স্মৃতির পাতা থেকে -( পর্ব—–৩৫/১ )
এই লেখাটি ইতিমধ্যে 1502বার পড়া হয়েছে।
ঘটনা স্থল পরিদর্শন করার সাথে সাথেই খবর হয়ে গেল যে , তার বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা রুজ্জু হয়েছে এবং মামলাটি আমি নিজে তদন্ত করছি । দলীয় হুমকীতে তেমন কোন কাজ হবে এমন কোন ভরসাও তাদের ছিল না । প্রথম থানা পর্যায়ের এবং পরে জেলা পর্যায়ের সকল নেতারা এমনকি সরকারী পি,পি, নিজেও তদবীর করতে লেগে গেলেন । তারা সাড়াশী তদবীর শুরু করলেন যাতে মামলাটিতে চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করা হয় । প্রথম অনুরোধ, তার পর অর্থের প্রলোভন এবং সর্ব শেষে সরকারী দলের নেতাদের চাপ প্রয়োগ তদানীন্তন ধর্ম মন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছলো । আমি মাননীয় ধর্ম মন্ত্রীকে বুঝাতে সমর্থ হলাম যে , মামলার ঘটনা সত্য এবং ধর্ষীতা একজন রিক্সা চালকের স্ত্রী । কাজেই তার এই ঘটনায় বিচার পাওয়া উচিৎ । তিনি জানতেন যে, আমি মিথ্যা বলতে অপছন্দ করি । ফলে তিনি এ মামলা সংক্রান্তে দ্বিতীয় বার তদবীর করা বন্ধ করে দেন । নেতাদের তদবীরে আমি মামলাটিতে চূড়ান্ত রিপোর্ট দিতে রাজিও হই । তবে টাকার বিনীময়ে নয়, একটি শর্তের বিনীময়ে । আমি নেতাদের উপর শর্ত আরোপ করি যে, আমি মামলাটিতে চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করতে পারি , সে ক্ষেত্রে গ্রামে একটি উন্মুক্ত বিচার অনুষ্ঠান বসাতে হবে । আসামী সকল লোকের সামনে তার অপরাধ স্বীকার করে রিক্সাওয়ালার স্ত্রীর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে । কিন্তু আমার এই প্রস্তাবে আসামী রাজি হলো না । সে বললো—–
‘ আমার এ অপরাধের জন্য যদি ফাঁসি হয় তো হউক তবু আমি রিক্সাওয়ালার স্ত্রীর নিকট ক্ষমা চাইতে পারবো না । ‘ ফলে আসামী পক্ষ ভিন্ন পথ ধরলো । তারা পরিকল্পনা করলো যে , বাদী পক্ষ যেহেতু অশিক্ষিত , সেহেতু মামলার শুনানী চলা কালে তাদের দ্বারা পি পি সাহেব উলটা পালটা সাক্ষ্য দেওয়ায়ে মামলা নষ্ট করে দিবে । বাদী গরীব হলেও তার বেশ সাহস ছিল এবং মামলাটির প্রতি তার আগ্রহ ছিল । কাজেই সে যথারীতিতে—-আসলে যথারীতিতে নয় উলটো রীতিতে সাক্ষ্য প্রদান করেছে । আমার তখন পটুয়াখালী জেলা হতে চিটাগাং এবং তৎপর ব্রাহ্মন বাড়ীয়া জেলার কসবা থানায় পোষ্টিং হয়ায় আমি সেখানে কর্মরত আছি । একদিন সেই রিক্সাওয়ালার নিকট থেকে একটি চিঠি পেলাম । সে লিখেছে —
‘ স্যার , আমার মামলার সকল সাক্ষ্য দেওয়া শেষ হয়েছে । আপনার সাক্ষীর জন্য দুই তিনবার তারিখ পরেছে । কিন্তু আপনি না আসায় এবার শেষ তারিখ দিয়েছে । পি পি সাহেব বলেছেন এবার আপনি না এলে মামলা শেষ হয়ে যাবে এবং আসামী খালাশ পেয়ে যাবে । তাহলে ওরা আমাকে গ্রামেই থাকতে দিবে না । ‘ আমি রিক্সাওয়ালার চিঠি পেয়ে ব্রাহ্মন বাড়ীয়া থেকে পটুয়াখালী সাক্ষ্য দিতে গেলাম । আমি কোর্টের নিকট পৌঁছেই দেখি বিরুধী পক্ষের ওকিল বেশ খুশী খুশী মুখ নিয়ে কোর্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছে । তার মুখ থেকে যুদ্ধ জয়ের আনন্দের আভা বেড় হচ্ছিল । আমাকে দেখেই বললেন——-
‘ আসেন ও,সি, সাহেব আসেন । সুধু মাত্র আপনার জন্যই কয় তারিখ ধরে আমরা অপেক্ষা করছি সাক্ষীদের জবান বন্দীর সাথে আপনার লিখিত জবান বন্দীর কন্টারডিকশন টুকু নিয়ে নেওয়ার জন্য । ‘ তার উৎসাহ দেখেই আমি বুঝলাম , তারা ঘটনা একটা নিশ্চয়ই ঘটিয়েছে । আমি বাদীকে বললাম ——
কি ব্যাপার, আপনারা সাক্ষ্য দেন নি ? বাদী জানায়——
‘ স্বাক্ষ্য দিয়েছি , কিন্তু আপনি যা লিখেছেন পি পি সাহেব তা বলতে দেন নি । পি পি সাহেব যা যা বলতে বলেছেন তাই বলেছি । ‘ আমি ওকিলের খুশী হয়ার কারণ বুঝতে পারলাম এবং বললাম—–
সর্বনাশ করেছেন । তাহলেতো মামলায় সাজা হবে না । আমি মনে মনে একটু দুঃখিত হলাম । কারণ আমার চাকরী জীবনে গরীব বাদীর মধ্যে এই এক জন কেই যথেষ্ট সাহসী , শক্তিশালী এবং আপোষহীন পেয়েছিলাম । সাধারনতই গরীব লোক গুলো প্রথম প্রথম মামলা করলেও পরে ধনিদের চাপে পরে আপোষ করতে বাধ্য হয় । ফলে গরীবের দায়ের করা মামলার ভবিষ্যৎ সাধারনতই ভাল হয়না । সরকারী পি,পি,র চক্রান্তে মাম্লাটি নষ্ট হওয়ায় এবং গরীব রিক্সাওয়ালা প্রভাবশালীর সাথে নির্ভিকভাবে লড়েও শেষ্টায় হেড়ে যাবে এ কথা ভেবে আমার বেশ খারাপ লাগছিল । কিন্তু তখন আমার পলাশীর প্রান্তরের সিজোদ্দৌলার মত যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালানো ছাড়া আর কোন বিকল্প রাস্তা ছিল না । আমি স্বাক্ষ্য প্রদান করার জন্য কাঠগড়ায় উঠলাম । বিরুধী পক্ষের ওকিল আমাকে তার তৈরী করা ফাঁদে ফেলে তার স্বপক্ষের সকল স্বীকারুক্তি আমার কাছ থেকে নিয়ে নিলেন । কারণ তখন আমার নিজের থেকে কথা বলার কোন সুযোগ ছিল না । সকল প্রশ্নের জবাব সুধু হা বা না দিয়ে দিতে হচ্ছিল । জেরা শেষ হলে ওকিল সাহেব তার সাজেশনে বললেন-
‘ ও,সি, সাহেব,আপনিতো তদবীরের কারনে ভায়াষ্ট হয়ে এই মিথ্যে মামলায় অভিযোগ পত্র দাখিল করেছেন ।’ এই সাজেশন দেওয়াতে আমি যেন হাতে একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম । ভাব্লাম, সিরাজোদ্দৌলার মতো একটা ভাসন দিয়ে দেখা যাক শেষ রক্ষা হয় কিনা । আমি বিজ্ঞ জজ সাহেবকে বললাম ——
মাননীয় আদালত , স্বাক্ষ্য আইনের বিধান মতে কেহ যদি আমাকে চোর বলে তাহলে আমি যে চোর নই , তা প্রমান করার অধিকার আমার জন্মায় । বিরুধী পক্ষের ওকিল সাহেব বললেন — আমি তদবীরের কারণে এই মামলায় একটি মিথ্যা অভিযোগ পত্র দাখিল করেছি । এই সাজেশনে আমাকে যে বাদী পক্ষ্য কোন তদবীর করেনি তা প্রমান করার অধিকার জন্মেছে । মান্নীয় আদালত তদবীর বিষয়ে আমাকে কিছু বলার অনুমতি প্রদান করার অনুরোধ করছি । না হলে এই মামলার অনেক সত্য কথাই আলোর মুখ দেখবে না । বাদী তার মামলার সঠিক বিচার পাবে না । জজ সাহেব আমাকে বলার অনুমতি দিলেন । আমি বলতে শুরু করলাম ।
মাননীয় আদালত—-বিরুধী পক্ষ্যের ওকিল সাহেব এই মাত্র বললেন , মাম্লাটিতে অভিযোগ পত্র দাখিলের জন্য আমাকে তদবীর করা হয়েছে । হ্যা, তদবীর করা হয়েছে এই কথাটা একদম সত্য । আমার সুদীর্ঘ চাকরী জীবনে ওকিল সাহেবদেরকে এত বড় সত্য কথা আর কখন ও বলতে দেখিনি । ওনারা তো সব সময় বলেন ইস্তিরি দিয়ে ভাজ করে রাখা ন্যাপকিনের মতো থরে থরে সাজানো সব মিথ্যে কথা । কাজেই আজকে একটি সত্য কথা বলার জন্য ওকিল সাহেব কে অশেষ ধন্যবাদ । তবে ওকিল সাহেব ছোট্ট একটু মিথ্যে বলেছেন । অবশ্য আমি মিথ্যে বলবোনা , সম্ভবত ওনি ভুলে গিয়ে থাকবেন । কারন এই মামলার তদবীরে যে গ্রুপটি তৎপর ছিল সেই গ্রুপের তিনিও একজন সদস্য ছিলেন । আর সুধু মাত্র ওনি ছিলেন সে কথাই বা বলবো কেন , এই যে আমাদের বিজ্ঞ পিপি সাহেব আদালতে উপস্থিত আছেন তিনিও তো সেই তদবীর কারী দলে উপস্থিত ছিলেন । ওনারা তদবীর কার জন্য করেছেন সেটা বলে দিলেই তো মাননীয় আদালতের পক্ষ্যে সত্য ঘটনা জানা সহজ হয়ে যায় । পি,পি, সাহেব সরকারী পি, পি, হওয়া সত্যেও মামলার সকল স্বাক্ষীদের ভুল শিখিয়ে তাদেরকে সত্য স্বাক্ষ্য প্রদান করতে দেন নি যাতে অপরাধী সাজা না পায় । আজকে ওকিল সাহেব উপস্থাপন করলেন যে, মামলায় তদবীর করা হয়েছে । আমিও বলি তদবীর করা হয়েছে , কিন্তু সে তদবীর এই মামলার পক্ষ্যে অভিযোগ পত্র দাখিলের জন্য নয় ,আসামীকে বাঁচানোর জন্য, মামলায় চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করার জন্য । আসামী বর্তমান সরকারী দলের ইঊনিয়ন যুবদলের সভাপতি । তিনি একজন প্রভাবশালী লোকের সন্তান । তার জন্য তদবীর হবে এ আর নতুন কি? রিক্সাওয়ালার মতো গরীবের জন্য তদবীর করার কোন লোক আল্লাহর দুনিয়ায় আছে বলেতো আমার মনে হয় না । গরীবেরা তো এ দুনিয়ায় বিচার পাবে না । তাদের বিচার তুলে রাখতে হবে পর জনমের জন্য । তথাপী আমাদের ওকিল সাহেবরা যদি এত টুকু সত্য কথা বলতেন তা হলে আমাদের দেশের বিচারের অবস্থা আমূল পরিবর্তন হতো । বিচারের বাণী আর নিভৃতে কাঁদতো না । আমি স্বাক্ষ্য প্রদান করে চলে এলাম। কয়েক মাস পরে সেই রিক্সাওয়ালার নিকট থেকে আর একটি চিঠি পেলাম । চিঠিতে সে জানিয়েছে , জজ সাহেব আমার শেষ মূহূর্তের বক্তব্য বিশ্বাস করেছেন। তাই কোন সাক্ষ্য না থাকা সত্যেও আসামীকে তিন বছরের স্বশ্রম কারা দন্ড দিয়েছেন । তাই বলছিলাম নিজের যদি কোন বিষয়ে দুর্বলতা না থাকে তা হলে প্রতিকোল অবস্থার মোকাবেলা করেওগরীব, দুর্বল লোকদের জন্য কিছু করা যায় ।
১,৪৯০ বার পড়া হয়েছে
যথারীতি ভাল লাগা নিয়ে গেলাম।
শুভেচ্ছা জানবেন –
ভাল লেগেছে শুনে খুশী হলাম । শুভ কামনা । ভাল থাকুন ।
আল্লাহ আপনার মংগল করুন
ভাল লাগল পর্বটি
কষ্ট করে পড়ার জন্য ধন্যবাদ । শুভ কামনা ।
ভালো লাগা জানিয়ে গেলাম
শুভেচ্ছা রইল ………..রইল শুভ কামনা
এতো স্মৃতিকথা লিখেন কিভাবে ? আমি কিন্তু একটু অবাকই হচ্ছি ! একজন মানুষের জীবনের এতো এতো ঘটনা এতো সুন্দর করে উপস্থাপন খুব সহজ কাজ নয় !
এ পর্বেও ভালোলাগা রেখে গেলাম । ভালো থাকবেন ।