Today 23 Nov 2024
banner
নোটিশ
ব্লগিং করুন আর জিতে নিন ঢাকা-কক্সবাজার রুটের রিটার্ন বিমান টিকেট! প্রত্যেক প্রদায়কই এটি জিতে নিতে পারেন। আরও আছে সম্মানী ও ক্রেস্ট!
banner

ছেলেবেলার ঈদ

লিখেছেন: হাসান ইকবাল | তারিখ: ২০/০৭/২০১৪

এই লেখাটি ইতিমধ্যে 1770বার পড়া হয়েছে।

ইসলামুদ্দি চাচা।
আমরা তাকে জ্বীন চাচা বলে ডাকতাম।
আমাদের বাড়ির কাজের লোক তিনি। ছোট বেলায় নাকি তাকে পরী ধরেছিল, সেই থেকে সেই পরী তার সাথে সাথেই থাকে। গভীর রাতে অন্ধকার ঘরে তিনি জ্বিন হাজির করতেন, তখন নাকে ঘুঙানোর শব্দ হতো।
আমার বয়স তখন ছয় কি সাত হবে। স্কুলে যাওয়া শুরু করেছি মাত্র। সেই সময়কার ঈদের স্মৃতি গুলো আমার খুব মনে পড়ে। আমার দাদু তখন বেঁচে আছেন। আলম সাধু, গাজী-কালু, সেকান্দর বাদশা, রঙিলা চোরা ও ডালিম কুমারের গল্প শুনতে শুনতে দাদুর বিছানায় ঘুমিয়ে পড়তাম। সকাল বেলায় নিজেকে আবিষ্কার করতাম মায়ের সাথে।রাতের বেলায় আমাদের বাড়ির উঠানে, কখনো বারান্দায় পাটাতন বিছিয়ে পুথি পাঠের আসর বসতো। আমার দাদা হতেন সে আসরের মধ্যমনি। কত রকমের পুথি। আর পুথির সে যে কী ব্যঞ্জনা। সুরের সে দ্যুতনা আর সূচনা পর্বের স্তুতি আমার মানসলোকে এখনও উজ্জ্বল। সারা গায়ের লোক বাহ্বা দিত সে পুথি শুনে। কি সুন্দর ও করুন ছিল সেই পুথির সুর। তাছাড়া দাদুর সংগৃহীত পুথির মধ্যে ছিল-নূর পরিচয়, শুনাভানের পুঁথি, আদি ও আসল গাজীকালু চম্পাবতী কন্যার পুথি, কড়িনামা, সফরমুল¬ুক, জঙ্গনামা, হরিণনামা, মহব্বতনামা, হাশর মিছিল, ছহি বড় ছয়ফুল মুল¬ুক বদিউজ্জামাল, আদি ও আসল দেলদার কুমার ও শাহজাদী দিল পিঞ্জির কিচ্ছা, ছহি বড় ফকির বিলাস, ছয়ফুল বেদাত, সাত কইন্যার বাখান, ছহি বড় আছরার ছালাত, আদি আসল গুল-ই-বকাওলী ইত্যাদি। ইউছুফ জুলিখা, ভেদকায়া, গাজী-কালুর পুথি সবসময় পড়া হতো। সিলেটি ‘ভেদকায়া’ পুথির সূচনা পর্বের কিছু অংশ তুলে ধরছি। সব পুথিরই বন্দনা অংশ আমার খুব ভালো লাগতো। নাগরী ভাষায় রচিত ‘ভেদকায়া’ রচয়িতা ছিলেন শাহ ছুফি আবদুল ওহাব চউধুরী।
পরথমে সরন করি আল্লা নিরনজন।।
কায়াতে চেতন কইলে ভরিয়া পবন*
বিন্দু জলে বান্দিলে কেমন পুতলা।।
মাটির ঘরে রুহ ভরি করিলে উজালা*
অন্ধকার ভাংগিল চক্খু দান দিয়া।।
এ ভবের রংগ দেখি চক্খু দান পাইয়া*
করনও দিল ধনি সব সুনিবার।।
জবান দান র্ছিজি দিল মজা বুঝিবার*
আরওত ছিফাত আল্লার জবানের মাঝার।।
জবানে আর দিলে হয় জিকির আল্লার*ঈদের দিনে ঘুম ভাঙতো সেই জ্বিন চাচার কর্মচঞ্চলতার শব্দে। ইসলামুদ্দিচা বারান্দায় পাটাতন বিছিয়ে তিনি বটি, ছুরি, চাকু ধার দিতেন। সেটা বকরা ঈদের সময়। ছুরি শান দেয়ার একটা বিশেষ পদ্ধতি ছিল। আয়েশি ভাব নিয়ে তিনি বসতেন গজারি কাঠের একটি লুট (কাঠ খন্ড) নিয়ে, যা দিয়ে গাইলে (কাঠের তৈরি একটি গভীর পাত্র) চাল গুড়ু করা হয়। বালি দিয়ে ঘষে ঘষে তিনি বটি, ছুরি ধার দিতেন। সেই শব্দে আমার ঘুম ভাঙতো।
আকাশে মেঘ না থাকলে ঈদের আগের দিন রাতে উঠোনো বড় পাটি বিছিয়ে বড় সলতের কুপি বাতি জ্বালিয়ে সব কাজিনরা বসতাম গোল হয়ে, হাতে মেহেদির রং লাগানোর জন্য। তখন টিউব মেহেদি পাওয়া যেত কিনা জানিনা। মেহেদি গাছের পাতা জোগাড় করা হতো, তারপর পাটায় তা বাটা হতো। ঈদের আগে বাবা কালিগঞ্জে যেতেন (বর্তমান নাম- নেত্রকোনা) ঈদের বাজার করার জন্য। সারাদিন অপেক্ষার পালা আমার জন্য কি রংয়ের জামা নিয়ে আসবে। আনবে তো! মনের মধ্যে নানা প্রশ্ন উঁকি দিত। কারন, আমরা ছোটবেলা থেকে যৌথ পরিবারে বেড়ে উঠেছি, আমার কাজিনদের জামা গুলো বেশি সুন্দর হবে নাকি আমারটা। বালক বয়সের এই ভাবনায় যে উত্তেজনা আন্দোলিত হতাম তা লিখে প্রকাশ করা যায়না।ঈদের দিন সকাল বেলায় গোসল করার জন্য আমাদের পুকুর ঘাটে ভিড় জমে যেত, কে আগে গোসল করবে এবং কে সবার আগে নতুন জামা পরে ঈদগাহে যাবে। আমরা সবাই নৌকায় চড়ে ঈদগাহে যেতাম। আমাদের গ্রামে একটিই ঈদগাহ মাঠ, যা আমাদের বাড়ি থেকে দুমাইল দূরে। সেখানে দশহাজার লোক একসাথে নামাজ পড়তে পারে। পাড়ার মসজিদে ঈদের কোন জামাত হতোনা। ঈদগাহের পাশেই ছিল একটি বড় খাল। সে খালের উপর ছিল লম্বা বাঁশের সাঁকো। সাকো পার হওয়ার সময় খুব সাবধানে পার হতে হতো। নৌকা দিয়ে ঈদগাহে আসার পথে দেখতাম অনেকেই সাঁকো থেকে পা পিছলে সপাং সপাং করে পড়তো পানিতে। ইসলামুদ্দি চাচা তাদের টেনে তুলতেন নৌকাতে। তখন গ্রামে টেলিভিশনের তেমন প্রচলন ছিলনা। আমাদের গ্রামে চেয়ারম্যান বাড়িতে একটি সাদাকালো টেলিভিশন ছিল। বিকেল বেলা ভিড় জমাতাম বিটিভি’র অনুষ্ঠান দেখার জন্য।

কোন কোন ঈদ শুক্রবারে হতো। ঈদগাহ থেকে নামাজ পড়ে আবার যেতাম জুম্মা বাড়ির মসজিদে। সাথে থাকতেন দাদুভাই, বাবা এবং ছোট চাচা। আমার ছোট চাচাকে নিয়ে একটা মজার ঘটনা আছে। ছোট চাচার নাম আজিজুর রহমান। আমার আমার দাদী এই লম্বা নাম মনে রাখতে পারতেন না। আজিজুর না বলে ডাকতেন গাজিবর। সেই গাজিবর নামটি ছোট হতে হতে ‘গাজী’ তে রূপান্তরিত হয়েছে। এখন গায়ের সবাই বলে গাজী। আর আমি ডাকি গাজী কাকা। জুম্মার নামাজ শেষ হলে বাড়িতে সবাই মিলে দুপুরের খাবারের ধুম পড়তো। আমাদের জুম্মা বাড়ির মসজিদের একটি বৈশিষ্ট্য হলো- নামাজ শেষ হলে সকল মুসুলি¬দের শিরনী দেয়া হয়। ময়দা-ঘি দিয়ে প্রস্তুত করা এক বিশেষ ধরনের খাবার। নাম ‘তুষার শিন্নী’। নামাজ শেষ হতেই আমি উদগ্রীব হতাম সেই  শিরনীর জন্য। যেদিন আমি মসজিদে যেতাম না, দাদু লাটি ভর করে মসজিদে যেতেন। মসজিদ থেকে ফিরলে হাতের দিকে চেয়ে থাকতাম শিরনী আনলো কিনা।

এক ঈদের কথা বলি। রোজা ঈদ। প্রচন্ড গরম পড়েছিল। আমাদের তখন গম কাটা শুরু হয়েছে। হুট করে আমাদের জ্বিন চাচা লাপাত্তা। কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। বাবা-মা’কে জিজ্ঞেস করেও কোন সদুত্তর পেলাম না। ঈদের পরদিন জ্বিন চাচা এসে হাজির। জিজ্ঞেস করলাম- কোথায় ছিলে চাচা? চাচা বললেন- জ্বিনদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। আমার বিশ্বাস হলোনা।

প্রতিবছর ঈদ আসে, ঈদ যায়। আমার ছেলেবেলার সেই অবিশ্বাসটা এখনো থেকেই গেছে। ঈদ এলেই আমার দাদার কথা মনে পড়ে খুব বেশি। ঈদের দিন বিকেল থেকেই বসতো পুথির আসর। দাদার সুর করে পড়া পুথির সুর আমাকে ডাকে। আমি তন্ময় হয়ে যাই। ছহি ফকির বিলাস পুথির বন্দনা আমার কানে বাজে-

*পয়ার*
আল্লার তারিভ আমি কি লিখিব ভাই।।
তারিভ করিতে তার শক্তি কার নাই*
না আছে শরিক কেহ একেলা হাকিম।।
যাহা চাহে তাহা করে কুদরত আজিম*
না আছে উজীর তার নাহি সল্লাদার।।
আপন বাদশাই বিচে আপনি মোক্তার।।
আপন নূরে পয়দা করে মোস্তফায়।।
খলিফা করিয়া শেষে ভেজে দুনিয়ার*
দুরদ সালাম মোর নবীর উপরে।।
তাহার আওলাদ আর আছহাব সবারে*
আম্বিয়া আওলাদ আর বোজর্গ তামাম।।
সবার জনাবে মেরা হাজার সালাম*

*পয়ার*
শুন ভাই দীনদার কিতাবে খবর।।
পয়দা হইলেন যবে দীন পয়গম্বর*
চল্লিশ সাল গুজারিল নবী মোস্তফার।।
কোরআন নাজিল হইল উপরে তাহার*
কোরআনের বিচে যত ভেদ পুসিদার।।
হেকমেতেতে রাখিয়াছ পাক পরওয়ার*
তাওহীদের ভেদাভেদ আছে কোরআনেতে।।
কামেল ফকির বিনে কে পারে বলিতে*
একশত চৌদ্দ সুরা আছে কোরআনেতে।।
হরফের শুমার তার লিখি এখানেতে*
তিন লক্ষ ষোল শত উনষাট অক্ষর।।
তামাম কোরআনে আছে শুন সে খবর*

১,৭১৮ বার পড়া হয়েছে

লেখক সম্পর্কে জানুন |
...আমার বাবার লেখা ডাইরীতে আমার জন্ম তারিখ লেখা আছে ২০ আগস্ট। নীল রংয়ের উইনসন কলমের কালিতে গোটা অক্ষরে। .... ছেলেবেলার দুরন্ত শৈশব কেটেছে নেত্রকোনায়। আর সবচেয়ে মধুর সময় ছিল সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার দিনগুলি। আর এখন কাজ করছি সুবিধাবন্ঞ্চিত শিশুদের জন্য একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায়। স্নাতকোত্তর করেছি সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ে। কবিতা পড়তে ভালোলাগে...ভালোলাগে লিখতেও। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের আঁকা ও লেখা নিয়ে শিশু-কিশোরদের সাহিত্য বিষয়ক প্রকাশনার সম্পাদনা সহযোগী হিসেবেও আছি । লিটলম্যাগ পড়া হয় বেশি, ততটা বইপোকা আমি না। তবে বই পড়তে ভালবাসি। গ্রামে বেড়াতে গেলে আমার বাবার গড়া "পাঠাগার" -এ সময় কাটে বেশি। ই-মেইল: hasan_netsu@yahoo.com
সর্বমোট পোস্ট: ৪ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ৭ টি
নিবন্ধন করেছেন: ২০১৪-০৭-০৯ ০৩:৩৪:১৪ মিনিটে
Visit হাসান ইকবাল Website.
banner

৭ টি মন্তব্য

  1. আরজু মূন মন্তব্যে বলেছেন:

    একশত চৌদ্দ সুরা আছে কোরআনেতে। ।
    হরফের শুমার তার লিখি এখানেতে*
    তিন লক্ষ ষোল শত উনষাট অক্ষর। ।
    তামাম কোরআনে আছে শুন সে খবর*

    পুথি পড়তে পড়তে আপনার লেখা শেষ হল। সহজ সাবলীল সুন্দর লেখা। মনে স্থান করে নিল। অনেক ধন্যবাদ সুন্দর গল্পটির জন্য। শুভেচ্ছা রইল। .

  2. হাসান ইকবাল মন্তব্যে বলেছেন:

    আরজু মূন, ধন্যবাদ আপনাকে আমার লেখাটি সময় করে পড়ার জন্য। শুভ কামনা নিরন্তর।

  3. দীপঙ্কর বেরা মন্তব্যে বলেছেন:

    ভাল লাগল

  4. হাসান ইকবাল মন্তব্যে বলেছেন:

    ধন্যবাদ দীপঙ্কর বেরা ..

  5. সারমিন মুক্তা মন্তব্যে বলেছেন:

    দারুন হয়েছে।

  6. হাসান ইকবাল মন্তব্যে বলেছেন:

    ধন্যবাদ সারমিন মুক্তা।

  7. ছাইফুল হুদা ছিদ্দিকী মন্তব্যে বলেছেন:

    দাদার সুর করে পড়া পুথির সুর আমাকে ডাকে। আমি তন্ময় হয়ে যাই।

    পুথির আসর এখন আর কোথাও নেই। দিন দিন আমরা অনেক কিছু হারিয়ে ফেলছি। ভালো লাগলো আপনার পুথি পড়ে। ধন্যবাদ।

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করতে লগিন করুন.

go_top