বৃহৎ সংকোচন
এই লেখাটি ইতিমধ্যে 686বার পড়া হয়েছে।
মহাকাশযানের বিশাল স্ক্রীনের সামনে হতাশাজনক অপ্রকৃতস্থভাবে দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে রুন মহাকাশযানের কেন্দ্রীয় কম্পিউটারকে দ্বিতীয়বারের মতো জিজ্ঞেস করল, ‘সিসি, তুমি কি নিশ্চিত হতে পেরেছ এটা কোথায়?’
‘মহামান্য রুন, আমি স্ক্যানিং চালিয়ে যাচ্ছি। আমার আরও কিছু সময় প্রয়োজন। মহাকাশের এই জায়গাটা আমাদের পরিচিত এলাকার সাথে মিলছে না। আমার ডাটাবেজে যে ম্যাপিং দেওয়া আছে তার সাথে এখনও মিলাতে পারছি না।’ যান্ত্রিক সুরে সিসি বলে গেল।
রুন ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়ে।
লীহা ৩৮৭ বানমগ্রহ থেকে বিপুল পরিমানে জ্বালানী নিয়ে রুন তার নিজ গ্রহে ফিরছিল। রুন মহাকাশবিজ্ঞানী নয় তবে বহুবার আন্ত:গ্যালাকটিক ভ্রমনের অভিজ্ঞতা তার রয়েছে। মহাশূন্যযান কোন মানুষ ছাড়াই ফিরছিল। বহুদিন ঘরের বাইরে থাকার জন্য সে তার আপনজনের প্রতি এক ধরনের আদি টান অনূভব করতে থাকে। আর তাই মহাকাশযানের নিঃসঙ্গ যাত্রী হিসেবে সে চেপে ওঠে।
সবকিছু ঠিকভাবে চলছিল। যখন সে তার গ্রহ থেকে মাত্র এক বিলিয়ন মাইল দূরে ঠিক তখন কাছাকাছি কোথাও একটা সুপারনোভা বিষ্ফোরণ ঘটে। তীব্র বিকিরণ মহাকাশযানে আঘাত হানে। যেহেতু এই মহাকাশযানে ইতিপূর্বে মানুষ চলাচল করেনি তাই মানুষের জন্য বিকিরণ মোকাবেলার ক্ষেত্রে অতটা শক্তিশালী হিসেবে তৈরী করা হয়নি।
ফলশ্র“তিতে প্রচণ্ড বিকিরণের হাত থেকে বাঁচার জন্য হাইপার ডাইভ দিতে হয়। যেহেতু বিকিরণের সময় প্রথমেই মহাকাশযান কিছুটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়ে সেহেতু হাইপার ডাইভের ক্যালকুলেশনে কিছুটা এদিক সেদিক হয়ে মহাশূন্যযানটি এই অজনা স্থানে এসে পরে।
‘মহামান্য রুন,’ সিসি জানাতে থাকে, ‘আমরা হয়তো মহাশূন্যের একেবারে নিঃসঙ্গ এলাকায় এসে পৌঁছেছি।’
‘বুঝতে পারলাম না।’
‘আমাদের কাছাকাছি এক হাজার কোটি মাইলের মাঝে কোন গ্রহ, নক্ষত্র, অ্যাস্টরয়েড, এমন কি কোন উল্কা পর্যন্ত নেই। আমি এখানে আসা মাত্র চারদিকে বেতার তরঙ্গ পাঠিয়েছি। এটা কোথাও প্রতিফলিত হয়ে এখনও ফিরে আসেনি।’
রুন চূড়ান্তভাবে হতাশ হয়ে পড়ে। ‘প্রয়োজনে হলে আবার হাইপার ডাইভ দাও।’
‘আমাদের হাতে যে পরিমাণ জ্বালানী আছে তা দিয়ে মাঝারিমানের একটি, আর খুব বেশী হলে তারপরও ছোট একটি হাইপার ডাইভ দিতে পারব।’
‘আমাদের ফিরে যাবার জন্য কি এই দুইটা হাইপার ডাইভই যথেষ্ট না?’
‘যতক্ষন না পর্যন্ত আমি ঠিকমত ম্যাপিং করতে পারছি ততক্ষন পর্যন্ত হাইপার ডাইভ দেওয়া সন্তোষজনক নয়। কারণ এর পর হয়তো আর অল্পকিছু জ্বালানী অবশিষ্ট থাকবে।’
‘আর কতক্ষণ লাগবে তোমার এই ম্যাপিং করতে?’
‘এখনও বুঝতে পারছি না। হয়তো এক ঘন্টা কিংবা একশত ঘন্টাও লাগতে পারে। মহামান্য রুন, আপনি এই সময়টুকুতে বিশ্রাম নিতে পারেন অথবা কোন আকর্ষণীয় চলচিত্র দেখতে পারেন।’
রুন বলে উঠল, ‘বিশ্রাম নিতে যাচ্ছি। সুযোগ হলে খানিকটা ঘুমিয়ে নেব।’
‘মহামান্য রুন, আমি কি আপনার শয়নকক্ষের অক্সিজেনের সাথে খানিকটা যেওন ৮২ গ্যাস মিশিয়ে দেব। আপনি খুব ভালো কিছু স্বপ্ন দেখতে পেতেন।’
‘তার কোন প্রয়োজন নেই।’ রুন তার শয়নকক্ষের দিকে হাঁটতে থাকে।
শয়নকক্ষে পৌঁছামাত্র রুন তার শরীর বিছানায় এলিয়ে দেয়। বিছানার পাশের্¡ মহাকাশযানের বিশাল মোটা কাচ। সে শুয়ে একদৃষ্টিতে নিকষ কালো মহাশূন্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। একসময় তার চোখের সামনে একটা বিশাল খোলা প্রান্তর ভেসে ওঠে। রুন ঘুমিয়ে পড়ে।
একটা বিশাল খোলা প্রান্তরের ভিতর দিয়ে কুয়াশাভেজা সকাল বেলা কারও হাত ধরে রুন হাঁটতে থাকে। যতটা বেলা বাড়তে থাকে। রুন ও তার সঙ্গী তবুও হাঁটতে থাকে। একসময় সন্ধ্যা হয়ে আসে। আকাশে হাজার তারার খেলা চলতে থাকে। তারা দু’জন খোলা প্রান্তরে শুয়ে তারার খেলা দেখতে থাকে। হঠাৎ হঠাৎ আকাশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত দু’একটা উল্কা ছুটে চলে। রুন অনেক চেষ্টা করে তার সঙ্গীর দিকে তাকাতে কিন্তু পারে না। সে অবাক বিস্ময়ে ভাবতে থাকে সঙ্গীটা কে। হঠাৎই আকাশ থেকে তীব্র গতিতে কিছু একটা তাদের দিকে ছুটে আসে। তারা দুজনই ছিটকে দু’দিকে চলে যায়।
রুনের ঘুম ভেঙ্গে যায়।
এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল। রুনের মনে হতে থাকে কতটা জীবন্ত সে স্বপ্ন!
ঘুম ভাঙ্গার পরও সে দেখতে পায়, সে মহাকাশযানের কাঁচঘেরা জানালার দিকে তাকিয়ে আছে।
রুন আবারও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎই তার মনে হয়, কোথাও কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু ধরতে পারে না।
কিছু না বুঝতে পেরে যখন সে সিসি কে ডাক দিবে ঠিক তখনই বুঝতে পারে ঘুমাবার আগে মহাশূন্যকে তার যতটা নীকষকালো মনে হয়েছিল এখন অতটা কালো মনে হচ্ছে না। গভীরবাবে খেয়াল করলে সামান্য একটু নীলাভ লাল রঙ অনুভব হয়। সে সিসিকে ডাক দেয়।
‘সিসি, মহাকাশে কি উজ্জ্বল্যতার পরিবর্তন লক্ষ্য করছ? আবার কি কোন সুপারনোভা?’
‘না মহামান্য রুন, এটা সুপারনোভার বিস্ফোরণের উজ্জ্বল্য না।’
‘তাহলে?’
‘আমিও সেটা বুঝতে পারছিনা। সুপারনোভার হলে বিকিরণ ধরতে পারতাম। কিন্তু এখানে সেরকম কিছু নাই।’
তারপর হঠাৎ করেই সিসি বলে ওঠে, ‘মহামান্য রুন একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার ঘটেছে। আমি যতগুলো বেতার তরঙ্গ পাঠিয়েছি একটা নির্দিষ্ট দিক থেকে তার প্রতিটি এইমাত্র একসাথে ফেরত এসেছে। তারমানে ঐ দিকে একটা বিশাল কোন কিছুর অবস্থান আছে।’
‘সেটা কোন দিকে?’
‘অবিশ্বাস্য হলেও যে দিকটা কিছুটা উজ্জ্বল হচ্ছে সে দিকে।’
‘এটা কী করে সম্ভব?’
‘আমিও বুঝতে পারছি না মহামান্য রুন।’ ইতিমধ্যে মহাশূন্যেও উজ্জ্বল্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। সিসি বলে ওঠে, মহামান্য রুন, ‘ইতিমধ্যে মহাশূনের তাপ এবং এই অংশের ভর উভয়ই বৃদ্ধি পেয়েছে। যা আমাদের সকল বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও তথ্যের বিপরীত।’
রুন খানিকক্ষন চুপ থেকে বলে, ‘সিসি আমি একটা সšেদহ করছি। হয়তো আমরা সেটার শুরুটা দেখছি।’
‘মহামান্য রুন, আপনি যা বুঝতে চাচ্ছেন আমি সেটা বুঝতে পারছি।’
‘হ্যাঁ সিসি, মহাবিশ্বের ইতিহাসে সর্বশেষ ঘটনা তাহলে শুরু হয়ে গেছে আর আমারা এই মূহুর্তে মহাবিশ্বের সে সীমানায় আছি সেখান থেকে বৃহৎ সংকোচণ শুরু হয়েছে।’
‘মহামান্য রুন, আমি হাইপার ডাইভের সকল ব্যবস্থা সম্পন্ন করে ফেলেছি।’
রুন মহাকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। ‘আমরা হাইপার ডাইভ দিলে আমাদের এলাকার পৌছানোর সম্ভাবনা কতটুকু?’
‘শতকরা একভাগেরও কম। কারণ আমি এখনও ম্যাপিং করতে পারিনি আর আমরা আছি মহাবিশ্বের একবারে প্রান্তসীমানায়।’
‘তাহলে আর হাইপার ডাইভের প্রয়োজন নেই।’
‘কিন্তু মহামান্য রুন, আমরা হাইপার ডাইভ দিলে বেঁচে যাব একশত ভাগ।’
‘তাহলে মহাবিশ্বের এতসুন্দর একটা দৃশ্য আমি দেখতে পাব না।’
‘কিন্তু এটাতো রীতিমতো আত্মহত্যা।’
‘কিছু ব্যাপার থাকে যাকে আত্মহত্যা বলা যায় না।’ রুন গভীর বিস্ময়ে বিশাল মহাকাশের দিকে তাকিয়ে। আলোকাচ্ছটা এখন আরও মোহনীয় হয়ে ওঠেছে। আমি এই অতিসুন্দরীয় দৃশ্য দেখে মরতে চাই।’
সিসি কলে ওঠে, ‘আমি এখনও মানুষের সকল আবেগ ও অনুভূতি বুঝতে পারি না।’
‘তোমার বোঝার প্রয়োজনও নাই।’ রুন জবাব দেয়।
তখন দূর মহাকাশের নীলাভ লাল আলোকচ্ছটা আরও আকর্ষনীয় হয়ে ওঠে এগিয়ে আসতে থাকে। রুন এক দৃষ্টিতে অবাক বিস্ময়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
৮৩০ বার পড়া হয়েছে
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী অনেক ভালো লাগাল। ধন্যবাদ জানাচ্ছি এত সুন্দর একটি লেখা উপহার দেওয়ার জন্য।
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
ভাল লাগল বিজ্ঞান কল্পকাহিনীটি। এ ধরনের লেখা আরো চাই।
গল্পটা শেষ হয়ে গেল কিন্তু আরও পড়ার ইচ্ছাটা শেষ হল না।দারুণ লিখেছেন।
চমৎকার লাগল আপনার পাঠককে গল্পের শেষ অব্দি টেনে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা দেখে।
দারুণ ভাল লাগা।
তখন দূর মহাকাশের নীলাভ লাল আলোকচ্ছটা আরও আকর্ষনীয় হয়ে ওঠে এগিয়ে আসতে থাকে। রুন এক দৃষ্টিতে অবাক বিস্ময়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
অসাধারণ আপনি
আধ্যাতিকতা আর বিজ্ঞান এর মিশ্রণে
চমৎকার লাগল
এত সুন্দর একটি লেখা
বৈজ্ঞানিক কল্প কাহিনী বেশ মন মুগ্ধকর
বেশ দারুন বেশ সুন্দর লিখা
শুভ কামনা