প্রাণরে প্রিয়তমা(র্পব-৮)
এই লেখাটি ইতিমধ্যে 1193বার পড়া হয়েছে।
(পূর্বে প্রকাশের পর)
মনির খান একটা খাসী কোরবানী করলেন। খাসী পাক করার জন্যে সব দায়িত্ব পড়ল সোনিয়ার হাতে। আর বুয়া শুধু ওকে সহযোগিতা করবে। বিকেলে মাংস রান্না শেষ হলে সোনিয়া রূপচর্চা শুরু করে। রূপচর্চা শেষে ছোট টিফিন বক্সে মাংস ভরলো। তারপর বুয়াকে বলল, দিদি আমি বাইরে যাচ্ছি। বাবা জিজ্ঞেস করলে বলবেন, বান্ধবীর বাসা গেছি।
বুয়া বলল, আচ্ছা।
সোনিয়া সাকিবের জন্য একাটা পাঞ্জাবী ও মাংস নিয়ে তার বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হল।
সাকিব ঈদ উপলক্ষে গতকাল মার্কেট থেকে সোনিয়ার জন্য একটা আকাশী রঙের শাড়ী কিনেছে। আজ এটি তাকে দিবে। সাকিব তার হাত দুটি মাথার পিছনে রেখে খাটের উপর শুয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে। কখন আসবে সোনিয়া সে অপেক্ষায় আছে। এইতো সোনিয়া এসে উপস্থিত হলো। সোনিয়া ঘরে ঢুকতেই সাকিব বিছানা থেকে উঠে বসল। আজ সোনিয়াকে অন্যান্য দিনের চেয়ে অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে। পারফিউমের গন্ধে সারা ঘর মাতোয়ারা হয়ে গেছে। অপলক দৃষ্টিতে সাকিব তার দিকে চেয়ে আছে। কিছুই বলছে না। একি সোনিয়া নাকি স্বর্গের হুর নেমে আসছে তা ভাবতে পারছে না সে।
সাকীবের নীরবতা দেখে সোনিয়া বলল, কি দেখছ এমন করে?
তোমার রূপ মাধুর্যকে। তুমি কত সুন্দর ! যেন হীরের টুকরো?
তুমি আর আমাকে দেখনি?
হ্যাঁ দেখেছি, কিন্তু আজকের মত এত সুন্দর দেখিনি। জান, বেহেশতের হুরকে যদি প্রশ্ন করি আমার সোনিয়া কেমন সুন্দর?
হুর বলবে, তুমি বেহেশতে এসে তোমার সোনিয়াকে আমার পাশে দাঁড় করিয়ে দেখে নাও, যে তোমার সোনিয়া আমার চেয়ে সুন্দর।
সাকিবের এ কথা শুনে একটা অদ্ভুদ হাসির রেখা ফুটে উঠল সোনিয়ার ঠোঁটের কোনায়।
হয়েছে বাবা আর প্রশংসা করতে হবে না। একথা বলেই সোনিয়া পাঞ্জাবীর প্যাকেটটা খাটের এক কোনায় রেখে টিফিন বক্সটি ওর সামনে ধরে বলল, এই হচ্ছে আমাদের খাসীর মাংস। কথাটা বলতে বলতে টিফিন বক্সটি খুলল। পরে আবার বলল, আগে খেয়ে নাও তারপর কথা বলবো।
সোনিয়া ভাত এনে খাবার মেখে তার মুখে মাংস তুলে দেয়। এভাবে খাবার শেষ হল। এবার সোনিয়া পাঞ্জাবীর প্যাকেটটা ছিড়ে পাঞ্জাবীটা বের করে ওর সামনে ধরল। এই নাও তোমার ঈদ উপহার।
সাকিব বলল, আরে এ আবার কেন আনতে গেলে?
সোনিয়া মাথা ঝাকি দিয়ে বলল, উহু কোন কথা নেই। ঝটপট পড়ে ফেল। দেখি তোমাকে কেমন দেখাচ্ছে।
সাকিব পাঞ্জাবীটা পড়তেই সোনিয়া টিটকারী করে বলল, বাহ! খুব সুন্দর লাগছে। একেবারে জামাই। কি নতুন জামাই কনে কোথায়?
সাকিব মুচকি হেসে বলল, কনেতো আমার পাশেই আছে।
আমিতো সোনিয়া
এখনই কনেকে দেখাচ্ছি। বলেই টাঙ থেকে সোনিয়ার জন্য আনা শাড়ীটা বের করল সাকিব। সোনিয়ার সামনে ধরে বলল, এই নাও আমার পক্ষ থেকে ঈদ উপহার। জলদি করে শাড়ীটা পড়ে কনে সাজ। এখনই তোমাকে বিয়ে করে কনে বানাচ্ছি।
শাড়ীটা দেখে সোনিয়া বলল, ওয়াও! এত সুন্দর শাড়ী। সত্যিই তোমার প্রশংসার করতে হয়। তোমার পছন্দ যে আমার পছন্দের সাথে হুবহুব মিল তা আগে জানতাম না। সত্যি তোমার মত প্রেমিক পেয়ে আমি খুব ভাগ্যবতী। এসব বলতে বলতে সোনিয়া ওলট পালট করে শাড়ীটা দেখছে।
চেয়ে চেয়ে কী দেখছ? তাড়াতাড়ি পড়ে নাও।
সোনিয়া লজ্জা মিশ্রিত কন্ঠে বলল, এই তুমি কি বোকা হয়েছ যে তোমার সামনে শাড়ী পড়ব? আমার বুজি লজ্জা করে না। আসলে তুমি কিচ্ছু বুঝনা।
সরি। বলে সাকিব কিছুক্ষণের জন্য বাইরে বের হল। কিছুক্ষণ পর ঘরে এসে দেখে সোনিয়া বউ ঘোমটা দিয়ে বসে আছে। সাকিব ঘোমটাটা টেনে বলল, কিগো কনে তোমার বিয়ে হল কোন খানে? তোমার স্বামীর নাম কি?
সাকিবের রশিকতা শুনে সোনিয়া লজ্জায় লাল হয়ে গেল।
কি ব্যাপার কথা বলছনা কেন? ও আচ্ছা লজ্জা পেয়েছ বুঝি, তাই না। দেখি দেখি বলে তার ডান হাতটা বের করে বলল, হাতে যে মেহেদীর দাগ নেই।
সোনিয়া লাজ রক্তিম মুখে মুচকি হাসল।
সাকিব এবার শাড়ীর আঁচলটা মাথা থেকে নামিয়ে বলল, দেখি দেখি, এদিকে আস তোমর রাঙা ঠোঁটে একখানা ঈদের স্মৃতি এঁকে দেই। বলেই ওকে ঝাপটে ধরে ঈদের স্মৃতি স্বরূপ একটি চুমো দিল।
দু’জনের প্রেমালাপ অবিরাম বর্ষিত হচ্ছে আষাঢ় মাসের মূষল ধারে বৃষ্টির মত। আর এদিক দিয়ে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা প্রায় নিকটবর্তী। মনির খান বাসায় বসে আছেন। কি জানি মনে করে সোনিয়াকে ডাকছে। সোনিয়া …
বুয়া ডাক শুনে দ্রুত ছুটে আসল। মনির খান বলল, সোনিয়া কোথায়?
ওনি ওনার বান্ধীর বাসায় গেছে। কিছু দরকার লাগবে সাহেব?
হ্যাঁ।
এক কাপ চা এনে দাও।
সন্ধ্যা লগ্নে সোনিয়া বাড়ী ফিরল।
রাত আনুমানিক বারোটা বাজে। মনির খান ইতোমধ্যে ঘুমিয়ে আছেন। সোনিয়ার চোখে ঘুম নেই। মনটা ছটফট করছে। ইচ্ছে হল বাইরে বের হতে। রুম হতে বারান্দায় আসতেই দেখে বুয়া বারান্দায় বসে আছে। চোখে পানি। সোনিয়াকে দেখে বুয়া চোখের পানি আঁচল দিয়ে মুছে ফেলল। সোনিয়া বুয়ার দিকে এগিয়ে গেল। আচ্ছা দিদি ঘুমান্নি? আর এখানে বসেই বা কাঁদছেন কেন?
বুয়া বলল, ঘুম আসছে না তাই।
আরো অনেক দিন দেখিছি আপনাকে এভাবে কাঁদতে? এর কারণ কি বলবেন?
কেরে কাঁদছি তা কি শুনবেন।
হ্যাঁ। কেন শুনবো না। আজ আমি আপনার কান্নার রহস্য জানতে চাই।
সে এক বিরাট কাহিনী।
সংক্ষেপে বলেন।
বুয়া তার জীবনের ইতিহাস বলতে লাগল সোনিয়া তার পাশে বসে মনোযোগ দিয়ে শুনছে।
আজ থেকে ৩০ বছর আগের কথা। আমি তখন যুবতী। আপনার এহন যেই বয়সটা তহন আমার এই বয়সটা ছিল। তহন আমার লগে আমাগ গ্রামের একটি পুলার সাথে প্রেরেম হয়। হের নাম ছিল হাসু। সব পোলামাইয়ারা জন্মের সময় কাঁন্দে। হে নাকি জন্মের সময় খুব হাসছিল, এললেগি এর মা এর নাম রাখছিল হাসু। আমাগর প্রেরেম যহন হয়ে যায় তখন বাড়ীর হগলতে জাইন্না ফেলে। আমার মা হাসুকে খুব পছন্দ করতো। তাই আমাগ প্রেরেমে মা কোন বাঁধা দিত না। একদিন মা হাসুদের বাড়ীতে আমার বিয়ার প্ররস্তাব নিয়ে যায়। প্ররথম হাসুর মা-বাপ রাজি হইছিল না। পরে রাজি হয়ে গেছে।
এতটুকু বলেই বুয়া থামল।
সোনিয়া আরো জানার জন্য বলল, তারপর।
আবার বুয়া বলতে লাগল।
তারপর বিয়া হল। বাসর রাতে আমি যহন ঘুমডা দিয়ে বসে আছি তখন হাসু আমার কাছে আহে। সে তহন আমার ঘুমডা ফালাইয়া বলে, এভাবে ঘুমডা দিয়া আছ ক্যান? মনে হয় আর দেহনি। আমারে দেখে কি তোমার শরম করছে।
আমি তহন বললাম, কি যেন কন শরম কিহের।
কতক্ষণ চুপ থাকার পর হাসু বলল, এই আমারে ফালাইয়া যাইবা নাতো?
নাহ। তোমারে ছাইড়া কোত্তাও যাব না।
তারপর আরো কিছুক্ষণ কথাবর্তা হয়। পরে আমডা দু’জন দু’জনকে ঝাপটে ধরে শুয়ে পড়লাম।
এইটুকু বলেই বুয়া বলল, আর কইতে পারুম না। আমার খুব শরম করছে।
না দিদি আজ আমি আপনার পুরো কাহিনীটা শুনব।
আইচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে হুনেন।
কিছু দিন পর আসল ঈদ। ঈদের আগে হাসু আমার জন্যে একটা লিপিস্টিক আনল। আমার হাতে দিয়া কইল, এই হচ্ছে তোমার ঈদের উপহার। আর অহন তোমার ঠোঁটে লিপিস্টিক মেখে আমার গালে একটা চুমা দিবা। তহন আমার গালে দাগ বসবে। ফলে আর কেউ আমার দিকে নজর দিতে পারবেনা।
আমিতো তহন শরমে মরি। কি করুম সোয়ামীর কথা কি অমান্য করা যায়। তাই ওরে তহন আমি চুমা দেই।
এর কিছুদিন পর হের হয় ডাইরীয়া। এই ডাইরীয়াই আমার হাসুরে পর পারে নিয়া যায়। আমি তহন হের লাশের উপর পইড়া কাঁনতে থাহি। এমন সময় আমার হরি আইসা আমারে কই, আহহারে কি রসের কান্না কানতাছে। এই হতভাগিনী আমার পুলাডারে খাইছে। পোড়া কপালী ভাগ আমার বাড়ী থেকে। আমি তহন যাইতে চাইলাম না। তখন আমার হওর হরী জোর কইরা আমারে গলা ধক্কা দিয়া ঘর থেকে বের কইরা দেয়। আর তখন আবার বলে, আজকে আমার পুলারে খাইছস পরে আবার আমডার মাথা খাইবি।
একথা গুলো বলেই বুয়া কাঁদতে লাগল।
সোনিয়া বলল, তারা আপনাকে এত অত্যাচার করছে? তারা কী মানুষ ছিল না কী পশু? আচ্ছা দিদি এর পর কি হয়েছিল শুনি।
বুয়া আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বলল, তারপর থেকে বিশ বছর মানুষের বাড়ীতে কাজ করি। বাপের বাড়ীতেও যাইনি। পরে আপনার বাপ আপনাদের এনে আনে। জানি না আর কয় দিন থাকতে হবে।
সোনিয়া এবার বলল, আপনি কী আর বিয়ে করেন নাই?
না। আমার বাপ-মাই আমারে বিয়া দিবার অনেক চেরেস্ট্রা করছে কিন্তু সব চেরেস্ট্রাই বাদ হইছে।
কেন বিয়ে করেনি?
আমি জানি মাইয়া মাইনসের বিয়া একবারই হয়। তাই এইডাকে আমি ভাগ্য বলে মেনে নিলাম। আর আমি হাসুকে খুব বেশি ভালবাসতাম তাই আর কারোর সাথে বিয়া বইতে পারি নাই।
এতটুকু বলে বুয়া বলল, চলেন আজকে আর না। আর একদিন বলাম। এহন মেলা রাইত হইছে। এখন শোওন গিয়ে।
চলবে…
প্রাণের প্রিয়তমা(পর্ব-১)পড়ুন।
প্রাণের প্রিয়তমা(পর্ব-২)পড়ুন।
প্রাণের প্রিয়তমা(পর্ব-৩)পড়ুন।
প্রাণের প্রিয়তমা(পর্ব-৪)পড়ুন।
প্রাণের প্রিয়তমা(পর্ব-৫)পড়ুন।
প্রাণের প্রিয়তমা(পর্ব-৬)পড়ুন।
প্রাণের প্রিয়তমা(পর্ব-৭)পড়ুন।
১,৩১০ বার পড়া হয়েছে
ভাল লাগল।
ধন্যবাদ।
ভাল লাগল।
ভাল লাগল বলে মন্তব্য শেষ না করে একটু বিস্তারিত বলুন। খুশী হব।
গল্পটা খুব ভাল হয়েছে।
আরিফ ভাই আমার মনে হয় আপনি আমার পুরো উপন্যাসটি পড়েছেন।
সুন্দর লিখেছেন তো !
অসংখ্য অসংখ্য ভাল লাগা জানিয়ে দিলাম ।
ধন্যবাদ নিবেন।