ধারাবাহিক উপন্যাস “নিয়োগ পত্র” – বিংশ পর্ব
এই লেখাটি ইতিমধ্যে 1482বার পড়া হয়েছে।
বিংশ পর্ব
(একুশ)
সিস্টার দু’জন দুদিকে দু’হাত ধরে জানালার পাশে নিয়ে যায়। তারপর বলে-আপনার মনটা খুব নরম। সত্যি বলছি আপনি মানসিক ভাবে যতটা ভেঙ্গে পরেছেন অসুখটা তত নয়। তিমির জানালার গ্রিল ধরে দাড়ায়। দৃষ্টি স্থির। নির্বাক নিথর। বাইরে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে থাকা ইউক্যালিপ্টাস গাছগুলো দুলছে। চারিদিকে শান্ত পরিবেশ। কোন কোলাহল নেয়। একটা এ্যাম্বুলেন্স বিকট শব্দে সাইরেন বাজিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল। এই বুঝি কারও জীবন প্রদীপ নিভে গেলো। মৃত্যর ভয়াবহতা আরও গভীরে নিয়ে যায়। মৃত্যকে আলিঙ্গন করতে ইচ্ছে করছে। হার মানতে হচ্ছে জীবনের কাছে।
পাশে সিস্টার দাড়িয়ে আছে। তিমির খেয়াল করেনি। একজন বলল-
– আজ জোৎস্না নেয়, চলুন ঘুমাবেন।
– না সিস্টার। আর একটু দাড়ায়। বেশ ভালো লাগছে। জোৎস্না নেয় বলে পৃথিবীর রুপ থাকবে না, এমনতো কোন কথা নেয়। আলোর রুপ খুঁজতে হয় আঁধারের মাঝে। আবার অলোর পেছনে ছুটতে ছুটতে আঁধারের রহস্যটাও অজানা থেকে যায়। এই দেখুন না, তারাগুলো কেমন মিট মিট করে জ্বলছে। সারা রাতভর জেগে আছে তারাগুলো। ওরা কত সত্য।
– প্লিজ চলুন। ঘুম না আসলে শুয়ে থাকবেন। যে কোন মুহুর্তে স্যার চলে আসতে পারে।
– না সিস্টার, আমার খুব ভালো লাগছে। আপনারা যান। আমি একটু দাড়ায়। প্লিজ আপনারা যান। খারাপ লাগলে আমি ডাকবো।
সিস্টাররা ফিরে আসে। রাত অনেক হয়েছে। কোন দিকে খেয়াল নেই। ফুরফুরে ঠান্ডা হাওয়া এসে গায়ে লাগছে। চোখের পলক পড়ে। হঠাৎ প্রচন্ড শীত লাগছে। জ্বরটা বুঝি চেপে চেপে আসছে। থর থর করে কাঁপছে শরীর। শক্ত হাতে ধরে রাখে জানলার শিখগুলো। সামান্য বাতাসেও বুঝি ঢলে পরবে রোগা শরীরটা। সারিবদ্ধ ইউক্যালিপ্টাস পাতাগুলো সুতা কাটা ঘুড়ির মতো ফর ফর করে ঝড়ে পরছে। চলে যাচ্ছে অনেক দূরে। যেতে যেতে একসময় নিঃশব্দে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। দুর্বা ঘাসের ডগা গুলো নড়ে উঠে। একটা খোলস ছাড়ানো সাদা ইউক্যালিপ্টাসের বুক ছিড়ে কারা যেন অনেক কিছু লিখে রেখেছে। কোন আপনজনের চোখে পড়বে হয়তো। ধীরে ধীরে আড়াল হয়ে যাচ্ছে বাঁকা চাঁদ খানা। কি সুন্দর করে লুকোচুরি খেলছে চিকন চিকন পাতা গুলোর আড়ালে।
তিমিরের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। চোখের কোনায় জল জমে। কান্নার বাঁধ আর বাধা মানলো না। ফুফিয়ে কেঁদে উঠে। জানালার পর্দায় চোখ মুছে নেয়।
একজন নার্স টেবিলে মাথা নীচু করে ঝিমুচ্ছে। সম্ভবত ঘুম পেয়েছে। পাবে না কেন। একজন সুস্থ সবল মানুষ কতক্ষন জেগে থাকতে পারে। একজন পলকহীন তাকিয়ে আছে তিমিরের দিকে। ওর শরীরটা যেন কাঁপছে। প্রচন্ড রকম কাঁপছে। পায়ের উপর ভারসাম্য রাখতে পারছে না। মাথাটা আলগা করে ঠেকিয়ে রেখেছে গ্রীলের সাথে। নার্স ছুটে আসে। এ কি কাঁপছেন আপনি। তিমির খেয়াল করেনি। পিটে সিস্টারের স্পর্শ পায়। চমকে উঠে তিমির। চোখ দু’টো জলে ছল ছল করছে। চোখ পরতেই দু’ফোটা জল গড়িয়ে পরে মেঝেতে। দৃষ্টি পরিষ্কার হয়। জিজ্ঞাসা করে-
– আপনি।
– হ্যাঁ আমি। চলুন বিছানায়। আপনাকে বললাম এখানে দাড়াবেন না। জ্বরে তো ঘা পুরে যাচ্ছে।
তিমির সাদা পর্দাটায় আবার চোখ মুছল। পর্দাটা হাত ছাড়া হতেই সিস্টার অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল-পর্দাটা তো পুরো ভিজিয়ে ফেলেছেন। আপনার কি হয়েছে বলুন তো।
– কিছু না, সিস্টার কিছু না। চলুন আমাকে একটু বিছানায় শুইয়ে দেবেন।
– হ্যাঁ, চলুন। নইলে ডাক্তার এসে আমাদের বকা দেবে।
– না না, তা হবে কেন। বলব আমি নিজের ইচ্ছায় দাড়িয়েছি। তিমির সিস্টারের কাঁধটা বগল দাবা করে শরীরের ভার ছেড়ে দেয়। বালিশে মাথা রাখতে রাখতে বলে-সত্যিই আপনারা খুব ভালো। আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ।
– ওভাবে বলবেন না। আমরা আমাদের কর্তব্য করছি মাত্র। নিন। চোখে একটু জলের ছিটা দিচ্ছি। তোয়ালেটা দিয়ে ভালো করে চোখ মুছে নিন। চোখ দু’টো ফুলে গেছে। ওভাবে কাঁছিলেন কেন।
– সিস্টার কিছু মানুষ আছে যারা মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না। শুধু হৃদয়ের ক্ষত বিক্ষত যন্ত্রনা দিয়ে প্রায়চিত্ত করতে হয়। সে যে কি কষ্ট সিস্টার। শুধু ভাবে এটা এমন না হয়ে অমনও তো হতে পারতো। তবে হলো না কেন। এটায় অতীতের নির্মম সত্য। আর এই সত্যটায় চরম শাস্তি।
– সিস্টার মাথাটা আস্তে করে বালিশে শুইয়ে দিয়ে বলে-আমি বুঝতে পারছি আপনার মনে খুব কষ্ট। এ নিয়ে অযথা উত্তেজিত হলে ক্ষতিটা আপনারই হবে। এখনও অনেক সময় আছে নিজেকে গড়ে তোলার। আর পরিবর্তনটায় তো এ সমাজের নিয়ম। সময়ের ¯্রােতে আমাদের কিছু কিছু স্মৃতিকে তো অস্বীকার করতেই হয়। শুধু নিজেকে বাঁচানোর জন্য। সামান্য সুখের জন্য। প্লিজ আর কথা নয়। এবার ঘুমিয়ে পড়–ন।
তিমিরের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। শরীরটা আবার কাঁপছে। নার্স কম্বলটা টেনে দেয় গলা পর্যন্ত। ঘোলাটে দু’টো চোখ মেলে বাইরে থাকায়। বাইরের নীরব প্রকৃতি গভীর ঘুমে মগ্ন। নীরবতা ভেদ করে লম্বা একটা হাই তুলে ঘুমাতে চেষ্টা করল তিমির। ঘুম আসছে না। মাথা নেড়ে বলে-
– না না সিস্টার আমি বিশ্বাস করি না। এই সেদিনও ছিল যা চির সত্য, চির উজ্জল তাকে অস্বীকার করবেন কি করে। কোন বিবেকবান মানুষ কি তা পারে। বৈদ্যুতিক বাল্ব দিয়ে তো আর চাঁদের আলোকে অস্বীকার করা যায় না। আসলে সবকিছুর মুলে আমাদের ঐ স্বার্থপর সমাজ। সহজে কাউকে স্বীকৃতি দেয় না। শুধু পুড়িয়ে মারে।
জ্বরটা একটু কমে আসছে। কপালে হাত দিয়ে দেখে সিস্টার। ঘামে হাতের তালুটা ভিজে গেছে। তিমিরের চুলের ফাঁকে আঙ্গুল চালিয়ে বলে-স্বীকৃতি কেউ দেয় না। আদায় করে নিতে হয়। আপনি এবার ঘুমান। আমি ওখানে আছি বলে কম্বলটা আর একটু টেনে দেয়। তিমির নির্বাক দৃষ্টিতে সিস্টারের চলে যাওয়া দেখে।
চলবে……..
১,৫৩৯ বার পড়া হয়েছে
উপন্যাস লেখা বিশাল কঠিন কাজ, আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ লেখার জন্য ।
অনেক ধন্যবাদ…আপনি কষ্ট করে পড়েছেন…শুভকামনা।
মিলন ভাই মাঝ খানে কোথায় ছিলেন?
নিয়োগ পত্র ভাল লাগলো।
অনেক শুভ কামনা।
কাশেম ভাই…আছি তো। খুব ভালো লাগলো আপনাকে পেয়ে…ব্যস্ততা একটু বেশী এই যা…
পড়লাম সাথে আছি।
ধন্যবাদ আমির ভাই…
ভাল লাগে আপনার নিয়োগপত্র উপন্যাস।ধারাবাহিকভাবে পড়ছি।বেশ ভাল লিখছেন।
পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম ।অনেক ধন্যবাদ এবং শুভকামনা।
প্রিয় আরজু…নিয়মিত পাচ্ছি…ভালো লাগছে…অনেক ধন্যবাদ…
ভাল লাগল উপন্যাসেরএ পর্বটি । পরবর্তী পর্বের আশায় রই লাম । শুভ কামনা ।
রহমান ভাই…অনেক ধন্যবাদ…সাথে থাকবেন প্লিজ….