Today 23 Nov 2024
banner
নোটিশ
ব্লগিং করুন আর জিতে নিন ঢাকা-কক্সবাজার রুটের রিটার্ন বিমান টিকেট! প্রত্যেক প্রদায়কই এটি জিতে নিতে পারেন। আরও আছে সম্মানী ও ক্রেস্ট!
banner

মুঘল সালতানাতের তিন রমণীর প্রেম , বাস্তবতা বনাম আরবান মিথ

লিখেছেন: রুবাইয়া নাসরীন মিলি | তারিখ: ২৯/০১/২০১৫

এই লেখাটি ইতিমধ্যে 5088বার পড়া হয়েছে।

আরবান মিথ বা লিজেন্ড এর আভিধানিক অর্থ হল শহুরে কিংবদন্তি ।সারা পৃথিবীতে নানা রকম আরবান মিথ প্রচলিত আছে নানা ঘটনা নিয়ে ।কোনটা ভৌতিক আবার কোনটা বা প্রেমকাহিনী । সাধারনত এই ঘটনা গুলো সত্যি হয় না । মানুষের মুখে মুখে রটে যায় অনেক কাহিনি যার বাস্তবতার সাথে কোন ধরনের সংশ্লিষ্টতা নাই।

পরী বিবি ,আনারকলি আর মমতাজ, তিন কিংবদন্তী নারীর নাম । এই নামগুলো জড়িয়ে আছে  মুঘল সালতানাতাত এর সাথে । এদের সমন্ধে নানারকম গল্প ছড়িয়ে আছে জড়িয়ে আছে সময়ের পরতে পরতে ,যার কতক বাস্তব আর অনেকগুলাই আরবান মিথ বা লিজেন্ড ।

পরী বিবি :   পরী বিবির ঘটনা রটনা জড়িয়ে আছে ঢাকার আওরঙ্গবাদ দুর্গের সাথে । বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত আওরঙ্গবাদ দুর্গ লালবাগ কেল্লা নামেই অধিক পরিচিত । এই কেল্লা ঢাকায় মুঘল স্থাপত্য রীতির এক চমৎকার নিদর্শন ।

 

 

লালবাগ কেল্লা

লালবাগ কেল্লা

মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব এর পুত্র মোহাম্মদ আজম শাহ যখন বাংলায় আসেন তখন এই দুর্গ নির্মাণের কাজ শুরু করেন । কিন্তু মাত্র পনের মাস এখানে অবস্থান করার পর  নির্মাণ কাজ শেষ হবার  আগেই তাকে পিতার ডাকে দিল্লিতে ফেরত যেতে হয় । তখন শায়েস্তা খান দুর্গের বাকি কাজ শেষ করার কাজে হাত দেন ।কিন্তু তার আদরের কন্যা ইরান দুখত রেহমত বানু  যিনি কিনা পরি বিবি নামে অধিক পরিচিত ,তার অকাল মৃত্যুতে ভেঙ্গে পড়েন আর দুর্গের নির্মাণ কাজ  অসমাপ্ত রয়ে যায় । পরি বিবি তার মৃত্যুর সময় শাহজাদা  আজমের বাগদত্তা ছিলেন ।

লালবাগ কেল্লা

লালবাগ কেল্লা

অবশ্য পরি বিবির পরিচয় সম্পর্কে আরেক রকম তথ্য পাওয়া যায় । কোন কোন গবেষক আর ইতিহাসবিদদের মতে পরি বিবি ছিলেন নয় বছর বয়সের এক আহম রাজকন্যা ।

তার পরিচয় যাই হোক না কেন ,মৃত্যুর পর এই দুর্গ আর পরিবিবির মাজার কে ঘিরে গড়ে উঠে নানা গল্প । স্থানীয় লোকজনের মুখে মুখে ছড়িয়ে পরে এক গল্প যে প্রতি ভরা পূর্ণিমার রাতে শাহজাদা আজমের টানে আজও পরি বিবি দুর্গের মাঝে আসেন । তিনি সারা দুর্গে নেচে ,গেয়ে ঘুরে বেড়ান । কিন্তু বাস্তবতা হলে আজ পর্যন্ত এই দৃশ্য কেউ দেখেছে এমন লোকের সন্ধান পাওয়া যায় নি ।  এর পুরাটাই আধিভৌতিক কিংবদন্তি ।

 

 আনারকলি  :   আনারকলি আর শাহজাদা সেলিমের প্রেম কাহিনী নিয়ে বাংলাদেশ,ভারত আর পাকিস্থানে কত যে সিনেমা নাটক আর সাহিত্য রচিত হয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নাই। শত বছর ধরে মুখে মুখে ঘুরে ফিরেছে এই বিয়োগান্তক করুন প্রেম গাঁথা । তবে মজার ব্যাপার হল বেশিরভাগ গবেষক আর ইতিহাসবেত্তার মতে এটা সম্পূর্ণ মনগড়া এক গল্প ।

আনারকলির কথা প্রথম উল্লেখ করেন দুই ব্রিটিশ পর্যটক উইলিয়াম ফিঞ্চ এবং এডওয়ার্ড টেরি । আনারকালির সম্ভাব্য  মৃত্যুর এগার বছর পর  ১৬১১ এর ফেব্রুয়ারী তে উইলিয়াম ফিঞ্চ লাহোর পৌঁছান । পরবর্তীতে তার লেখায় তিনি উল্লেখ করেন আনারকলির কথা। তার ভাষ্য অনুযায়ী আনারকলি ছিল একজন দাসি । পরাক্রমশালী বাদশাহ আকবর তার পুত্র শাহজাদা সেলিম এর এই দাসির সাথে প্রেম কিছুতেই মেনে নিতে পারেন নি। ফলে তিনি আনারকলি কে জীবন্ত কবর দেন চারপাশে দেয়াল গেথে।

 

আনারকলি মাজার লাহোর

আনারকলি মাজার —- লাহোর , পাকিস্থান  

 

আনারকলি আসলে ছিলেন ইরানের বাসিন্দা যে কিনা পরবর্তীতে লাহোর চলে আসেন। তার আসল নাম নাদিরা বেগম  অথবা শারফ উন নেসা। পরবর্তীতে আব্রাহাম ইরালি তার দি লাস্ট স্প্রিং দি লাইভস আন্ড টাইমস অফ দি গ্রেট মুঘলস  (The Last Spring: The Lives and Times of the Great Mughals )  বইতে উইলিয়াম ফিঞ্চ এবং এডওয়ার্ড টেরি এর বক্তব্য পর্যালোচনা করে এই সন্দেহ প্রকাশ করেন যে এই আনার কলি ছিলেন শাহজাদা দানিয়াল এর মা ,আকবরের এক উপপত্নী ।

 

শিল্পীর তুলিতে আনারকলি আএ শাহজাদা সেলিম

শিল্পীর তুলিতে আনারকলি আর শাহজাদা সেলিম

আনারকলির উল্লেখ সম্রাট আকবরের আত্মজীবনী আকবরনামা বা সম্রাট জাহাঙ্গীর  ( শাহজাদা সেলিম) এর আত্মজীবনী তুজক ই জাহাঙ্গিরি তে নাই ।

লাহোর পাস্ট এন্ড প্রেজেন্ট এর লেখক পণ্ডিত মুহাম্মাদ বাকির এর মতে আনারকলি আসলে এক বাগানের নাম । আনার মানে ডালিম আর কলি মানে ফুল । লাহোরের যেখানে আনারকলির মাজার আছে সেটা এক ডালিমের বাগান ছিল । পরবর্তীতে সময়ের পরিক্রমায় বাগানের নামেই মাজারের নাম হয়ে যায় আর লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে এক প্রেম কাহিনী ।

এই বাগানের কথা অবশ্য সম্রাট জাহাঙ্গীর এর নাতি দাড়া শিখো এর সাকিনাত আল আউলিয়া তে উঠে এসেছে । সেখানে বলা হয়েছে যে এই বাগানে পীর হজরত মিয়া মীর প্রায়ই বসতেন । তিনি এখানে এক কবরের উল্লেখ করলেও সেটা কার কবর তা পরিস্কার করে বলেন নি ।

সব কিছু মিলিয়ে এটা বলা যায় আনারকলির ঘটনা যেহেতু অধিকাংশ ইতিহাসবিদ মিথ বলে মনে করেন আর মুঘলদের জীবনীতেও এর উল্লেখ নাই তাই এটা আরবান মিথ হিসাবেই স্বীকৃত।

 

মুমতাজ মহল  :   মুমতাজমহল এর জন্ম  ১৫৯৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর আবুল হাসান আসফ খান এর ঘরে । তার নাম ছিল আরজুমান্দ বানু বেগম । পরবর্তীতে তার ফুপু নুর জাহান যিনি ছিলেন সম্রাট জাহাঙ্গীর (শাহজাদা সেলিম) এর সম্রাজ্ঞী ভাইয়ের মেয়ে আরজুমান্দ কে নিজের ছেলে খুররাম এর বাগদত্তা করে দেন ১৬০৭ সালে । এর পর তার বিয়ে হয় ১৬১২ সালের ১০ মে । তিনি ছিলেন খুররাম অর্থাৎ সম্রাট শাহজাহান  এর দ্বিতীয় ও সবচেয়ে প্রিয় পত্নী ,মুঘল সালতানাতের সম্রাজ্ঞী ।

মুমতাজ আর শাহজাহান

মুমতাজ আর শাহজাহান

 

 

১৬৩১ সালের সতের জুন তার ১৪তম সন্তান জন্মদানের সময় মুমতাজ মৃত্যু বরণ করেন ।প্রিয়তমা পত্নীর মৃত্যুতে শাহজাহান একদম ভেঙ্গে পড়েন ।

 

মুমতাজ আর শাহজাহান

মুমতাজ আর শাহজাহান

পরে তিনি মুমতাজ এর স্মরণে নির্মাণ করেন তাজমহল । তাজমহল শুধু ভারতেই নয় সারা পৃথিবীতে প্রেমের প্রতীক হিসাবে সমাদৃত । সাদা শ্বেত পাথরে নির্মিত এই সমাধি ভারতের উত্তর প্রদেশের আগ্রায় অবস্থিত । এর নির্মাণ কাল ১৬৩২ থেকে ১৬৫৩।

তাজমহল স্থাপত্য রীতির দিক থেকে ইসলামিক ,পার্সিয়ান অটোম্যান টার্কিশ ও ভারতীয় রীতির এক অপূর্ব মিশ্রন । ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো তাজমহলকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ঘোষণা করে।

 

তাজ মহল

তাজ মহল  আগ্রা ভারত 

ভারতকে বলা হয় ল্যান্ড অফ আরবান মিথ । তাই তাজমহল আর মুমতাজ শাহজাহানের প্রেম কথা নিয়েও রচিত হয়েছে ভিত্তিহীন বহু মিথ্যা কল্প কথা ।যে কল্প কথা গুলোকে ইতিহাসবেত্তা গন সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন । যেমন –

১। শাহজাহান মুমতাজকে বিয়ে করার জন্য তার আগের স্বামীকে হত্যা করেছে। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা।

২। শাহজাহান তাজমহলের নির্মাণ শ্রমিক দের হাত কেটে দিয়েছিলেন ,এটাও মিথ্যা ।এর সপক্ষে কোন প্রমান বা দলিল দস্তাবেজ পাওয়া যায় নাই ।

৩। শাহজাহানের আরেকটি কাল তাজ নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল । এটাকেও মিথ হিসাবেই দেখা হয় কারন এর কোন প্রমান ইতিহাসবিদ গন পান নাই।

৪। আরেকটি মিথ হল তাজমহল নির্মাণ করেছেন এক হিন্দু রাজা পারমার দেব ১১৯৬ সালে । পি এন অয়াক আর অমর নাথ মিশ্র নামক দুই বাক্তি এই মর্মে পিটিশন দায়ের করলে যথাক্রমে ২০০০ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট আর ২০০৫ সালে এলাহাবাদ হাই কোর্ট তা খারিজ করে দেয় ।

 

রটনা ঘটনা কিংবদন্তী যাই থাকুক না কেন এই তিন রমণী ইতিহাস আর সাহিত্য কে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি বহু মানুষের গবেষণা আর চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে।

 

তথ্য সুত্র :

 

Extracts from the Notes on the Antiquities of Dacca by  Sayid Aulad Hasan

Encyclopaedia of India, Pakistan and Bangladesh by Om Gupta .

The Archeological heritage of bangladesh. asiatic society of Bangladesh

 

Legend: Anarkali: myth, mystery and history

The Empire of the Great Mughals: History, Art and Culture   By Annemarie Schimmel

Lahor past and present By M .Baqir

Anarkali .. based on the Imtiaz Ali Taj play/script as adapted By Hakim Ahmad Shuja

The Taj Mahal     By Dutemple, Lesley A .

 Pakistan: Legacy of the Indian Khilafat movement

Taj Mahal   By UNESCO World Heritage Centre.

The Complete Taj Mahal: And the Riverfront Gardens of Agra  By   Koch, Ebba

A Teardrop on the Cheek of Time By Preston, Diana & Michael

 

 

 

৪,৭৭৩ বার পড়া হয়েছে

লেখক সম্পর্কে জানুন |
আমি মিলি ,ভাল লাগে বই পড়তে,ঘুরে বেড়াতে আর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে ।
সর্বমোট পোস্ট: ৩৮ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ৩৯৩ টি
নিবন্ধন করেছেন: ২০১৪-০৯-০৩ ১৫:৫৪:৫০ মিনিটে
banner

৬ টি মন্তব্য

  1. সুমন সাহা মন্তব্যে বলেছেন:

    প্রেমময় তথ্যসম্মৃদ্ধ একটি লেখা।

    প্রেম এসে মিথে মিশে
    ইতিহাসে ইতিহাসে
    চন্দ্রকোষে মেলে…..

    অনেক অজানা তথ্য জানা হলো।

    শুভেচ্ছা জানবেন মিলি।

    শুভকামনা। সবসময়।

  2. মিলি মন্তব্যে বলেছেন:

    ছন্দে ছন্দে ছন্দময় মন্তব্য এর জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ 🙂

  3. হাসান ইমতি মন্তব্যে বলেছেন:

    ভালো লাগলো লেখা …

  4. এই মেঘ এই রোদ্দুর মন্তব্যে বলেছেন:

    খুবই সুন্দর পোষ্ট ছিল তখন পড়িনি কেনো 🙁

    ভাল লাগল আপি

মন্তব্য করুন

মন্তব্য করতে লগিন করুন.

go_top