রঙ্গিন ফানুশ (২য় পর্ব)
( ১ম পর্বের লিঙ্ক )
ছয়
২ দিন পর তমা’র ফোন আসল। তমা বলল, আচ্ছা, পরশুদিন আপনি কি ফ্রি আছেন?
রূপকঃ হ্যা! কেনো?
তমাঃ ভাবছিলাম, নজরুলের সমাধিতে যাব।
রূপকঃ হুম, যাওয়া যায়। পরশুদিন আমার অফ ডে।
তমাঃ ভালই হল। আমি আপনাকে সকালে ধানমন্ডি থেকে pick করব।
রূপকঃ আচ্ছা।
কাজী নজরুলের সমাধিসৌধে পৌছে তমা ও রুপক প্রথমেই নজরুলের কবরে ফুল দিল। এরপর হাটতে হাটতে চারপাশ ঘুরে দেখতে লাগল।
রূপকঃ আমার এখানে আসতে ভালই লাগে।
তমাঃ আমি একটা জিনিস ভেবে দেখেছি- আপনার সাথে কবি নজরুলের অনেক মিল আছে।
রূপকঃ (কপাল কুঁচকে) তাই নাকি? কিভাবে?
তমাঃ এই যে আপনার বড় বড় চুল।
রূপক হেসে ফেলল।
তমাঃ আরও আছে। নজরুলের মতই আপনারও বন্দীত্ব থেকে বেরিয়ে আসার চিন্তা। আপনার মনে আছে সদা মুক্তচিন্তা। আমার কাছে অনেক সৃজনশীল লাগে। আপনার শিক্ষার রীতি নিয়ে যে অনুধাবন, তার মধ্যে নতুনত্ব আছে। যেমন নজরুলের মধ্যেও নতুনত্ব ছিল।
রূপকঃ সেই তো আমার প্রেরণা।
তমাঃ যদিও আপনার মাঝে বিদ্রোহী ভাব থাকলেও প্রেমিক ভাব নেই। কিন্তু, নজরুলের মাঝে দুটোই ছিল। বিদ্রোহী কবিতা পড়লেই যেমন সবার মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, তেমনি তার প্রেমের কবিতা, সাহিত্য, গানগুলো পড়লেই বুঝা যায়, নজরুল কতটা প্রেমিক ছিলেন।
রূপকঃ হুম, প্রেমের এত গভীরভাবে উপস্থাপন নজরুল ছাড়া আর কেউ করতে পারেনি। তবে, আমার সম্পর্কে আপনার ধারণাটি আমার উপর অবিচারই বটে।
তমাঃ আসলেই?
রূপকঃ আমি প্রেম করিনা মানে এই নয় যে আমি প্রেমিক নই।
তমা এ কথায় একটি নজরুল গীতি গাইতে লাগল- “জনম জনম গেল, আশা পথ চাহি”
গানের শেষে রূপক ক্ষণকাল চেয়ে থেকে আনমনেই বলল, অসাধারন।
তমাঃ কি?
রূপক চমকে গিয়ে বলল, ইয়ে, গানটা।
তমা হেসে ফেলল। এরপর ওরা চলে আসল। রিকশা থেকে নেমে তমা বলল, ধন্যবাদ।
রূপকঃ কেন?
তমাঃ আমাকে সময় দেয়ার জন্য।
রূপকঃ তোমাকেও ধন্যবাদ। একটা কথা বলব?
তমাঃ বলো।
রূপকঃ তোমাকে আজকে অনেক সুন্দর লাগছে।
তমা হেসে বলল, ধন্যবাদ। ভাল থেকো।
রূপকঃ বিদায়
সাত
এভাবে মাস চলে গেল। তমা ও রুপক একে অপরের আরও কাছাকাছি চলে আসল। একজনের প্রতি অন্যজনের অনুরাগ বাড়তে লাগল। এই অনুরাগ, ভাললাগা বাড়তে বাড়তে তা ভালবাসায় রূপ নিল। একদিন রুপক অফার করে বসল।
সেদিন ছিল ২২শে অক্টোবর। রুপকের জন্মদিন।
রুপক তার জন্মদিন পালনে তমাকে নিয়ে একটি ক্যাফেটেরিয়ায় বসল। তমা রূপককে একটি ভায়োলিন গিফট করল। গিফট দেখে রুপক ভীষণ খুশি।
রূপকঃ আমি অনেকদিন ধরে ভাবছিলাম একটা ভায়োলিন নিব। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।
তমাঃ মাই প্লেজার।
রূপকঃ তমা, তোমাকে একটা কথা বলব।
তমাঃ হ্যা, বলো।
রূপকঃ তুমি আমাকে একটা সাহায্য করতে পারবা?
তমাঃ কি? বলো।
রূপকঃ আমি একজনকে অনেক ভালবেসে ফেলেছি। কিন্তু, কিভাবে বললে সে বুঝবে, সেটা বুঝতে পারছি না।
তমাঃ তার মনোভাব কেমন বলে তোমার মনে হচ্ছে?
রূপকঃ ঠিক বুঝতে পারছি না। মাঝে মাঝে মনে হয় সে আমাকে পছন্দ করে। আবার মাঝে মাঝে মনে হয়, আমাকে কেন পছন্দ করবে? আমার মাঝে কি আছে?
তমাঃ নাহ। তোমার মাঝে তো কনফিডেন্স আছে। সরাসরি বলে ফেল। দেখ কি হয়।
রূপকঃ কিন্তু, সে যদি ‘না’ বলে। তখন তো আমি মেনে নিতে পারব না।
তমাঃ না বলবে সেটা তুমি কিভাবে বুঝলা? হ্যা ও তো বলতে পারে!
রূপক বুক ভরা শ্বাস নিয়ে বলল, Ok! তমা, আমি তোমাকেই ভালবাসি।
তমা প্রথমে কিছুটা গম্ভীর হয়ে গেল।
ঠিক সে মুহুর্তে রানওয়েতে নামার জন্য একটি প্লেনের আওয়াজ পাওয়া গেল। তমা ঘুরে সেদিকে তাকাল। ধীরে ধীরে প্লেনটি রানওয়েতে অবতরণ করল। তমা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এদিকে রুপক এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তমার দিকে। তমা রুপকের দিকে চোখ ফিরিয়ে বলল, ‘I love you too’।
রুপক স্মিত হেসে তমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে টেবিলে তাকাল। হালকা মাথা ঝাঁকাল। এরপর স্ফুর্তিতে জোরে ‘হু’ বলে চিৎকার করে উঠল। আশপাশের মানুষের কথা মনেই ছিলই না। রুপক তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘sorry’।
এরপর ওরা বহুক্ষণ গল্প করে ফিরল। তারপর থেকে প্রতিদিনই ওরা দেখা করল, প্রায়ই ঘুরতে লাগল। একসাথে ফাইনাল ইয়ারে উঠে গেল। তমা বরাবরের মত এবারও ফার্স্ট হয়েছে।
আট
তমার বাড়িতে তমার বাবা, মা, ছোট বোন ও দাদী একসাথে বসে খুব মনযোগের সাথে ভারতীয়-বাংলা চ্যানেলে সিরিয়াল দেখছিল। সবার চোখে-মুখে ছিল উৎকন্ঠা, চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছিল। সিরিয়ালের নায়ক-নায়িকার এই বুঝি মিলন হল! সবাই আশা করে আছে বহু প্রতিকূলতার পর এবার হয়ত মিলন হবে! কিন্তু মিলন যেন হয়ে হয়েও হচ্ছে না।
তমার ছোট বোন মুখে হাত দিয়ে বলে উঠল, ‘আল্লাহ! এইবারও ওদের মিল হবে না?’
তমার মা বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল, ‘কি জানি? আর কত দিন লাগাবে এই পরিচালক?’
এরপর দৃশ্যগুলোতে তাদের উৎকন্ঠা যেন আরও বেড়ে গেল। সবাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। এরপর অবশেষে সিরিয়ালের নায়ক-নায়িকার মিলন হল এবং ঘরের সবাই চিৎকার করে লাফিয়ে উঠল। সে মুহুর্তে ঘরে ঢুকল তমা। তমা টিভির রুমে এসে ওর মাকে বলল, ‘মা, আজকে রাতের খাবার আমি রান্না করব।’
সবাই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল। তমা ওর রুমে চলে গেল। সবাই আবার সিরিয়াল দেখায় মনযোগী হল। রাতে তমার মা তমার রুমে গেল। তমা সে সময় ওয়াশ রুমে ছিল। তমার মা খেয়াল করল টেবিলে তমার ডায়েরীটা খোলা। তমার মা ডায়েরীটা বন্ধ করতে গিয়ে দেখলেন আজকের তারিখের পাতায় কিছু লেখা। সেখানে রুপকের সাথে আজকের ঘটনার বর্ণনা। উনি সব পড়ে চলে গেলেন তমার বাবাকে বলতে।
তমার বাবা-মা তমার রুমে এসে তমাকে জবাবদিহি করা শুরু করল। তমা সব বলল। কিন্তু, ওর বাবা-মা কিছুই মানতে নারাজ, তারা ওকে বকা-ঝকা করা শুরু করল।
তমার মা তমার বাবাকে বললেন, তোমাকে আগেই বলেছি মেয়েকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেও। অত পড়ালেখা করিয়ে কি লাভ? এখন কি করে এসেছে আল্লাহই জানে! বংশের মুখে চুনকালি দিল!
তমার বাবা তমাকে বলল, দেখ তমা, আমি আমার বংশের বড় সন্তান। আমার মেয়েরই যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে আমি তো আমার ফ্যামিলির কাছে মুখ দেখাতে পারব না। আর তোমাকে দেখে তোমার ছোট বোনই বা কি শিখবে? তোমার তো এটুকু বোঝা উচিৎ, কাল যদি সে পালিয়ে যায়! তোমার মা অনেক কষ্ট করে তোমাদের বড় করেছে, অনেক স্বপ্ন আছে আমাদের। কোন বাবা-মা ই তার সন্তানের অমঙ্গল চায় না।
তমাঃ আমাদের নিজেদের কি স্বপ্ন থাকতে নেই?
তমার মাঃ তোদের স্বপ্ন আর আমাদের স্বপ্ন কি ভিন্ন? আমরা কি তোর খারাপ চাই?
তমার বাবা তমার মাকে বললেন, আচ্ছা! তুমি পাশের রুমে যাও। আমরা কথা বলছি।
তমার মা চলে গেলে বললেন, শোন তমা, তুমি যতদূর এগিয়েছ আর এগিয়ো না। তুমি যদি তা না কর, তবে তোমার মায়ের জন্য হোক আর বংশের জন্য হোক আমাকে তোমার পড়াশুনা বন্ধ করে দিতে হবে, তোমাকে বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। এসব ভুলে যাও, পড়াশুনা করো। আমাকে কথা দাও, তুমি আর ঐ ছেলের সাথে মিশবে না। তুমি যদি কোন occurrence করে ফেল, তাহলে কিন্তু আমাদের আত্মহত্যা করা ছাড়া আর গতি থাকবে না। আমাকে কথা দাও।
তমা কাঁদতে কাঁদতে বলল, আচ্ছা, বাবা। কথা দিচ্ছি।
নয়
পরদিন তমা রুপকের সাথে ক্যাফেতে দেখা করল। বলল, রুপক, আমার মনে হয় কি জানো- পৃথিবীতে মানুষ যে কাজ সবচেয়ে বেশি করে সেটা হল ভালবাসা। আর পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি শত্রু তাদেরই যারা ভালবাসে। বিভিন্ন ধরনের শত্রু- সমাজ, ধর্ম, ধন-দৌলত, রাজনীতি। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর, পবিত্র জিনিসটিকেই গ্রহণ করতে শেখে নাই আমাদের সমাজ, তাই আজ পৃথিবীর এ অবস্থা! মানুষকে বাধ্য করা হয় তার প্রিয় মানুষকে ছেড়ে যেতে। ……তোমাকে আমি ভালবাসি না তা না, হয়ত এতদিনে তা প্রকাশ করতে পারিনি, আজ বলছি অনেক ভালবাসি, কিন্তু আমাকে ছেড়ে যেতে হবে। আমি বাধ্য তোমাকে ছেড়ে যেতে।
বলতে বলতে কেঁদে ফেলল ও। কাঁদতে কাঁদতেই বলল, আমার প্রতি অভিমান রেখো না। আমাকে ভুলে যেও।
কিছুক্ষণ থেমে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেল। একটু থেমে আবার বসে পড়ল। মাথা নিচু করে বলল, আমি পারব না। নাহ, আমি পারব না। তোমাকে ভুলে থাকতে পারব না।
রুপক তমার হাত ধরল, মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। বলল, আমিও পারব না। আমি ভাবতেই পারছি না কিভাবে তোমাকে ভুলে থাকা সম্ভব। গতকাল রাতভর আমি যে স্বপ্ন বুনেছি আজ ভোরের আলোয় কি সে স্বপ্ন ভেঙ্গে যাবে? প্লিজ, আমাকে ছেড়ে যেও না। আমি থাকতে পারব না।
তমাঃ কিন্তু, ওরা তো মেনে নিবে না। ওরা তো ওদের প্রথা-গন্ডী থেকে বের হতে পারবে না।
রূপকঃ তমা, তমা তুমি শান্ত হও। আমি তোমার বাবার সাথে কথা বলব।
দশ
রুপক তমার বাবার অফিসে গেল। পরিচয় দেবার পর চেয়ারে বসল।
তমার বাবা বলল, কিসে পড় তুমি?
রূপকঃ জ্বি, কম্পিউটার সায়েন্সে ফাইনাল ইয়ারে।
তমার বাবাঃ পাশাপাশি কিছু কর?
রূপকঃ জ্বি না। পড়াশুনা শেষ করেই একবারে করব।
তমার বাবাঃ হুম, সে ভাল। তমার সাথে পরিচয় কতদিন?
রূপকঃ এই বছর খানেক।
তমার বাবাঃ দেখ বাবা, তোমাকে আমি কিছু কথা বলি। এই সময়টা আমরাও পার করে এসেছি। এ সময়ে সবাই রঙ্গিন রঙ্গিন স্বপ্ন দেখে। কিন্তু, আসলে বাস্তবতা অনেক কঠিন, জীবন অনেক জটিল। তোমরা শিক্ষিত ছেলেমেয়ে, সবই বোঝ। কিন্তু, আবেগকে তোমরা অনেক বড় করে ফেল। তোমরা রঙ্গিন স্বপ্নের সাথে সাথে তোমাদের বংশ, সমাজ, প্রথা সব ভুলে যাও।
রূপকঃ আমরা কি ভাল-মন্দ পৃথক করার মত জ্ঞান এখন লাভ করিনি? মানুষকে মানুষের ভালাবাসা কি অন্যায়?
তমার বাবাঃ তা খারাপ না কিন্তু আমার ভবিষ্যৎ জীবনের চিন্তাই তো প্রাধান্য পাওয়া উচিৎ, সেটাকে confirm না করে অন্য চিন্তা করা অন্যায়। কোন বাবা-মা ই সন্তানের ইচ্ছাকে ফেলে দিতে চায় না, কিন্তু বাস্তব জীবনে যে অভিজ্ঞতা সে এখনও পায়নি সে বিষয়ে তাকে সতর্ক করা বাবা-মা’রই কাজ। আমি তোমাকে খারাপ বলছি না, কিন্তু আমি চাই আমার মেয়েকে একটি established ছেলের সাথেই বিয়ে দিতে। তুমি তো সবে ফাইনাল ইয়ারে।
রূপকঃ আমরা তো এখনই বিয়ের কথা ভাবিনি। আমি বলছি, আপনি যদি তমার বিয়েটা এখন না দেন, আমার সিজিপিএ-ও ভাল, তাহলে আমি ততদিনে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যাব। আমরা তখনই বিয়ে করলাম।
তমার বাবাঃ আমি কোন ভরসায় এটা করব? তোমার ফ্যামিলি কি তখন তমাকে মানবে? আচ্ছা, ওকে, তুমি যদি তোমার ফ্যামিলির মাধ্যমে এই প্রস্তাব আনতে পার, তখন নাহয় আমরা বিবেচনা করে দেখব।