কবি বন্দে আলী মিয়ার মৃত্যুবার্ষিকী আজ
এই লেখাটি ইতিমধ্যে 1824বার পড়া হয়েছে।
‘আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর/থাকি সেথা সবে মিলে-নাহি কেহ পর। পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই/এক সঙ্গে খেলি আর পাঠশালে যাই। আমাদের ছোট গ্রাম মায়ের সমান/আলো দিয়ে বায়ু দিয়ে বাঁচাইছে প্রান। মাঠ ভরা ধার আর জল ভরা দীঘি/চাঁদের কিরণ লেগে করে ঝিকিমিকি। আম গাছ জাম গাছ বাঁশ ঝাড় যেন/মিলে মিশে আছে তারা আপনার হেন। সকালে সোনার রবি পূর্ব দিকে ওঠে/পাখী ডাকে বায়ু বয় নাশ ফুল ফোটে।’
যিনি এ কবিতার জনক তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। আজ ২৭ জুন মৃত্যু দিবস। তবে স্মৃতিটুকু আমাদের মাঝেমধ্যেই তার কাছে টেনে নেয়। শিশুসাহিত্যের নান্দনিক কবি/আমাদের গ্রামের কবি/বিখ্যাত ময়নামতি চরের কবি/পাবনার কৃতী সন্তান; তথা সারাদেশের মানুষের স্বনামধন্য কবি ‘বন্দে আলী মিয়া’। কবি বন্দে আলী মিয়া রচিত শিশুতোষ সাহিত্য ছড়া ও গান এদেশের মানুষের মাঝে এখনও সচলতার পরিচয় বহন করে। বাংলাদেশের কবিদের মধ্যে শিশুসাহিত্যের বিশেষ অবস্থান ছিল কবি বন্দে আলী মিয়ার। পাবনা জেলা শহরের রাধানগর মহল্লার উমেদ আলী মিয়া ও মাতা নেকজান নেছার কোলজুড়ে আসেন কবি বন্দে আলী মিয়া ১৯০৬ সালের ১৭ জানুয়ারী। পাবনা শহরের রাধানগর মহল্লায় তিনি ক্রমান্বয়ে বেড়ে ওঠেন। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে কবি বন্দে আলী মিয়া পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয কলেজের পূর্ব-দক্ষিণ কোনায় অবস্থিত রাধানগর মজুমদার একাডেমি (বর্তমানে আরএম একাডেমি হিসেবে পরিচিত) থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বৌবাজারস্থিত ইন্ডিয়ান আর্ট একাডেমি থেকে চিত্রবিদ্যায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে কর্মের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে কলকাতা করপোরেশন স্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং দীর্ঘ ২০ বছর চাকরি করে অবশেষে তিনি ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে অবসন গ্রহণ করেন। কবি বন্দে আলী মিয়া ছিলেন একাধারে গীতিকার, উপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী ও অসংখ্য শিশুতোষ সাহিত্যের এক অনন্য প্রতিভাধর। সেই সঙ্গে কবি ছিলেন জীবনীকার ও স্মৃতিকথার কুশলী লেখক। তিনি সমস্ত জীবন বাংলা সাহিত্যের ভূবনে আচ্ছাদিত ছিলেন। কবির জীবনকালে নানা সমস্যার-জটিলতার সম্মুখীন হয়েছেন। সুখ যেমন তার সাথী ছিল তেমনি দুঃখও ছিল ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সুখে ছিল শান্তি আর দুঃখে ছিল নির্মমতা ও অস্থিরতা। কবি বন্দে আলী মিয়া দুঃখকে আঁকড়ে ধরে ধৈর্যের সঙ্গে প্রবাহমান সময় অতিবাহিত করলেও কখনও সাহিত্য চর্চায় পিছুটান হননি। তাঁর অসাধারণ লেখনির মাঝে তুলে ধরেছেন সমাজের কথা সেই সঙ্গে দেশের কথা। তিনি আর্থিক দৈন্যদশায় নিমজ্জিত ছিলেন এমন সময় তার গেছে। তারপরও তিনি বাংলার প্রকৃতি, মাটি ও মানুষকে আপন করে এ সমাজেই প্রতিষ্ঠার চেষ্টা তার ক্ষুরধার লেখনির মাধ্যমে চালিয়ে গেছেন। শোনা গেছে, টাকা-পয়সার অভাবে তিনি নামে মাত্র ৫০ টাকার বিনিময়ে প্রকাশকের কাছে একবার বই বিক্রয় করেছিলেন। তার লেখা আরও অনেক গ্রন্থ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এমন গ্রন্থও কবির আছে যে, তার আর দ্বিতীয় কোনো পান্ডুলিপি তার কাছে ছিল না। তিনি কোনো সময়ে তার রচনাকৃত কোনো বই দরকার হলে পরিচিত জনের নিকট সহযোগিতা চাইতেন বইটি সংগ্রহ করার জন্য। কারণ অনেকসময় তার নিজের কপিও কাছে থাকতো না। সরল প্রকৃতির সাদাসিধে মানুষ হিসেবেই তিনি সর্বজন পরিচিত ছিলেন। আর্থিক দৈন্যদশার পরও কারো কাছে কোনো দিন হাত পেতে নিজে কখনো মাথা নত করেননি বলেও জানা যায়। বিভিন্ন লেখক কবি বন্দে আলী মিয়াকে বিশিষ্ট বিদেশি সাহিত্যিকদের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তুলনার কারণ হিসেবে জানা গেছে, তিনি মুখে মুখে গল্প বলায় যথেষ্ট পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। যদিও বিশ্বখ্যাত রুশ লেখক ও উপন্যাসিক ‘লেভ টলস্টয়েল’র যেমন মুখে মুখে গল্প বলায় পারদর্শী ছিলেন তেমনি এখানে তার সঙ্গে একটু তুলনা এই কবি বন্দে আলী মিয়ার না করলেই নয়। কবি বন্দে আলী মিয়া কলকাতা, ঢাকা ও রাজশাহী এ তিনটি স্থানই তার কর্মস্থল ছিল। কবি জীবনের শেষ দিকে বাংলাদেশ বেতার রাজশাহীর স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি সময় সুযোগ পেলেই শিশুদের সঙ্গে হাসিঠাট্টায় মেতে যেতেন। তিনি সুযোগ পেলেই ছড়াকারে কথা বলতেন বা কোনো কাগজ-কলম হাতের কাছে পেলেই লিখতেন ছড়া-
ঢুলু-ঢুলু আঁখি-এ রাতে কোথায় থাকি!
কিবা করি কিবা খাই;
কোথায় মেজবান-ধারে-কাছে কেহ নাই।
কবি বেতারে কাজ করার সময় ছোটদের আসর ‘সবুজ মেলা’ পরিচালনা করতেন এবং তিনি ‘গল্প দাদু’ নামে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি বেতারে ‘ছেলে ঘুমালো’ অনুষ্ঠানের জন্য প্রায়ই নতুন নতুন গল্প রচনা করতেন। তিনি ৩০ থেকে ৪০ দশকের প্রথম ৩০ বছর কলকাতায় অবস্থান করেছেন। এ অবস্থান সময়ে কবি বন্দে আলী মিয়া কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, অবনীনন্দনাথ, সজনিকান্ত দাস, প্রমথ চৌধুরী, নরেশ দেব, হুমায়ুন কবির, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, একে ফজলুল হক, ওস্তাদ জমির উদ্দিন খাঁ, সৈয়দ এমদাদ আলী, শেকোয়ার অনুবাদক আশরাফ আলী খান, শাহাদৎ হোসেন প্রমুখ বরেন্য সাহিত্যিক ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সাক্ষাৎ সূত্রে তিনি সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। কখনও কখনও গান রচনায় তিনি আকৃষ্ট হতেন। উল্লিখিত সাহিত্যিক ব্যক্তিবর্গের উৎসাহ পেয়েছেন কবি। আবার অনেকে তাকে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতাও করেছেন। কবি বন্দে আলী মিয়ার প্রথম কাব্য ‘ময়নামতির চর’ ১৯৩২ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রশংসার বাণীতে শিরোভূষণ করে প্রকাশ লাভ করে। ময়নামতির চর কাব্যগ্রন্থের ভূমিকা লিখতে গিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার স্বহস্তে লিখেছেন-
‘তোমার ময়নামতীর চর কাব্যখানিতে গঙ্গা চরের দৃশ্য এবং তার জীবনযাত্রার প্রত্যক্ষ ছবি দেখা গেল। পড়ে বিশেষ আনন্দ পেয়েছি। তোমার রচনা সহজ এবং স্পষ্ট, কোথায়ও ফাঁকি নেই। সবস্তরের অনুরাগ দিয়ে তুমি দেখেছ এবং কলমের অনায়াস শুদ্ধিতে লিখেছ। তোমার সুপরিচিত প্রাদেশিক গ্রাম্য শব্দগুলো যথাস্থানে ব্যবহার করতে তুমি কুন্ঠিত হওনি তাতে করে কবিতাগুলো আরো শরস হয়ে উঠেছে। পদ্মাতীরের পাড়াগাঁওয়ের এমন নিকটস্পর্শ বাংলা ভাষায় আর কোনো কবিতায় পেয়েছি বলে আমার মনে পড়ছে না। বাংলা সাহিত্যে তুমি আপন বিশেষ স্থানটি অধিকার করতে পেরেছ বলে আমি মনে করি’ (২৬ জুলাই ১৯৩২)।
তরুণ কবি বন্দে আলী মিয়া ২৬ বছর বয়সে রাতারাতি তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেন। সাহিত্যের অন্যদিকে তিনি নিয়োজিত না থাকলেও কেবলমাত্র শিশুসাহিত্যের স্রষ্টা হিসেবেই অমর হয়ে থাকবেন নিঃসন্ধেহে। বিভিন্নভাবে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জানা গেছে কবি বন্দে আলী মিয়ার শিশুতোষ গ্রন্থের সংখ্যা ১০৫ টি এবং অন্য বিষয়ে লেখা বইগুলো যোগ করলে মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩৬টিতে। তার উল্লেখযোগ্য রচনাবলীর মধ্যে কুচ-বরণ কন্যা, গুপ্তধন, শিয়াল পণ্ডিতের পাঠশালা, চোর-জামাই, ঝিনুক-পরী, দুই বন্ধু, যেমন কর্ম-তেমন ফল, ডাইনি বউ, শিশুদের বিষাদসিন্ধু ইত্যাদি। কবির বেশকিছু অপ্রকাশিত গ্রন্থও রয়েছে।
বরেন্য প্রতিভার অধিকারী পাবনার কৃতী সন্তান কবি বন্দে আলী মিয়া ১৯৭৯ সালের ২৭ জুন সারাদেশ ও কলকাতা এবং তার নিজ জন্মস্থল পাবনার গণমানুষের মাঝে থেকে বিদায় নিয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন পাবনার রাধানগর বাসভবনের পাশে। এ দিন তিনি রাজশাহীর কাজিরহাট অঞ্চলের নিজ বাসভবনে সকাল ১১টা ১০ মিনিটে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কবি বন্দে আলী মিয়ার বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর।
চলন্তিকার পক্ষ থেকে আমরা কবির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি আরিফ আহমেদ সিদ্দিকীর প্রতি।
১,৯২৬ বার পড়া হয়েছে
আমরা কয়জন এসব গুনি কবি, সাহিত্যিকদেরকে মনে রাখি।
আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা রইল।
এখনও আমাদের গ্রাম কবিতাটি আমার অন্যতম সেরা দেশাত্ববোধক কবিতা।
আল্লাহ তাঁকে জান্নাত দিক