Today 10 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

প্রাণের প্রিয়তমা (পর্ব-২)

: | : ১২/০৬/২০১৩

প্রাণের প্রিয়তমা(পর্ব-১)পড়ুন।
(পূর্বে প্রকাশের পর)
আজ থেকে পনের বছর পূর্বে সোনিয়ার মা এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে চলে গেছেন। তখন সোনিয়ার বয়স মাত্র পাঁচ বছর। একদিন মনির খান তার স্ত্রী ও মেয়ে সোনিয়াকে নিয়ে রিক্সা করে বাসায় ফিরছিলেন। এমন সময় বিপরীত দিক হতে একটি বাস এসে রিক্সার উপর তুলে দেয়। সাথে সাথে রিক্সাওয়ালা মারা যান। আর মনির খানের স্ত্রীর ডান পাটা একেবারে ভেঙ্গে যায় ও মাথায় প্রচণ্ড আঘাত লাগে। কিন্তু সোনিয়া ও মনির খানের কিছু হয়নি। সামান্য একটু আঘাত পেল তারা। রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল রাজপথ। মুমূর্ষ অবস্থায় স্ত্রীকে মনির খান হাসপাতালে নিয়ে আসেন। কয়েকদিন হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা করে তার স্ত্রী মারা যান। সোনিয়া তার মায়ের মৃত্যুতে খুবই মর্মাহত হয়। তখন মায়ের লাশের উপর পড়ে সোনিয়া কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে যায়। মনির খান মেয়েকে সান্ত্বনা দেন, কিন্তু কিছুতেই কাজ হয়নি। অবুঝ সোনিয়া মায়ের শোকে তিনদিন পর্যন্ত অনাহারে রইল। দানা পানি কিছুই মুখে দেয়নি।
আজ সোনিয়া পরিপূর্ণ যুবতী কিন্তু যখনই তার মায়ের মৃত্যুর দৃশ্যটি তার চোখের সামনে ভেসে উঠে তখনই সে পাঁচ বছরের ছোট শিশুর মতই ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠে। তার মায়ের মত মাটির মানুষ, এত সরল সোজা রমণী এ সমাজে খুব কমই আছে। ভাল মানুষ দুনিয়াতে বেশি দিন বাঁচে না। তাইতো সোনিয়ার মা অল্প সময়ে এ পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। আর মনির খান তিনি তার স্ত্রী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তার মত এমন নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ পৃথিবীতে খুব কমই আছে। তার কাছে স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা বলতে কিছুই নেই। তিনি চিনেন শুধু টাকা আর নারী। টাকার জন্যে তিনি খুন করতেও দ্বিধাবোধ করেন না। স্ত্রী জীবিত থাকতে তাকে পুরোপুরি ভালোবাসা দিতে পারেননি। নিজ স্ত্রীকে রেখে অন্য নারীকে নিয়ে তিনি আমোদ ফূর্তি করতেন। মাঝে মাঝে মদ্যপান করে বাড়ি ফিরতেন। অকারণে স্ত্রীকে মারধর করতেন। কিন্তু স্বামীর ভয়ে মমতাময়ী স্ত্রী কোন প্রতিবাদ করতে পারতেন না। তবু তাকে মনে প্রাণে ভালোবাসতেন। কারণ তিনি জানতেন স্বামীর পদতলে স্ত্রীর বেহেস্ত। মনির খান এমন স্ত্রীকে হারিয়ে কিছুটা শোকাহত হলেও এখন ভুলেও তার নাম মনে করেন না। অবশ্য এখনও দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। কিন্তু এ বুড়ো বয়সেও তার নারীদেরকে নিয়ে আমোদ ফূর্তি করার পুরানো অভ্যাসটি পরিবর্তন হয়নি। দিন দিন তিনি যেন পশু হয়ে যাচ্ছেন। উপর দিয়ে দেখাচ্ছেন তিনি মেয়েকে ভীষণ ভালোবাসেন বিধায় দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। কিন্তু তলে তলে তিনি টাকার বিনিময়ে সুন্দরী নারীদের দেহভোগ করে যাচ্ছেন। আর বোতলের বোতল মদ কিনে খাচ্ছেন। মেয়ে যে দিন দিন বড় হচ্ছে তার দিকে কোন খেয়াল নেই। আসলে তার ভেতরটা অন্ধকার রাতের মত কালো। তাইতো তিনি দুনিয়ার মোহে অন্ধ হয়ে গেছেন। আখেরাতের কথা ভুলেও মনে করেন না।
নারী লোভী মনির খান আজ বিশাল সম্পত্তির মালিক। ফার্মগেটে তিন তলা বাড়ি করেছেন। অবৈধ পথে টাকা উপার্জন করে আবার অবৈধ পথেই ব্যয় করছেন। মেয়ে সোনিয়া তার বাবার এসব কার্যকলাপ কিছুতেই সহ্য করতে পারছেনা। মাঝে মাঝে পিতার সাথে ঝগড়া করে কোন আত্মীয়ের বাড়িতে চলে যায়। পিতার এসব কু-কর্মের কারণে সে কলেজের বান্ধবীদের সাথে মিশতে পারে না। ছোট বেলায় মাকে হারিয়ে যে কষ্ট তার বুকে পাথর হয়ে চাপা আছে, তাইতো ভুলতে পারছেনা। তার উপর আবার বাবার এহেন কার্যকলাপ। এসব কষ্ট নিয়ে সোনিয়া ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। এসব দুঃখের কথা কারো কাছে লজ্জায় বলতেও পারছে না। অঢেল ধন সম্পত্তির মাঝে থেকেও আজ সোনিয়ার মনে শান্তি নেই। তার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে এই দালান কোঠা ছেড়ে কোথাও চলে যেতে। কিন্তু সে পারে না। কারণ সে তার মায়ের মত হয়েছে। আদর্শ মায়ের আদর্শ মেয়ে কিন্তু বাপটা যে এত খারাপ কি করে হল, তা সে কল্পনা ও করতে পারেনা। মাঝে মাঝে সে খোদার কাছে ফরিয়াদ করে ‘হে খোদা তুমি আমাকে এমন নর পশুর ঔরসে কেন জন্ম দিলে? এর চেয়ে যদি গ্রামের দরিদ্র কৃষকের ঘরেও জন্ম দিতে তাহলেও শত গুণে ভাল হত। কি অপরাধ করেছিলাম আমি যার জন্য এ শাস্তি তুমি আমাকে দিচ্ছ?’ মনির খানের নামটি শুনলেই মুখটি ফিরিয়ে নিতে ইচ্ছে করে সোনিয়ার। কেউ যদি তার কাছে তার বাবার পরিচয় জানতে চায়, তখন সে বলে, আমার বাবা নেই। একই বাসাতে বাপ বেটি থাকে কিন্তু কথাবার্তা খুব কম হয়। পিতা দশটা প্রশ্ন করলে একটা উত্তর দেয়।
বাড়িতে কাজের বুয়া আছে। সে তাদের রান্না বান্নার সব দেখা শুনা করে। সোনিয়া বুয়াকে দিদি বলে ডাকে।
মনির খান বেডরুমে বসে আছেন। রুমের উত্তর পাশে ছোট একটি কাঠের আলমারি। তাতে অনেকগুলো মদের বোতল স্তরে স্তরে সাজানো। যেমনি ভাবে হোমিওপ্যাথিক ডাক্তাররা তাদের দোকান বোতল দিয়ে সাজায়। তবে সবগুলো বোতলে মদ নেই। এর মধ্যে কোনটা খালি আবার কোনটা ভর্তি। পাশে একটি বক্স খাট। তাতে বেডসিট বিছানো। তার উপর দু’টো তুলার বালিশ পড়ে আছে। আরো আছে একটি ২১ ইঞ্চি রঙিন টেলিভিশন। সাথে একটি ভিসিডি সেট। দেয়ালে টাঙ্গানো বিশ্ববিখ্যাত সুন্দরীদের ছবি। রুমের দু’পাশে সাজানো আছে সোফার সেট। তাতে একটি করে ছোট বালিশ। সোফার সামনে একটি টি-টেবিল। ফোরে রেকসিন বিছানো।
মনির খান সোফায় বসে দু’টো সিগারেট টেনেছেন। এখন আরেকটি সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করছেন। এদিকে রাতের আগমনে চারদিক অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। রুমে টিউব লাইট জ্বালানো।
মেয়েকে নিয়ে ভাবছেন মনির খান। সন্ধা হয়ে গেল। এখনও মেয়েটি বাসায় ফেরেনি। কোথায় যায়, কি করে বলেও যায়নি। বুয়াকে কর্কশ স্বরে ডাকলেন, বুয়া।
মনির খানের ডাক শুনে বুয়া দৌঁড়ে আসল। বুয়া ভয়ে ভয়ে বলল, আমাকে ডাকছেন?
হ্যাঁ। তোমাকেই। চোখ উপরে তুলে বলল, সোনিয়া গেছে কোথায়?
আমারে তো কিছু কইয়া যায়নাই সাব। কৈ গেছে তা বলতে পারিনা।
ঠিক আছে যাও। আমি দেখছি।
বুয়া যখন যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন সময় কলিংবেলের আওয়াজ মনির খানের কানে ভেসে আসল। এই তো সোনিয়া এসে গেছে দরজা খুল।
বুয়া দরজা খুলতেই সোনিয়া তার রুমে চলে যাচ্ছে। তাকে দেখে মনির খান যেন এতক্ষণে স্বস্তি ফিরে পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে ডাকলেন, সোনিয়া।
পিতার ডাকে সোনিয়া আচমকা দাঁড়ালো, ফ্যাল ফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
আয় মা। বলেই মনিরখান সিগারেটে টান দিয়ে নাকে মুখে ধোঁয়া বের করে কুণ্ডুলী পাকিয়ে শুন্যে উড়িয়ে দেয়।
সোনিয়া তার বাবার রুমে যেতে ইচ্ছে করছিল না। তবুও গেল। সে তাল গাছের মতো দাঁড়িয়ে মুখটা মলিন করে বলল, কেন ডেকেছ?
মনির খান সামনে সোফা দেখিয়ে বলল, বস্ মা। সোনিয়া ব্যস্ততার ভঙ্গিতে বলল, বসতে হবে না। কি বলবে বল। মনির খান দৃঢ় গলায় বলেন, কি হয়েছে তোর? এমন করছিন কেন?
কিছু হয়নি।
কোথায় গিয়েছিলে?
তা জেনে তোমার লাভ কি?
মনির খান তো মেয়ের কথা শুনে আশ্চার্য। বাহরে! তুই আমার মেয়ে তুই কোথায় যাস। কি করছ? তা কি জানার অধিকার নেই।
নাহ্।
কেন?
কারণ তুমিতো আমার বাবা নও।
মনির খান অবাক হয়ে বলল, একি বলছিস তুই!
হ্যাঁ। ঠিকই বলছি। তুমি যদি সত্যিই আমার বাবা হতে, তাহলে এভাবে নারীদের নিয়ে খেলা করতে পরতে না।
মেয়ের এ সমস্ত কথা শুনে লজ্জায় মনির খানের মাথা নিচু হয়ে গেল। যেন কিছু বলার মত ভাষা তার মুখে নেই। সমস্ত ভাষা যেন হারিয়ে যাচ্ছে তার মুখ থেকে।
কিছুক্ষণ দু’জনে নীরব থাকার পর সোনিয়া কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, তোমার এই চরিত্রের জন্যে আমি আজ কারো কাছে মুখ দেখাতে পারি না। কেন খোদা আমাকে তোমার ঔরসে জন্ম দিয়েছে? এই পাপের ফল একদিন তোমাকে ভোগ করতে হবে। আজ থেকে তুমি আমার বাবা নও। তুমি আর আমাকে মা বলে ডেকো না। একথা বলে দ্রুত সোনিয়া রুম থেকে বের হয়ে গেল।
সোনিয়া চলে যাচ্ছে। আর মনির খান হা করে মেয়ের পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তখন তিনি কিছুই বলতে পারলেন না।
সোনিয়া এ ধরনের নাটকীয় সংলাপ প্রায় প্রতিদিনই করে যাচ্ছে কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিচ্ছেন। এতক্ষণে মনির খান কিন্তু সোনিয়ার তিরষ্কারকূলক কথাগুলো ভুলে গেলেন। মুহূর্তের জন্য ভুলে গেলেন দুনিয়ার সব কিছু। একটি মদের বোতল টেনে নিলেন। মদ খেয়ে ব্যাকুল হয়ে পড়ে রইলেন বিছানায়।
এদিকে সোনিয়া তার পিতার কাছ থেকে এসে নিজের রুমে ধপাস করে শুয়ে পড়ে। এমন সময় বুয়া এসে বলল, আফা, ভাত খেয়ে যান।
সোনিয়ার চোখে জল। তাই আঁচল দিয়ে চোখ দু’টো মুছে বলল, আপনি যান আমি আসছি।
একথা বলাতে বুয়া চলে গেল। সোনিয়া বিছানা থেকে উঠে কাপড় পরির্বতন করল। শাড়ী পাল্টিয়ে সেলোয়ার কামিজ পড়ল। তারপর বাথরুমে যায়। বাথরুমের কাজ সমাপ্ত করে ডাইনিং রুমে যায়। তারপর একা ভাত খেয়ে নিল। মাতাল বাবাকে আর ডাকল না।
বুয়া গেল মনির খানের রুমে। সাহেব ভাত খেয়ে যান।
মাতাল মনির খান বিছানা থেকে উঠে হেলে দুলে বলল, কেরে আমার রুমে? চ — চ — চলে যা।
বুয়া দ্রুত বেগে মনির খানের রুম থেকে চলে আসে। কারণ কখন কি করে ফেলে বলা যায় না।
রাত আনুমানিক বারোটা বাজে। সোনিয়ার চোখে ঘুম নেই। বিছানার এপাশ ওপাশ গড়াগড়ি করে ভাবছে, তার বাবার বর্তমান অবস্থার কথা। ভাবছে তার প্রিয়তম পুরুষ সাকিবকে নিয়ে। সে তার পরিবারের অবস্থার কথা সবই জানে। ভাবছে নিজের জীবনের কথা। এসব ভেবে ভেবে নীরবে কাঁদে। কোন ক্রমেই আজ দু’চোখের পাতা এক করতে পারছে না। তাই বিছানা ছেড়ে বারান্দায় আসল। রেলিং এ দাঁড়িয়ে প্রকৃতির দৃশ্য দেখছে। আজ পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় জল মল করছে সারা পৃথিবী। ঝিঁ ঝিঁ পোকা মিট মিট করে আলো দিয়ে যাচ্ছে। মাজে মাঝে শির শিরে হালকা নরম বাতাস এসে সোনিয়ার গাঁকে শীতল করে দিচ্ছে। এখন আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে ভাল লাগছে না তার। তাই হাঁটতে হাঁটতে সিঁড়ি বেয়ে ছাঁদে উঠে আসল। ছাঁদে উঠে আনমনা ভাবে তাকিয়ে দেখছিল এত গভীর রাতেও যে ঢাকা শহরের অলিতে গলিতে গাড়ী চলাচল করে। অনেকক্ষণ ছাঁদে থাকার পর আবার নিজের রুমে চলে আসে সোনিয়া। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই এক সময় নিজের অজান্তে ঘুমিয়ে পড়ল।
চলবে…

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top