প্রাণের প্রিয়তমা (পর্ব-৩)
প্রাণের প্রিয়তমা(পর্ব-১)পড়ুন।
প্রাণের প্রিয়তমা(পর্ব-২)পড়ুন।
(পূর্বে প্রকাশের পর)
হারিছ ও রহিছ দু’ভাই। আজ থেকে বিশ বছর পূর্বে হারিছ সাহেব তুলারামপুর জুটমিলে চাকুরী করতেন। তাঁর চাল-চলন, আচার-ব্যবহার এতই ভদ্র ছিলেন যে জুট মিলের সকল কর্মচারীরা তাকে শ্রদ্ধা করত। তিনি ছিলের উক্ত মিলের ম্যানেজার। কিন্তু কতিপয় লোকেরা তাঁর এই ভাল আচরণ মেনে নিতে পারেনি। তারা অনেক চেষ্টা করেছে তাঁকে চাকুরী থেকে বরখাস্ত করতে। কিন্তু যখন তাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হল তখন তারা সিদ্ধান্ত নিল তাকে মেরে ফেলবে। চাকুরীতে যোগদান করার পর থেকেই হারিছ সাহেব তাঁর স্ত্রী আছিয়া বেগমকে নিয়ে জুট মিলের নিকটই বাসা ভাড়া করে থাকতেন। এরি মধ্যে চারটি বছর কেটে যায়।
আছিয়া বেগম ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আজ হারিছ সাহেব অন্যান্য দিনের চেয়ে তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বাসায় ফিরেন। রাত যখন আটটা বাজে তখন স্বামী স্ত্রী দু’জনে বসে তাদের অনাগত সন্তানের ভবিষ্যতের কথা নিয়ে ভাবছে।
হারছি সাহেব স্ত্রী আছিয়া বেগমকে বলল, আচ্ছা বলতো তুমি কি চাও? ছেলে নাকি মেয়ে?
আছিয়া বেগম বলল, আমি ছেলে চাই। আর তুমি কি চাও?
আমি মেয়ে চাই।
আচ্ছা ঠিক আছে দেখি কি হয়। যদি তোমার কথা মত মেয়ে হয় তাহলে নাম কি রাখবে?
রুবি।
সুন্দর নামতো। আচ্ছা আর যদি তোমার কথামত ছেলে হয় তাহলে নাম কি রাখবে?
সাকিব।
সন্তানের অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন তারা আলোচনায় মগ্ন তখন কয়েকজন লোক আসল। তাদের মধ্য থেকে একজন ডাকলেন, হারিছ সাহেব বাসায় আছেন?
তাদের ডাকে হারিছ সাহেব বাসা থেকে বের হলেন। তখন তার পরনে ছিল একটি লুঙ্গি ও শার্ট। লোকগুলো তাঁর কাছে অপরিচিত মনে হল। তবে এর মধ্যে তাঁর অফিসের একজন কর্মচারী আছেন তা তিনি ভাল করে চিনতে পারলেন। তখন ঐ কর্মচারী লোকটি বলল, স্যার আপনার সাথে কিছু কথা আছে এক জায়গায় যেতে হবে চলুন।
হারিছ সাহেব তার কথাই রাজি হয়ে আছিয়া বেগমকে বললেন, তুমি ঘরে থাক আমি আসতেছি। বলেই হারিছ সাহেব তাদের সাথে কথা বলতে বলতে এক নির্জন জায়গায় চলে আসলেন। এমন সময় হারিছ সাহেব বললেন, ঠিক আছে অফিসে কথা হবে আমি এখন চলে যাই।
তাদের মধ্য হতে একজন হারিছ সাহেবের হাত ধরে বলল, যা বলার এখন শুনে যান। আর বলার সময় পাবেন না। একথা বলেই তাঁকে টেনে সামনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
তাদের এসব কথা ও টানাটানিতে হারিছ সাহেব একটু ভয় পেয়ে গেলেন। তোমরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?
অন্য একজন বলল, এইতো কিছুক্ষণের মধ্যেই জানতে পারবে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি।
হারিছ সাহেব যত দূরে যাচ্ছে ততই ভয় পেয়ে যাচ্ছেন। তাঁর বুকটা দুরু দুরু করে কাঁপছে। কিছুদূর যেতেই দেখতে পেলেন দু’জন যুবক ছুরি হাতে দাঁড়ানো। এ দৃশ্য দেখে হারিছ সাহেবের গা ছম ছম করে উঠল। সমস্ত শরীরের লোম খাড়া হয়ে উঠল। হারিছ সাহেব ভয়ে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, কি ব্যাপার তোমরা আমাকে কিসের জন্য নিয়ে আসলে। কি উদ্দেশ্য তোমাদের?
কেন তোকে এখানে এনেছি তা এখনই দেখাচ্ছি। বলেই এক যুবক হারিছ সাহেবের মুখ চেপে ধরল। অন্য একজন রশি দিয়ে হাত পা বেঁধে ফেলল। তিনি চীৎকার দেয়ার চেষ্টা করছেন কিন্তু পারছেন না। আশে পাশে কোন লোক জন নেই যে তাকে কেউ সাহায্য করবে। গায়ের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে তিনি তাদের কাছ থেকে ছুটতে চেষ্টা করলেন কিন্তু তার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হল। ধস্তাধস্তিতে একসময় মানুষ রূপী নরপশুগুলো হারিছ সাহেবকে কোরবানীর পশুর মত মাটিতে শুয়ে দিলেন। মুহূর্তের মধ্যে পাষাণ্ড নরপিচাশরা তাঁর গলায় ছুরি চালিয়ে দিল। রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল হারিছ সাহেবের সমস্ত শরীর। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। জবেহ করা গরুর মত ধাফরাতে লাগলেন। প্রাণ পাখিটা বের হয়ে গেল। মৃত্যু নিশ্চিত করে সন্ত্রাসীরা নির্বিঘ্নে চলে গেল।
এদিকে রাত দশটার উপরে বাজে। মরহুম হারিছ সাহেবের স্ত্রী আছিয়া বেগম স্বামীর চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠলেন। এখনও কেন তার স্বামী ঘরে ফিরছেনা। কি হয়েছে ওনার? কোন উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না আছিয়া বেগম। তার পেঠে ছয় মাসের শিশু সন্তান। সন্তান নিয়ে কোথাও যেতে পারছেনা। ভাড়া থাকেন বলে এখানে কোন আত্মীয় স্বজনও নেই। কার কাছে যাবে। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। চিন্তায় চিন্তায় নির্ঘুমভাবে সারারাত কাটিয়ে দিলেন আছিয়া বেগম। ফযরের আযান হল। অযু করে নামায আদায় করলেন। দু’হাত তুলে প্রভুর কাছে প্রার্থনা করলেন, ‘হে আমার প্রভু, জানিনা আমার স্বামী কোথায় আছে। তুমি সব জান্তা। যেখানে থাকুক না কেন আমার স্বামীকে তুমি হেফাজতে রাখিও।’
সকাল বেলা আছিয়া বেগম প্রতিবেশীদের সাথে তার স্বামী রাতে বাড়ী না ফেরার কথা বললেন। তার কথা শুনে সবাই তার খুঁজ নিচ্ছে তিনি কোথায় যেতে পারেন। সকাল আটটার দিকে হারিছ সাহেবের হত্যার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। স্বামীর মৃত্যুর খবর শুনে আছিয়া বেগম হঠাৎ মেঝেতে পড়ে যান। চীৎকার দিয়ে বলল, ‘হে খোদা তুমি একি করলে? কি অপরাধ ছিল আমার স্বামীর? যার কারণে আমাকে অল্প বয়সে বিধবা বানালে? কি কারণে তুমি আমার পেঠের নিষ্পাপ সন্তানকে এতিম বানালে? তার চীৎকারে বাসার আশে পাশের লোকজন জড়ো হল। সবাই তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে কিন্তু সে সান্ত্বনা কিছুতেই কাজে আসছেনা।
পুলিশ এসে হারিছ সাহেবের লাশ ময়নাতদন্তের জন্যে থানায় নিয়ে গেল।
গ্রামের বাড়িতে এ খবর শুনার সাথে সাথেই সবাই আহাজারিতে ফেঁটে পড়ল। বাবা চাঁন মিয়া, ছোট ভাই রহিছ মিয়া ঢাকায় আসে। লাশ ময়নাতদন্তের পর যখন বাসায় নিয়ে আসল তখন সবাই রক্তাক্ত দেহের উপর পড়ে কান্নাকাটি করতে লাগল। সাংবাদিকরা এসে লাশের ছবি তুলে নিল। পুলিশ আছিয়া বেগম ও চাঁন মিয়ার জবানবন্দি নিলেন।
পরদিন ছবিসহ পত্রিকাতে এ খবর ছাপা হল। সারাদেশের মানুষ এ সংবাদ জানল কিন্তু কেন খুন হল, কারা খুন করল তার হদিছ পুলিশরা বের করতে পারেনি।
লাশ বাড়িতে আনা হল। হারিছ সাহেবের লাশ দেখার জন্য গ্রামের মানুষের ঢল নেমেছে। এমনকি অন্য গ্রাম থেকেও মানুষ আসছে। আত্মীয়স্বজনরা সবাই আসল। লাশ নিয়ে যখন গোরস্থানে যাচ্ছে তখন চাঁন মিয়ার চোখ বেয়ে অশ্রু ধারা বইতে লাগল। এ কেমন দৃশ্য! পিতার কাঁধে ছেলের লাশ। এ দৃশ্য কোন বাবা কামনা করতে পারে না। এ শোক কিভাবে সইবে চান মিয়া। সবাই লাশ দেখার পর দাফন করা হয়।
এদিকে রহিছ মিয়া সবে মাত্র দশম শ্রেণীর ছাত্র। তার ভায়ের হঠাৎ মৃত্যুতে সে খুবই মর্মাহত। কারণ সংসারের সমস্ত বোঝা তার মাথায় নিতে হচ্ছে। তার বাবা-মা বৃদ্ধ। তার আর কোন ভাইও নেই যে, তার দায়িত্ব নিবে। তাই ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে রহিছ মিয়া লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে দু’টো গরু কিনে কৃষি কাজে লেগে গেলেন।
চান মিয়ার বড় আশা ছিল হারিছ মিয়া লেখাপড়া করে, চাকরি করে সংসারের স্বচ্ছলতা আনবে। কিন্তু সে আশা পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই আল্লাহ তাকে দুনিয়া থেকে নিয়ে যায়।
হারিছ সাহেবের মৃত্যুর তিন মাস পর আছিয়া বেগম একটি পুত্র সন্তান জন্ম দিল। চাঁন মিয়া পুত্র সন্তান জন্ম হওয়াতে খুবই খুঁশি হইয়াছেন। কারণ তার ছেলের বংশধর তার মাধ্যমে বেঁচে থাকবে। আছিয়া বেগম তার সন্তানের নাম রাখলেন সাকিব।
মুসলিম আইনানুসারে স্বামী বিয়োগান্তে ইদ্দত পূর্ণ হওয়ার পর ইচ্ছে করলে স্ত্রী অন্য স্বামী গ্রহণ করতে পারবে। আর ইচ্ছে না হলে বিধবাবস্থায় সারা জীবন থাকতে পারবে তাতে কোন পাপ হবে না। আর বর্তমানে সামাজিকভাবে নিয়ম স্বামীর মৃত্যুর পর ইদ্দত পূর্ণ হলে সে তার পিত্রালয়ে চলে যাবে এবং ইচ্ছে করলে অন্যত্র বিয়ে করবে নতুবা পিত্রালয়ে থাকবে। মৃত্যু স্বামীর বাড়িতে থাকার কোন অধিকার নেই। এখন সে অনুসারে আছিয়া বেগমকে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে।
সময় থেমে থাকেনি। দিনের পর রাত আসে। তারপরে সপ্তাহ পার হয়। এভাবে চলে যাচ্ছে মাসের পর মাস। দিনে দিনে বড় হতে লাগল সাকিব। সাকিবের দু’বছর পূর্ণ হল। এদিকে আছিয়া বেগম প্রাণের প্রিয়তম স্বামীকে হারিয়ে একমাত্র ছেলেকে নিয়ে পিতৃতুল্য শ্বশুরের অনুরোধে এ বাড়িতে রয়ে গেলেন।
চাঁন মিয়া চিন্তায় অস্থির। ভাবেন, এভাবে আর কতদিন বউমা থাকবে। তার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। এদিকে ছেলে রহিছ মিয়াও তো বিয়ের উপযুক্ত। যে নারী কোন দিন শ্বশুরের মনে আঘাত দেয়নি, শশুরের একবিন্দু কষ্ট হতে দেয়নি। সেই নারীকে কীভাবে চাঁন মিয়া বিদায় দিবেন। এমন আদর্শ পরহেযগার সতী নারীকে কিছুতেই হাত ছাড়া করা যায় না। তাকে যেভাবে হোক এ বাড়িতে রাখতে হবে। হারিছ মিয়ার একমাত্র উত্তরাধিকারী শিশু সন্তান সাকিবকেই বা কি করে দিয়ে দিবেন। আর যদি নাতীকে রাখতে চান তাহলে কে করবে তার দেখা শুনা। এসব ভাবছেন চাঁন মিয়া। এবার এও ভাবছেন রহিছ মিয়া বর্তমানে বিয়ের উপযুক্ত। তাকে তো অন্য জায়গায় বিয়ে করাতে হবে। সে বউতো সাকিবকে অন্য নজরে দেখবে। তার চেয়ে বরং রহিছ মিয়াকে দিয়ে বউমাকে রেখে দিলে কেমন হয়? হ্যাঁ ভালই হয়। এক ঢিলে দুই পাখি।
চাঁন মিয়া একদিন রহিছ মিয়াকে ডেকে বললেন, বাবা রহিছ, আমার বয়স তো ফুরিয়ে আসছে। জানি না কবে মরে যাই। তোকে আমার জীবনের শেষ একটি আবদার রাখতে হবে।
রহিছ নম্র স্বরে বলল, আব্বা আপনার সব আবদার আমি শুনে আসছি। আজও শুনব। বলেন আপনার কি আবদার।
চান মিয়া গলা খাঁকাড়ি দিয়ে বলল, আমি চাই তুই তোর ভাবিকে বিয়ে কর। ও যদি চলে যাই তাহলে তোর ভাতিজার কি হবে? সে কাকে মা ডাকবে? সে জন্ম হয়ে তার বাপকে দেখেনি। এখন যদি মাকেও হারাতে হয় তাহলে তার মত অভাগা পৃথিবীতে আর নেই। হারিছের অবর্তমানে তুই ওর বাপ। আমার আয়ু তো শেষ হয়ে আসছে। আমি হয়তো আর বেশি দিন বাঁচব না।
পিতৃভক্ত রহিছ কোন দিন কোন কাজে তার বাবার মনে আঘাত দেয়নি। আজ পর্যন্ত কোন কথা অমান্য করেনি। কি করে পারবে আজ বাবার শেষ আবদার ফেলে দিতে। শত কষ্ট হলেও পারবে না তার বাবার আবদারকে অপমান করতে।
চাঁন মিয়া আবার বলল, আমি জানি বাবা, বউমার চেয়ে তোর বয়স কম হবে। তারপরও সবদিক চিন্তা ভাবনা করে আমি তোকে বিয়ে করতে বলছি। তুই তো জানিস আমাদের মহানবী (সাঃ) এর ইতিহাস। তিনি যখন বিয়ে করেন তখন খাদিজা (রাঃ) এর বয়স ছিল ৪০ বছর। আর রসুল (সাঃ) এর বয়স ছিল মাত্র ২৫ বছর। দু’জনের মধ্যে ১৫ বছরের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তিনি খাদিজা (রাঃ) কে বিয়ে করেছিলেন। তিনি নবী হয়ে যদি পারেন, তাহলে তুই কেন পারবি না? আমি জানি বউমার বয়স বেশি হলেও তেমন বেশি না। চার পাঁচ বছরের পার্থক্য হবে।
রহিছ মিয়া তার বাবার কথাগুলো শ্রবণ করে চোখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখেন আব্বা এত কিছু বলতে হবে না। আপনি যা ভাল মনে করেন তা করেন। এতে আমার কোন আপত্তি নেই।
পরে চাঁন মিয়া একইভাবে আছিয়া বেগমের কাছ থেকে সম্মতি আদায় করেন। আছিয়া বেগম শুধু ছেলে ও শশুরের দিকে চেয়ে সম্মতি দেয়।
বিয়ে হয়ে গেল রহিছ মিয়ার সাথে আছিয়া বেগমের। এ ধরনের বিয়েকে সামাজিক বিজ্ঞানের ভাষায় লেভিরেট বিয়ে বলা হয়। এটা আমাদের মুসলিম আইনে বৈধ। কিন্তু তারপরও স্বামী মারা যাবার পর বিধবা স্ত্রীকে দেবর বিয়ে করে এর প্রচলন খুবই কম। লাখে একজন আছে কিনা সন্দেহ। কারণ কেউ তার ফুটন্ত যৌবনকে বিধবা স্ত্রীর মাঝে বিলিয়ে দিতে চায়না। কিন্তু সেই দৃষ্টান্তই স্থাপন করলেন রহিছ মিয়া। তাঁর বাবার কথা রাখতে গিয়ে, তার ভাতিজাকে মা ডাকার অধিকার দিতে গিয়ে, সদ্য ফুটে উঠা যৌবন খানা বিলিয়ে দিলেন তার চেয়ে বয়সে বড় একটা মহিলার মাঝে। যাকে সে এতদিন ভাবি হিসেবে জানত। আজ সে তার স্ত্রী। মহৎ মনের অধিকারী রহিছ মিয়া আজ বাসর রাতে প্রতিজ্ঞা করেন ভাতিজা সাকিবকে লেখাপড়া শিখিয়ে তাঁর ভায়ের মত একজন সৎ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন।
ভাই মারা যাবার পর রহিছ মিয়ার সংসারে অভাব শুরু হয়ে গেল। বাবা চাঁন মিয়া বয়সের ভারে দিন দিন বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন। এখন তেমন বেশি চলাফেরা করতে পারেনা। এখন শুধু মসজিদ ছাড়া আর কোথাও যেতে পারেন না। তার মা কিছুদিন আগে মারা যায়।
দেখতে দেখতে দু’বছর পার হয়ে গেল। রহিছ মিয়ার সংসারে একটা কন্যা সন্তান হয়। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সেই সন্তান দুনিয়াতে বেশিদিন থাকতে পারেনি। হঠাৎ একদিন ডায়রিয়া হয়ে মারা যায়। দিন মজুর রহিছ তার সন্তানের সু-চিকিৎসা করতে পারেনি। সন্তান হারিয়ে বুকে ব্যথা নিয়ে সাকিবকে সন্তানের মত করে লালন পালন করতে লাগলেন। নিজে একা পরিশ্রম করেন তবু সাকিবকে কাজে নেননি। ও যখন ৬ বছরে পদার্পন করল তখন তাকে গায়ের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। রহিছ মিয়ার মেয়ের জন্মের তিন বছর পর একটা পুত্র সন্তান জন্ম হয়। তার নাম রাখেন বাবুল। যে দিন বাবুলের জন্ম হল সেদিন রহিছ মিয়ার ঘরে এক মুঠো ভাতও ছিলনা। বাবুল জন্মের পর থেকে রহিছ মিয়ার সংসারে অভাব বেশি করে দেখা দেয়। যা কিছু জমি জমা ছিল তাও বিক্রি করে শেষ করে ফেলল। এই অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে বাবুল বড় হতে লাগল। এখন রহিছ মিয়ার নিজের জমি বলতে কিছুই নেই। বর্তমানে দু’টো গরু দিয়ে মানুষের জমিতে বর্গা চাষ করে কোন মতে দিন চলছে। এই অভাবের সংসারে বাবুলকে লেখাপড়া করানোর সামর্থ হারিয়ে ফেললেন। রহিছ মিয়া বাবুলকে একটা ছাগল কিনে দিলেন। তাদের গ্রামের উত্তর পাশে এক বিরাট চর। তার কাজ এই চরে গরু দু’টো ও ছাগলকে ঘাস খাওয়ানো। আর মাঝে মাঝে বাপের সাথে খেত নিড়াইতে যায়। এই অভাবের পরও রহিছ মিয়া কিন্তু তার ভাতিজা সাকিবের লেখাপড়া বন্ধ করেননি। এই দুনিয়াতে কয় জন ব্যক্তি আছেন যে নিজের ছেলেকে না পড়িয়ে ভাতিজাকে পড়ায়। অথচ তার লেখাপড়া করানোর সামর্থ নেই। ঈদ এলে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভাতিজার লেখাপড়ার খরচ যোগানোর জন্য ফেতরার টাকা তুলতে হয়। এত পরিশ্রম ও এত কষ্ট করছেন তারপরও তার মধ্যে বিন্দু মাত্র দুঃখ নেই। তিনি মনে করেন তার ভাই এখনো বেঁচে আছেন। কারণ সাকিব দেখতে ঠিক তার ভায়ের মতই হয়েছে।
সাকিব এস.এস.সি পাশ করল। একদিন পারিবারিক বিষয় নিয়ে সাকিব চাচার সাথে ঝগড়া করে ঢাকায় চলে যায়। সেই থেকে আজ চার বছর গত হল। আজ পর্যন্ত বাড়ির সাথে যোগাযোগ করেনি। সে যেদিন বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসে, তখন সে বলে আসে যেদিন সে নিজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে, সে দিন সে বাড়ি ফিরবে।
ঢাকায় এসে এক কলেজে ভর্তি হয়। বর্তমানে বি.এস.সি শেষ বর্ষে অধ্যায়নরত। কলেজে পরিচয় হয় সোনিয়ার সাথে। আজ দুই বছর যাবৎ সে তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।
পিতৃহারা সন্তান সাকিবকে হারিয়ে আছিয়া বেগম এখন দিশেহারা। তার কান্না সহ্য করতে না পেরে রহিছ মিয়া কয়েকবার ঢাকায় এসে খুঁজে যায়। এত বড় শহর কোথায় পাবে তাকে। তাদের তো কোন আত্নীয় স্বজনের বাসাও নেই যে সেখানে যাবে। কোথাও তাকে খুঁজে না পেয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায় রহিছ মিয়া। প্রাণ প্রিয় সাবেক স্বামীর মৃত্যুর শোক ভুলতে না ভুলতেই ছেলে আবার নিরুদ্দেশ। ছেলে তো তার মায়ের ব্যাথা বুঝলনা। যদি বুঝত তাহলে এমন নিষ্ঠুরের মত মাকে ছেড়ে থাকতে পারত না। একটি পুরুষ যখন বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যায় তখন মা-বাবার কথাও মনে থাকেনা। বিশেষ করে যারা দুরে থাকে। আর এখন সাকিবতো তার প্রাণের প্রিয়তমা সোনিয়াকে পেয়ে মা, চাচা, দাদা ও ভাইয়ের কথা ভুলেও মনে করেনা।
রহিছ মিয়া এখন খুব কষ্টে দিন যাপন করছে। কখনো দু’বেলা খেয়ে রাত কাটাতে হচ্ছে। সামান্য একটা ব্যাপারকে কেন্দ্র করে আজ ভাতিজা তাকে ছেড়ে চলে গেছে।
রহিছ মিয়ার মাঝে মাঝে ভাতিজার কথা মনে হলে ভাবেন, নিজের সন্তানকে লেখাপড়া না শিখিয়ে, নিজে না খেয়ে, ফেতরার টাকা তুলে লেখাপড়ার খরচ যুগিয়েছি। অথচ মানুষ একদিন বলেছিল, কি লাভ হবে ভাতিজাকে পড়িয়ে? সে তো একদিন তার পথ ধরবে। কিন্তু আমি তো গর্ব করে বলেছিলাম, না আমার ভাতিজা এমন হবেনা। কিন্তু সে গর্ব আর এখন নেই। মানুষ আজ তাকে ধিক্কার দেয়। আজ যেন মানুষের কথাই সত্যে পরিণত হল। অথচ সাকিব বুঝল না তার পিতৃতুল্য চাচার কথা। যার কারণে সে মাকে পেল সেই চাচাকে চিনলনা।
চলবে…