বৃষ্টি দিনের স্মৃতিচারণ………
এই লেখাটি ইতিমধ্যে 1774বার পড়া হয়েছে।
কি দিয়ে শুরু করবো বুঝতেছিনা। লিখতে যখন বসছি তখন অনেক কথাই মনে আসতেছিল কিন্তু সব লিখতে গেলে লেখা অনেক বড় হয়ে যাবে। জীবনের বেশীর ভাগ সময়ই গ্রামেই কাটিয়েছি যেহেতু সেহেতু বৃষ্টিও বেশী পেয়েছি সেখানেই।
যাইহোক লেখা শুরু করার পর দেখি লেখা লম্বা হয়ে যাবে। যতটুকু ছোট করতে পেরেছি ততটুকু লিখেছি। প্লিজ কেউ গালমন্দ করবেন না যেন।
বৃষ্টির কথা আসলেই মনটা অন্যরকম হয়ে যায় । কারণ বৃষ্টি আমি খুব ভালবাসি। ছোটবেলা থেকেই বৃষ্টি আমার প্রিয়। সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজলেও আল্লাহর রহমতে ঠান্ডা অথবা জ্বর আসে নাকখনো।
আমি গ্রামের বাড়িতেই বড় হয়েছি। সেখানেই পড়াশুনা করেছি ডিগ্রি পর্যন্ত। আমার শৈশব কৈশোর বড়বেলা সবই গ্রামে কেটেছে। চাকুরী সুবাদে ঢাকা আগমণ প্রায় তের বছর। বৃষ্টির দিনগুলো ব্ড্ড মিস হয় শহরের পরিবেশে। স্মৃতির পাতা হাতড়ে বেড়াই বৃষ্টি দিনের সময়গুলোতে।
ছোটবেলা স্কুল থেকে ফেরার পথে বৃষ্টি হলে সে কি অবস্থা! তখনকার দিনে এখনকার মতো বইয়ের ব্যাগ ছিল না। বই বগলদাবা করেই স্কুলে যেতাম। ছুটির সময় বৃষ্টি আসলে বাড়ি ফেরার পথে সব বই ভিজে একাকার হয়ে যেতো। বই ভেজার ভয়ে কখনো বৃষ্টিতে ভেজা মিস করতাম না বা কখনো কারো বাড়িতেও গিয়ে উঠতাম না।কোনরকম কচুপাতা বা অন্য কাগজ থাকলে বই পেঁচিয়ে বাড়ি ফিরে আসতাম দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে। বাড়িতে আসলেই আম্মা হাত থেকে বই নিয়ে একটা একটা করে লাকড়ির চুলায় শুকাতেন । বই হয়ে উঠতো হলদেটে মচমচে। কখনো আম্মা সাথে পলিথিন দিয়ে দিতেন। তখন আর বই ভিজত না। দলবেঁধে স্কুল থেকে ফিরতাম বাড়ির পথে। এখন তো স্কুলের অভাব নেই। সে সময়ে আমাদের প্রাইমারী স্কুল ছিল প্রায় দেড় কিলো দুরে। তিনচার গ্রাম মিলে একটাই স্কুল।
বাড়িতে ফিরেই ঝুম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে নেমে পড়তাম ভরা পুকুরে। ডুব দিয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনতাম ঝুপুর ঝাপুর। অন্তত ৫০/৬০টা ডুব তো দিতামই।
প্রতিদিন বৃষ্টি হলে প্রতিদিনই ভিজতাম। মিস হতো না কোনদিন। মাঝে মাঝে মজা লাগতো সবাই একসাথে ভিজার সময় কেউ কেউ পা পিছলে ধপাস করে পড়ে যেত মাঝ উঠানে। কার পেটে কত হাসি। অনেক সময় অনেক বড় ব্যথাও পেত কেউ। আল্লাহর রহমতে আমি কখনো বড় ব্যথা পাইনি। কারণ আমি আংগুল টিপে টিপে হাটতাম।
১৯৮৮ আর ৯৬ এ হয়েছিল বন্যা। উফ কি যে মজার দিন ছিল সেই সময়। লিখতে গেলে বড় হয়ে যাবে। হঠাৎ একদিন ভোরে আম্মার ডাকে ঘুম ভাঙ্গে। আম্মা বলেন দেখ চারিদিকে পানি থই থই করতেছে মনে হয় বন্যা হইছে। নদী ভাঙ্গতে কোনদিকে। আম্মার কথায় লাফ দিয়ে উঠে দেখি এলাহি কান্ড শুধু আমাদের বাড়িটি ভাসতেছে চারিদিকে পানি সাদা থই থই। হাজার হাজার বক যেন উড়ছে পানি মাঠজুড়ে। আমাকে আর পায় কে। পানি নেমে গেছি অলরেডি। হইহই রব চারিদিকে। গ্রামের মানুষ মাছ ধরায় ব্যস্ত। বিভিন্ন রকমের জাল ফেলে মাছ ধরতেছে। আমরা সবাই মিলে কলাগাছ দিয়ে ভেলা বানিয়ে তার উপর চড়ে পুরো ধানের মাঠ চষে বেড়ালাম আহারে কি যে মজার দিন ছিল। পানির কোথাও কোথাও পিঁপড়ার ঢোল, কোথায় একটু জায়গা পেয়ে সাপ কুন্ডলি পাকিয়ে বসে আছে। কোথাও শালিক পাখি ডানা ভেংগে মাটিতে পড়ে আছে। বন্যা যে এত মজা যে কেউ না দেখলে বা উপভোগ করলে বুঝবে না । তবে নিচু এলাকার মানুষের ঘরবাড়ি পানিতে ডুবে যাওয়ায় বেশী কষ্ট লাগছিল। অনেকেই আমাদের বাড়িতে উঠে এসেছিল। যেমন আনন্দ তেমন কষ্ট পোহাতে হয়েছে গরীবদের। সুন্দর মুহুর্তগুলো বুঝি আর ফিরে আসবে না sad । বিকেল বেলা আস্তে আস্তে পানি নামা শুরু করেছে তখন আমরা ঘরে ফিরে আসি। সারাটি দিনই ছিল আনন্দের। পানিতে ভেসে বেড়ানোর খেলা।
বৃষ্টির দিনগুলোর স্মৃতি অনেক। বললেও শেষ হবে না। রাতে বৃষ্টি নামলে ভেজা হতো না কিন্তু মাছ ধরার একটা সুযোগ পেয়ে যেতাম। ভাইবোনের মিলে ছাতা মাথায় চলে যেতাম পুকুরে। পুকুরের সাথে সংযোগ নালা ছেড়ে দিলেই মাছ উজানে উঠে পড়তো । বিশেষ করে টাকি, কই, পুটি, মাগুর এগুলো বেশী ধরা পড়তো। ছাতায় কি আর কাজ হয় । ভিজে একাকার হয়ে সবাই মিলে মাছ ধরতাম। শেষে নালায় বাঁশের তৈরী একটা মাছের ফাঁদ পেতে আসতাম। সকাল হলেই ছুটে যেতাম ফাঁদ উঠাতে। কিন্তু মাছের চেয়ে সাপই বেশী ধরা পড়তো। ডোরা সাপ, যে সাপ কামড়ায় না। অনেক ওজন হয়ে যেতো ফাঁদটি। শেষে উঠোনে এনে ছেড়ে দিতাম মুখ। আর এঁকেবেঁকে সাপের চলে যেতো তাদের বাসস্থানে।
একবার রাতে ভাইবোনের মিলে গেছি মাছ ধরতে । আমাদের সাথে ছিল খালাতো বোন। মাছ ধরা শেষে যখন পুকুরে হাত পা ধুতে সবাই চলে আসি । তখনই হঠাৎ করে খালাতো বোন চিৎকার শুরু করছে হাউ মাউ করে কিন্তু কি হয়েছে সেটা না বলে সে চোখ বন্ধ করে চিৎকার শুরু করছে। তার চিৎকার শুনে আমি আর আমার বোন সবাই একদুরে তারে রেখে চলে আসি একটু দুরে। আমিও প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলাম। তখন ভাইয়েরা এগিয়ে এসে বলে কি হয়েছে আগে তো বল? তখন সে চোখ বন্ধ অবস্থায় তার উপরে তুলে ধরে। ওমা লকলক করছে জুঁক একটা। জুঁক টেনে ফেলা দেয়া হলে সে বলে তোমরা আমারে রাইখ্যা চইল্যা আসছো ছি ছি। তোমরা না বোন। আমাদের মুখে কথা ছিল না। বিপদেই বন্ধুর পরিচয় হাহাহা ।
প্রায় বৃষ্টির দিনেই দিনের বেলা চলতো চালভাজা, চিড়াভাজা পেয়াজ কাঁচামরিচ দিয়ে মাখিয়ে সবে এক সঙ্গে বসে খেতাম। কখনো চালভাজা গুঁড়ো করে ঝাল করে খেতাম । আমরা বলি ঝালের গুঁড়া। এটা তৈরী করতে চ্যাপা শুটকিও লাগে। হবিগঞ্জের লোকেরা বললেই চিনবে। কখনো আম্মা খিচুড়ি বানাতো। কিছু না থাকলেও চা আড্ডা চলতো একসঙ্গে মিলেমিশে। মাঝে মাঝে ফুল ভলিয়মে চলো গান। গলায় গলা মিলিয়ে সকলে মিলে গাইতাম বর্ষার গান।
বৃষ্টির দিনে সবচেয়ে বেশী ভয় লাগতো বজ্রপাত। ওরেররররর বাপস আসমানে বিজলী চমকালে কই যে দৌঁড় দিয়া গিয়া লুকাইতাম। মনে মনে লা ইলাহা ইল্লা আন্তা পড়তাম আর কানে হাত দিয়ে রাখতাম । তবে আম্মা কাছে থাকলে সবগুলান্তে আম্মারে জড়াইয়া ধরতাম। আহারে আর এখন আমার বাচ্চাদের জড়াইয়া ধরি। আমার দুই ছেলে তা-সীন+তা-মীম । এই দুইটায়ও বজ্রপাত ভীষন ভয় পায়। রাতে বজ্রপাত হলে ভয়ে ঘুমাতে পারে না। শহরের তুলনায় গ্রামে বৃষ্টিপাত আর ঝড় বেশী হয়। ঝড়ের দিনগুলা আরো মারাত্মক। মাঝরাতে হঠাৎ বাতাসের শো শো শব্দ শুনে আর ঘুমাতে পারতাম না। আম্মা আব্বার ঘুম ভাঙ্গতো না। কিন্তু আমার জ্বালায় আম্মা উঠে পড়তো এবং সবাইকে জড়িয়ে ধরে বসে বসে আল্লাহর নাম নিতাম। মাঝে প্রকট শব্দ শুনে ভয়ে কুঁকড়ে যেতাম। কোথায় জানি কোন গাছ ভেঙ্গে পড়লো। ঝড় থামলেই সাথে সাথে হারিকেন হাতে নিয়ে বের হয়ে যেতাম আম কুঁড়াবার জন্য। গাছের নিচে গিয়ে চোখ ছানাবড়া। ইয়া বড় বড় কাঁচা আম গাছের নিচে পড়ে আছে। এত আম কি আর বলম । খাঁচা ভর্তি আম কুঁড়ায়ে ঘরে নিয়ে আসতাম। তারপর আবার শুকনা ডালও কুঁড়াতে হতো কারণ লাকড়ির কাজের জন্য । যদি ঝড়ের পরে না বেড়ুতাম তাহলে আর আম পাওয়াই যেতনা আর। সকালে উঠে উঠান জুড়ে কাঁচা পাতা লাল পাত এলোমেলো ছড়ানো ছিটানো থাকতো। সেগুলো ছিল ঝড়ের তান্ডব। শহরে তো তেমন ঝড়ই হয় না ইদানিং।
আসলে বৃষ্টির দিনগুলোর কথা বলতে থাকলে শেষ হবে না বলা। পাতার পাতা লিখে গেলেও না। প্রায় তের বছর বৃষ্টিতে ভিজি না লজ্জায় sad । কে কি মনে করে সেজন্য আর বৃষ্টিতে নামা হয় না। কর্মব্যস্ততার মাঝে কখন বৃষ্টি নামে কখন থেমে যায় ঠেরই পাই না।
তবে অফিস ফেরার পথে যদি বৃষ্টি নামে তাহলে মিস নাই। অন্তত বাসে উঠা পর্যন্ত ভিজতে থাকি। অফিসের সবাই বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করে। কিন্তু আমি সবাই ডিঙ্গিয়ে একাই বৃষ্টিতে নেমে যাই। কে কি মনে করলো সেটা আর পিছু ফিরে দেখি না। ভিজে জবুথবু হয়ে বাসে যাইয়া বসি। এইতো এবার বর্ষার মৌসুমে দুইদিন অফিসে আসার সময় ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল। দুইদিনই ভিজে আসছি এবং উপভোগ করেছি আশেপাশের পরিবেশ। রাস্তায় যে জায়গাতে একটু মাথা গুঁজার ঠাঁই আছে সেখানেই ছোট খাটো মানুষের জটলা। কেউবা রিক্সায় হুড তুলে পলিথিনে মুড়িয়ে বসে থাকে শুধু চোখ দুটো দেখা যায়। কিছু দুরন্তপনা ছেলে মেয়েরা রিক্সাতেই বৃষ্টি ভিজে মজা নিচ্ছে। রঙ বেরঙ্গের ছাতাগুলো বেশী মন কাড়ে আমার কিন্তু মাঝে মাঝে হাসি পায় যখন ছাতা উল্টে যায়। বেশীর ভাগ ছাতাই একটা দুইটা শিক ভাঙ্গা হাহা। তবে ক্যামেরা ভিজের যাওয়ার ভয়ে ছবি তোলা হয়নি।
আমার দুইটা ছেলেই বৃষ্টিতে ভিজার জন্য পাগল। কিন্তু ঠান্ডা লেগে যাওয়ার ভয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে পারেনা। আমার জেরীটা ঠান্ডা পান্ডা বুঝে না । সে কান্নাকাটি শুরু করে দেয় বৃষ্টিতে ভিজবে বলে। উপায়ন্তর না দেখে অগত্যা তাকে নিয়ে বৃষ্টিতে যেতেই হয়। তাদের বাবার অনুমতি নাই তাই ছাতা নিয়ে যাই, বাইরে গিয়েই ছাতা বন্ধ করে মা ছেলে ভিজতে থাকি মনের আনন্দে। আল্লাহর রহমতে এখনো বৃষ্টিতে ভিজে ছেলের ঠান্ডা লাগেনি।
লেখা অনেক বড় হয়ে গেল সরি। কিন্তু স্মৃতিচারণ করতে গেলে অনেক কথা অটোমেটিক এসে যায়। বড় হবার ভয়ে অনেক কিছুই বাদ দিয়ে দিয়েছি।
বৃষ্টির দিন আসলেই যে গানটা বেশী শুনা হয় তা হলো আজি ঝরো ঝরো মুখরও বাদরও দিনে জানিনে জানিনে কিছুতে কেন যে মনো লাগে না।
১,৭২৫ বার পড়া হয়েছে
কম বেশী সবার জীবনে এই স্মৃতিগুলো একটা সময়ে খুব বেশী করে মনে পড়ে…ফিরে গেলাম সেই অতীতে..স্মৃতিগুলো হাতড়ে ফিরলাম..অনেক শুভকামনা…
সুন্দর মন্তব্যের জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ
ইস কী মধুর ছিল সে সব দিনগুলো!!!বড্ড মিস করি এখন।।
আসলেই অনেক মিস করি। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
বর্ষাতে গ্রামের বাড়ি থাকলে খুব মজা হয়। টিনের চালে ঝম ঝম বৃষ্টি আর ভুনা খুচুড়ি অসাধারণ।
সাথে চালভাজা চিড়ে ভাজাও দারুন। অনেক ধন্যবাদ।