভাবে নিঃসঙ্গ হয়ে না যেত, তাহলে তিনি নিশ্চয়ই কোন বড় বৈজ্ঞানিক অথবা মহাকাশযানের দলপতি হতে পারতেন।
য়োমা আমাকে মহামান্য কিরির কাছে নিয়ে গেল। গিয়ে দেখি তিনি একটি গোলাকৃতি স্ক্রীনের সামনে উবু হয়ে বসে দুর্বোধ্য ভাষা বুঝার চেষ্টা করছেন। শব্দ শুনে তিনি তাকিয়ে আমাদের দেখতে পেলেন। তারপর আবার নিজের কাজে মন দিলেন। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ করেই তিনি বললেন, ‘ইরিতাশ, তুমি নিশ্চয়ই এতক্ষণে শুনেছ যে পৃথিবীতে মানুষ আসছে।’
আমি আস্তে করে বললাম, ‘হ্যাঁ।’
তারপর তিনি নিজেই আবার শুরু করলেন, ‘আমি ওদের পাঠানো বিদ্যুৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করছি। তবে এতটুকু নিশ্চিত যে, আগামী সপ্তাহের কোন একদিন মানুষ এসে পড়বে।’
আমি বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে না পেরে বললাম, ‘আগামী সপ্তাহে!’
‘হ্যাঁ।’ তারপর একটু থেমে বললেন, ‘তোমাদের আর কুশানদের বসতিতে খবরটি পৌঁছে দিও। আর যতদূর সম্ভব ওদের তৈরী হতে বলবে। মানুষ আমাদের নিয়ে যেতে আসছে।’
‘আমাদের মুক্তিদাতা।’ ঘরের কোনায় বসে থাকা লোকটি বলল। এ লোকটিকে এতক্ষণ আমি দেখিনি।
মহামান্য কিরির ঘর হতে বের হবার পর য়োমা বলল, ‘জানো, আমি কতদিন মানুষ আসবে এই স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছি আবার ঘুম থেকে জেগে উঠেছি।’ য়োমা সত্যিই একটি আবেগ প্রবণ মেয়ে। আমি ওর কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে, ওর মাথা আমার বুকে চেপে ধরি।
২.
আর কিছুক্ষণের মধ্যে সূর্য ডুববে। পৃথিবী থেকে দেখা আমাদের শেষ সূর্যাস্ত। অন্য সময় হলে এখানে বেশকিছু মানুষ দেখা যেত। আগামীকাল সকালে মানুষ আমাদের নিতে আসবে বলে সবার মধ্যে একধরনের চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। ফলে এখন এখানে আর কেউ নেই।
য়োমা এক দৌঁড়ে সমুদ্রের পানিতে নেমে গেল। সমুদ্রের বাতাসে ওর পোশাকের বিভিন্ন অংশ দুলতে থাকে আর ওর খয়েরী চুল বাতাসে উড়তে থাকে। আমি একধরনের মুগ্ধ বিস্ময়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকি। বহুদিনের পরিচিত এই মুখ আমার অপরিচিত মনে হয়। মনে হয় স্বর্গের কোন দেবী! আমি কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারি না।
এতক্ষণে য়োমা অনেক দূরে চলে গিয়েছে। আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে আহবান করল। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে গেলাম।
তারপর একসময় আমরা সমুদ্রের পানিতে শেষবারের মত সাতঁরিয়ে ক্লান্ত হয়ে বালুকাবেলায় ফিরে আসি। এরই মধ্যে সূর্য ডুবে যায়। ভেজা বালুর উপর শুয়ে আমরা দুজন দূর আকাশের নক্ষত্র দেখতে থাকি।
‘আচ্ছা, ইরিতাশ, ঐ দূরের নক্ষত্র গুলোর কোন গ্রহেইতো মানুষ থাকে?’ একেবারে অর্থহীণ প্রশ্ন। য়োমা ভালো করেই জানে এর উত্তর আমার কাছে নেই। তারপরও আমি বলে ফেলি, ‘হয়তো।’
‘তুমি ভাবতে পারো! আমাদের আর এই নিস্করুন পরিবেশে বেঁচে থাকতে হবে না, অপুষ্টিকর খাবারের জন্য কাড়াকাড়ি করতে হবে না।’ ইতিমধ্যে আমরা উঠে বসি। য়োমা বলতে থাকে, ‘আমরা মানুষের মতই বেঁচে থাকব ঠিক যেমন মানুষেরা বেঁচে থাকে।’
আমি অন্ধকারে য়োমার চোখ পরিস্কার ভাবে দেখতে পারি না। তারপরও আমি নিশ্চিত ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। তাইতো এই ছেলেমানুষী মেয়েটিকে আমার এত ভালো লাগে। আমি ওকে বুকে চেপে ধরি।
‘আমাদের মুক্তিদাতারা আসছে। আর আমাদের এই দূষিত পরিবেশে বেঁচে থাকতে হবে না।’ য়োমা বিড়বিড় করে বলছে।
নিজের অজান্তেই আমার বুকটা কেন জানি এক গভীর শূন্যতায় ভরে উঠল।
৩.
ভোর হতে না হতেই আমরা সবাই সমুদ্রের পাড়ে চলে এলাম। পাঁচটি সুবিশাল মহাকাশযান সমুদ্রের পানি হতে ফুট খানিক উপরে ভেসে রয়েছে।
সোনালী চুলের একজনকে মহাকাশযান হতে নেমে এসে মহামান্য কিরির সঙ্গে ব্যস্তভঙ্গিতে কথা বলতে দেখা গেল। অবশেষে মহামান্য কিরির আনুবাদক যন্ত্র সত্যিই কাজ ছিল।
‘তোমরা একে একে ধীরে ধীরে মহাকাশযানে উঠে পড়। সেখানে নিউপলিমারের পোষাক পাবে। সেগুলো পড়বে আর এখনকার দূষিত পোষাকগুলো আলাদা করে রাখবে।’ মহামান্য কিরি নির্দেশ দিলেন।
আমরা কেউই জীবনে মহাকাশযান দেখিনি। তাই এই বিশাল মহাকাশযানগুলো আমাদের সবাইকে বিমুঢ় করে দিয়েছে। মহামান্য কিরিয় দ্বিতীয় কথায় সবাই যেন চেতনা ফিরে পেল, ‘আর কিছুক্ষণ পরেই আমরা এই দূষিত পরিবেশ থেকে মুক্ত হব।’
তারপর সোনালী চুলের মানুষটি সবাইকে মহাকাশযানে উঠতে নির্দেশ দিল। ধীরে ধীরে সবাই উঠতে থাকে। যখন আমার পালা আসে তখন আমি নিজের অজান্তেই বলে ফেললাম, ‘আমি কোথাও যাচ্ছি না।’ কেন বললাম জানি না।
য়োমা দৌঁড়ে কাছে চলে এলা, ‘ইরিতাশ এসব কী বলছ?’
আমি নির্বিকার ভঙ্গিতে আবার বললান, ‘আমি কোথাও যাচ্ছি না।’
আমার কথা সম্ভবত: সবারমধ্যে অদ্ভূত আলোড়ণ সৃষ্টি করেছে, কারণ সবাই আমাকে ঘিরে ধরল। মহামান্য কিরি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইরিতাশ এসব কী হচ্ছে? পাগলামী বন্ধ কর।’ আমি একই উত্তর দিলে তিনি আবার বললেন, ‘কেন?’
আমি জানি না আমার মধ্যে কী ঘোর কাজ করছে? সত্যিই আমি হয়তো ঘোরেই রয়েছি। আমি বললাম, ‘এই পৃথিবীর পরিবেশ আমরাই নষ্ট করেছি।’ তারপর লালচুলের সেই সুদর্শন মানুষটির দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললাম, ‘ওরাই পৃথিবীটাকে দূষিত করে অন্যত্র চলে গিয়েছে। ওদের হাতে তো অনেক বড় প্রযুক্তি, তবে ওরা কেন পৃথিবীটাকে দূষিতমুক্ত করে না? ওরা আমাদের দয়া করতে এসেছে, শুধুই দয়া। আমাদের জন্য ওদের মধ্যে কোন ভালবাসা নেই, ঠিক যেমন ওদের পূর্বপ–রুষদের ছিল না -পৃথিবীর জন্য।’
আমি স্বীকার করি আমি ভালো বক্তা নই, তারপরও কেন জানি সবাই আমার কথা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতে থাকে আর তীব্র ঘৃণায় মহাকাশযানের দিকে তাকিয়ে থাকে।
আমাদের বসতির সবচেয়ে ছোট মেয়ে আরিয়ানা চিৎকার করে বলে উঠল, ‘আমিও যাব না।’ কথাটি যেন সবার মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটালো। সঙ্গে সঙ্গে সবাই চিৎকার করে উঠল, ‘যাব না।’
মহামান্য কিরি অসহায়ের মত মহাকাশযানের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
পরিশিষ্টঃ
আমি আর য়োমা দুজনে সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে বিশাল বিশাল ঢেউ গুনছি। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্য ডুববে। আজ থেকে বহুবছর পূর্বে আমরা এক সুতীব্র অনুভূতি নিয়ে পৃথিবীতে আবার বাস করার সিদ্ধান্ত নিই। কতটুকু সফল হয়েছি জানি না, হয়তো ব্যর্থ হয়েছি।
তবে আমি বিশ্বাস করি আজ হোক কাল হোক মানুষই পারবে পৃথিবীকে আবার বাসযোগ্য করতে কারণ তার আছে বুকভরা ভালোবাসা।
শুধুই ভালোবাসা, পৃথিবীর জন্য ভালোবাসা।
৮০২ বার পড়া হয়েছে
দারুন দারুণ ভাই, ভালো থাকবেন ।
হ্যাঁ ,পৃথিবীর জন্যে অনেক ভাকবাসা আছে বলে
মানুষ এই পৃথিবীতে মহা মানব হয়ে বেঁচে আছে।
অনেক ভাল লাগলো।
প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী পড়েই আমি এর ভক্ত হয়েছি। আপনার গল্প খুব ভাল লেগেছে।
আমি আর য়োমা দুজনে সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে বিশাল বিশাল ঢেউ গুনছি। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্য ডুববে। আজ থেকে বহুবছর পূর্বে আমরা এক সুতীব্র অনুভূতি নিয়ে পৃথিবীতে আবার বাস করার সিদ্ধান্ত নিই। কতটুকু সফল হয়েছি জানি না,
কখন ই ব্যার্থ হব না।
তবে আমি বিশ্বাস করি আজ হোক কাল হোক মানুষই পারবে পৃথিবীকে আবার বাসযোগ্য করতে কারণ তার আছে বুকভরা ভালোবাসা।
শুধুই ভালোবাসা, পৃথিবীর জন্য ভালোবাসা।
অপূর্ব অদ্বিতীয়।সায়েন্স ফিকশনে আমি মনে করি আপনি প্রথম পজিশনে চলে গিয়েছেন।এই গল্প পড়ে মনে হচ্ছে নিসঃন্দেহে জাফর ইকবাল কে অতিক্রম করে গিয়েছেন।
অসম্ভব ভাল লাগার এক বৈজ্ঞানিক কাহিনী।অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।অনেক শুভকামনা রইল।
চমৎকার হয়েছে।
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী খুব ভাল লাগল । শুভেচ্ছা রইল । ভাল থাকুন ।