সেক্সুয়ালএনটাইট্লমেন্ট!
এই লেখাটি ইতিমধ্যে 1418বার পড়া হয়েছে।
পিতৃতন্ত্র পুরুষকে শিখিয়েছে সব বিষয়ে আপন চাহিদা পূরণে তার পৌরুষগত অধিকার প্রয়োগের বিষয়টি। এমন কি, যৌনতাও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। গবেষণার মাধ্যমে এই একতরফা পুরুষতন্ত্রীয় আগ্রাসনের তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘের একটি সমীক্ষা সমপ্রতি সম্পন্ন হয়েছে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার ছয়টি দেশে: বাংলাদেশ যার একটি। অন্য পাঁচটি দেশ: শ্রীলঙ্কা, পাপুয়া নিউ গিনি, কম্বোডিয়া, চীন ও ইন্দোনেশিয়া। ১০ হাজার পুরুষের অভিমত নিয়ে সম্পন্ন এই সমীক্ষার ফল বলছে, তাদের সিকি ভাগ পুরুষ এক বা একাধিক নারীকে ধর্ষণ করেছে। যারা ধর্ষণ করেছে, তাদের অর্ধেক পুরুষ মনে করে, আপন যৌন কামনা পূরণের জন্য একটি মেয়েকে ব্যবহার করার অধিকার তার ‘স্বত্বাধিকার’ বা ‘সেক্সুয়াল এনটাইট্লমেন্ট’! পরিসংখ্যানগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সংশয় স্বাভাবিক। কিন্তু স্বত্বাধিকারের ধারণাটি তাৎপর্যপূর্ণ। এই ধারণার মর্ম বুঝতে পারলে ধর্ষণের প্রাদুর্ভাব এক ভিন্ন মাত্রা পায়। যে পুরুষ মনে করে, নারীর ওপর তার যৌন-স্বত্ব আছে, নারীকে সে প্রকৃতপক্ষে আপন সম্পত্তি হিসেবে দেখে থাকে। নিজের সম্পত্তি ভোগ করার সময় কেউ সম্পত্তির অনুমতি গ্রহণ করে না। অনুমতি নেয়ার প্রয়োজনই যদি না থাকে, তবে ধর্ষণের কথা ওঠে কিভাবে? এই হলো গবেষণায় মতামত প্রদানকারী পুরুষদের সোজা যুক্তি। এই ধারণায় পিতৃতন্ত্রের উগ্র প্রকাশ স্পষ্ট। জাতিসংঘ পরিচালিত এই সমীক্ষা হতে আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ হিসাব পাওয়া গেছে। অন্তত অর্ধেক ধর্ষণ হয়ে থাকে, যখন ছেলেটি প্রাপ্তবয়স্ক নয়, এমন অবস্থায়। এর একটি কারণ অনুমেয়। মেয়েদের ওপর স্বত্বাধিকারের ধারণাটি পুরুষ তার বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই, বড় হওয়ার প্রক্রিয়াতেই আত্মস্থ করে নেয়। অর্থাৎ সেই পুরুষ বড় হয়, নারীর ওপর নির্যাতন ও ভোগ-দখলকে একটি স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে গণ্য করে, যা তাকে শিক্ষা দেয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোজাত ব্যবস্থা। পরবর্তী জীবনেও এই ধারণাই তাকে চালনা করে। বস্তুত, শিশুবয়স হতে পুরুষ এই ধারণা নিয়েই বড় হয় যে, বাড়ির ছোট ছোট দাবি-দাওয়া হতে শুরু করে বৃহৎ বিশ্বের যে কোন কিছুতেই তার অধিকার প্রশ্নাতীত। সে শিখে নেয় যে, কোন কিছুর সাপেক্ষে পুরুষ নয়, বরং পুরুষের প্রয়োজন সাপেক্ষে সমস্ত নিয়ম ও আচরণবিধি। পিতৃতন্ত্র মেয়েদেরও শিক্ষা দেয় যে, পুরুষ মুখ্য, নারী গৌণ। নারী প্রচলিত মূল্যবোধ ও সমাজব্যবস্থা থেকে জানতে পারে যে, তার জীবন-যাপন পুরুষের সাপেক্ষে। পুরুষ যেমনটি চায়, তাকে সেই অনুসারেই জীবন ধারণ করতে হবে। সে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয় যে, তার ওপর পুরুষের স্বত্বাধিকার আছে। আধিপত্যের ধারণা এই ভাবেই নারীমনে প্রোথিত হয় এবং নির্যাতনের বিষয়টি অনেক নারীর কাছেও স্বাভাবিক ঘটনা বলেই চিহ্নিত ও প্রতীয়মান হয়। তারা এটাও ভাবতে পারে না যে, ধর্ষণ একপ্রকার যৌন অত্যাচার। বরং তারা সেই সব অত্যাচার সহ্য করে পুরুষকে সুখী ও সন্তুষ্ট করার জন্য। এমন কি, বিশ্বের দেশে দেশে ধর্ষণের সংজ্ঞা ও বিচারিক ব্যবস্থাও এক রকম নয়। ধর্ষণের সংবাদ প্রকাশ, বিচার ও অভিযুক্তের শাস্তিপ্রদানের হার বিভিন্ন বিচার ব্যবস্থায় বিভিন্ন প্রকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিচার পরিসংখ্যান ব্যুরো’র হিসাব অনুসারে সেদেশের ধর্ষিতদের মধ্যে ৯১% মহিলা ও ৯% পুরুষ এবং ৯৯% ক্ষেত্রেই অপরাধী পুরুষ। মহিলাদের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, যারা তাদের ওপর যৌন অত্যাচারের কথা স্বীকার করে, তাদের মাত্র ২ শতাংশ বলে যে তারা কোন অপরিচিত ব্যক্তির দ্বারা ধর্ষিত হয়েছে। পুরুষদের ক্ষেত্রে কারাগারে পুরুষ কর্তৃক পুরুষের ধর্ষণ একটি গুরুতর সমস্যা। একাধিক গবেষণা থেকে জানা যায়, ‘পুরুষ-পুরুষ বন্দি ধর্ষণ’ ধর্ষণের সর্বাধিক পরিচিত একটি ধরন। অথচ এই ধর্ষণের সংবাদই সবচেয়ে কম প্রকাশ্যে আসে। কয়েকটি গবেষণা থেকে আরও জানা যায় যে, এই ধরনের ধর্ষণের সংখ্যা সাধারণ জনসংখ্যায় পুরুষ-নারী ধর্ষণের মাথাপিছু ও আনুমানিক সংখ্যার চেয়েও বেশি। ধর্ষণ ও যৌন ক্রীতদাসত্ব বহুপরিচিত ও বহু-অনুশীলিত অভ্যাস হলেও এটি মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ হিসেবেই গণ্য করা হয়। এ ছাড়াও ধর্ষণ গণহত্যা অপরাধের একটি উপাদান; বিশেষত যখন কোন জাতিগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার উদ্দেশ্য্য নিয়ে ধর্ষণ সংঘটিত হয়। এখানে মনস্তাত্ত্বিকভাবে পুরুষের বিকৃত কাম ও রাজনীতি ও সমাজের প্ররোচনা কাজ করে। যখন পৌরুষে হিংস্রতা অন্তর্লীন হয়, তখন নারীর ওপর নির্বিচারে ধর্ষণ বা অন্য আক্রমণ হয়। তখন এই হিংস্রতার রূপ প্রকট হয়। অন্যান্য সময় তা হয়তো প্রকাশ পায় না। কিন্তু সুপ্তভাবে পুরুষ-আধিপত্যের বিভিন্ন রূপের মধ্যে সেটা নিহিত থাকে, যে আধিপত্যকে সতত স্বাভাবিক ও স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেয়া হয়। বহু পুরুষের ‘যৌন স্বত্বাধিকার’-এর ধারণাটি এরই এক অঙ্গ। হিংস্রতাকে যখন সাদা চোখে দেখা যায় না, তখন তা দ্বিগুণ বিপজ্জনক, কারণ না চিনলে তাকে মেনে নেয়াই স্বাভাবিক, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সম্ভাবনা ক্ষীণ। পৌরুষের এই ধারণাকেই প্রশ্ন করা জরুরি। জরুরি তার পশ্চাদ্বর্তী সামাজিক মানসিকতার পরিবর্তন। পুরুষকে তার আধিপত্যের ও স্বত্বাধিকারের ধারণা হতে সরিয়ে এনে সমাজ যদি মেয়েদের সমানাধিকারকে যথার্থ মর্যাদা দিতে না পারে, তবে নারীর বিরুদ্ধে হিংসার উৎসমুখ বন্ধ হবে না। যদিও সামাজিক গবেষণা ও সমীক্ষার সংখ্যাগত নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে সর্বদাই প্রশ্ন থাকে, কিন্তু সংকেতটি সুস্পষ্ট। জাতিসংঘ পরিচালিত জরিপ দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার নারী ও পুরুষদের এই সতর্ক বার্তাই দিয়েছে।
১,৪৮৭ বার পড়া হয়েছে
চমত্কার লিখেছেন তো !
ভাল লাগা জানিয়ে দিলাম ।
ভাল থাকবেন প্রত্যাশা রইল ।
সমীক্ষাটি সমসাময়িক ও মূল্যবান।লেখার ধারাবাহিকতা স্বচ্ছ লেগেছে।
আপনার লেখাটি ভাল হয়েছে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন।
মূল্যবান পোস্ট। ভাল লাগল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিচার পরিসংখ্যান ব্যুরো’র হিসাব অনুসারে সেদেশের ধর্ষিতদের মধ্যে ৯১% মহিলা ও ৯% পুরুষ এবং ৯৯% ক্ষেত্রেই অপরাধী পুরুষ।
আমরা ধর্ষকদের ঘৃণা করি।