মৃত্যুবার্ষিকীর শ্রদ্ধাঞ্জলিঃ কবি অক্ষয়কুমার বড়াল
এই লেখাটি ইতিমধ্যে 2295বার পড়া হয়েছে।
অক্ষয়কুমার বড়াল (জন্ম: ১৮৬০ — মৃত্যু: ১৯শে জুন, ১৯১৯) একজন বিখ্যাত বাঙালি কবি। উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা কবি হিসেবে তিনি সর্বজন বিদিত। তার মৃত্যুবার্ষিকীতে চলন্তিকার পক্ষ থেকে আমরা গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাচ্ছি।
অক্ষয়কুমার বড়াল ১৮৬০ সালে বর্তমান ভারতের কলকাতার চোরবাগানে এক স্বর্ণব্যবসায়ীর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় কলকাতার হেয়ার স্কুলে। কিন্তু পড়াশোনায় তিনি উন্নতি করতে পারেননি। স্কুল শিক্ষা তিনি সমাপ্ত করতে পারেননি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশিদির না এগোলেও আমৃত্যু তিনি জ্ঞান আহরণে ব্রতী ছিলেন। এ হিসেবে তাকে একজন স্বশিক্ষিত মানুষ বলে আখ্যায়িত করা যায়। স্কুল ত্যাগের পর অক্ষয়কুমার দিল্লি অ্যান্ড লন্ডন ব্যাংকের হিসাব বিভাগের কর্মচারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এখানে কয়েক বছর চাকরি করার পর নর্থ ব্রিটিশ লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে হিসাব সহিব পদে যোগ দেন। এই পদ থেকেই তিনি অবসর গ্রহণ করেছিলেন। ১৯১৯ সালের জুন ১৯ তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
হেয়ার স্কুলের ছাত্র থাকা অবস্থায় অক্ষয়কুমার বড়াল বিহারীলাল চক্রবর্তীর কবিতার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। বিহারীলাল ছিলেন বাংলা গীতিকবিতার প্রবর্তক। তার অনুপ্রেরণায়ই জড়াল কবিতা রচনা শুরু করেছিলেন। বঙ্গদর্শন পত্রিকার ১২৮৯ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ সংখ্যায় তাঁর প্রথম কবিতা রজনীর মৃত্যু প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অক্ষয়কুমার বড়ালকে “বিহারীলালের সাক্ষাৎ ভাবশিষ্য” নামে আখ্যায়িত করা হয়। বাংলা গীতিকবিতার ইতিহাসে তিনি বড়াল কবি নামে পরিচিত। তার কাব্য রচনার মূল বিষয় ছিল নিসর্গ, সৌন্দর্যবাদ, কল্পনামূলক প্রেম, শোক এবং মানববন্দনা। নারীপ্রেমের শান্তরস তাঁর কাব্যের প্রধান বিশেষত্ব। তিনি মৃতা স্ত্রীর স্মৃতিচারণ করে এষা কাব্যগ্রন্থটি লিখেছিলেন। তিনি মার্জিত এবং বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তাধারার অনুসারী ছিলেন।
সুকুমার সেনের মতে ছন্দের চাতুর্যের দিকে বেশি ঝোঁক না থাকায় ভাবের প্রকাশ অকুন্ঠিত হয়েছে । তবে ভাবাবেগের তীব্রতায় কবি ভাষার উপর সর্বত্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে পারেন নি ।
স্বরচিত গ্রন্থ
প্রদীপ (১৮৮৪)
কনকাঞ্জলি (১৮৮৫)
ভুল (১৮৮৭)
শঙ্খ (১৯১০)
এষা (১৯১২)
চণ্ডীদাস (১৯১৭)
সম্পাদিত গ্রন্থ
রাজকৃষ্ণ রায়ের কবিতা (১৮৮৭)
গিরীন্দ্রমোহিনী দাসীর অশ্রুমালা (১৮৮৭)
আমরা তার বিখ্যাত মানব বন্দনা কবিতাটি এখানে শেয়ার করলাম
১
সেই আদি-যুগে যবে অসহায় নর
নেত্র মেলি ভবে,
চাহিয়া আকাশ পানে-কারে ডেকেছিল,
দেবে না মানবে?
কাতর আহ্বান সেই মেঘেমেঘে উঠি
লুটি গ্রহে গ্রহে,
ফিরিয়া কি আসে নাই, না পেয়ে উত্তর ধরায় আগ্রহে?
সেই ক্ষুব্ধ অন্ধকার, মরুত গর্জনে,
কার অন্বেষণ?
সে নহে বন্দনা-গীতি, ভয়ার্ত-ক্ষুধার্ত
খুঁজিছে স্বজন!
২
আরক্ত প্রভাত সূর্য উদিল যখন
ভেদিয়া তিমিরে,
ধরিত্রী অরণ্যে ভরা, কর্দমে পিচ্ছিল
সলিলে শিশিরে।
শাখায় ঝাপটি পাখা গরুড় চিৎকারে
কাণ্ডে সর্পকুল,
সম্মুখে শ্বাপদ-সংঘ বদন ব্যাদানি
আছাড়ে লাঙ্গুল,
দংশিছে দংশক গাত্রে, পদে সরীসৃপ
শূন্যে শ্যেন উড়ে;-
কে তাহারে উদ্ধারিল? দেব না মানব-
প্রস্তরে লগুড়ে?
৩
শীর্ণ অবসন্ন দেহ, গতিশক্তিহীন,
ক্ষুধায় অস্থির;
কে দিল তুলিয়া মুখে স্বাদু পক্ব ফল,
পত্রপুটে নীর?
কে দিল মুছায়ে অশ্রু? কে বুলাল কর
সর্বাঙ্গ আদরে?
কে নব পল্লবে দিল রচিয়া শয়ন
আপন গহ্বরে?
দিল করে পুষ্পগুচ্ছ, শিরে পুষ্পলতা,
অতিথি সৎকার!
নিশীথে বিচিত্র সুরে বিচিত্র ভাষায়
স্বপন সম্ভার!
৪
শৈশবে কাহার সাথে জলে স্থলে ভ্রমি
শিকার-সন্ধান?
কে শিখাল ধনুর্বেদ, বহিত্র চালনা
চর্ম পরিধান?
অর্ধদগ্ধ মৃগমাংস, কার সাথে বসি’
করিনু ভক্ষণ?
কাষ্ঠে কাষ্ঠে অগ্নি জ্বালি কার হস্ত ধরি
কুর্দন নর্তন?
কে শিখাল শিলাস্তূপে, অশ্বত্থের মূলে
করিতে প্রণাম?
কে শিখাল ঋতুভেদ, চন্দ্রে-সূর্যে মেঘে
দেব-দেবী নাম?
৫
কৈশোরে কাহার সাথে মৃত্তিকা কর্ষণে
হইনু বাহির?
মধ্যাহ্নে কে দিল পাত্রে শালি অন্ন ঢালি’
দধি-দুগ্ধ-ক্ষীর?
সায়াহ্নে কুটিরদ্বারে কার কণ্ঠ সাথে
নিবিদ উচ্চারি?
কার আশীর্বাদ লয়ে অগ্নি সাক্ষী করি’
হইনু সংসারী-?
কে দিল ঔষধি রোগে, ক্ষতে প্রলেপন-
স্নেহে অনুরাগে?
কার ছন্দে-সোম গন্ধে-ইন্দ্র অগ্নি বায়ু
নিল যজ্ঞ ভাগে?
৬
যৌবনে সাহায্যে কার নগর পত্তন,
প্রাসাদ নির্মাণ?
কার ঋক্ সাম যজুঃ চরক সুশ্রুত,
সংহিতা পুরাণ
কে গঠিল দুর্গ, সেতু, পরিখা, প্রণালী,
পথ, ঘাট, মাঠ?
কে আজ পৃথ্বীরাজ-জলে স্থলে ব্যোমে
কার রাজ্য পাট?
পঞ্চভূত বশীভূত, প্রকৃতি উন্নীত
কার জ্ঞানে বলে?
ভুঞ্জিতে কাহার রাজ্য-জন্মিলেন হরি
মথুর কৌশলে?
৭
প্রবীণ সমাজ পদে, আজি প্রৌঢ় আমি
জুড়ি দুই কর,
নমি, হে বিবর্তবুদ্ধি! বিদ্যুৎ-মোহন,
বজ্রমুষ্টিধর!
চরণে ঝটিকাগতি ছুটিছ উধাও
দলি নীহারিকা।
উদ্দীপ্ত তেজসনেত্র-হেরিছ নির্ভয়ে
সপ্তসূর্য শিখা।
গ্রহে গ্রহে আবর্তন-গভীর নিনাদ
শুনিছ শ্রবণে?
দোলে মহাকাল-কোলে অণু পরমাণু
বুঝিছ স্পর্শনে?
৮
নমি, হে সার্থক কাম! স্বরূপ তোমার
নিত্য অভিনব!
মর দেহ নহ মর, অমর অধিক
স্থৈর্য ধৈর্য তব?
লয়ে সলাঙ্গুল দেহ, স্থূলবুদ্ধি তুমি
জন্মিলে জগতে!
শুষিলে সাগর শেষে, রসাইলে মরু
উড়ালে পর্বতে!
গড়িলে আপন মূর্তি-দেবতালাঞ্ছন
কালের পৃষ্ঠায়!
গড়িছ ভাঙ্গিছ তর্কে, দর্শনে, বিজ্ঞানে
আপন স্রষ্টায়!
৯
নমি, হে বিশ্বগ ভাব! আজন্ম চঞ্চল,
বিচিত্র, বিপুল!
হেলিছ-দুলিছ সদা, পড়িছ আছাড়ি;
ভাঙ্গি সীমা-কূল!
কি ঘর্ষণ-কি ধর্ষণ, লম্ফন-গর্জন,
দ্বন্দ্ব মহামার!
কে ডুবিল-কে উঠিল, নাহি দয়ামায়া,
নাহিক নিস্তার!
নাহি তৃপ্তি, নাহি শ্রান্তি, নাহি ভ্রান্তি ভয়।
কোথায়-কোথায়!
চিরদিন এক লক্ষ্য,-জীবন বিকাশ
পরিপূর্ণ তায়!
১০
নমি তোমা নরদেব, কি গর্বে গৌরবে
দাঁড়িয়েছ তুমি!
সর্বাঙ্গে প্রভাতরশ্মি, শিরে চূর্ণ মেঘ,
পদে শষ্প ভূমি।
পশ্চাতে মন্দির-শ্রেণী, সুবর্ণ কলস,
ঝলসে কিরণে;
কলকণ্ঠ-সমুত্থিত নবীন উদ্গীথ
গগনে পবনে।
হৃদয-স্পন্দন সনে ঘুরিছ জগৎ,
চলিছে সময়;
ভ্রূভঙ্গে-ফিরিছ সঙ্গে-ক্রমব্যতিক্রম
উদয়-বিলয়।
১১
নমি আমি প্রতিজনে,-আদ্বিজ চণ্ডাল,
প্রভু, ক্রীতদাস!
সিন্ধুমূলে জলবিন্দু, বিশ্বমূলে অণু;
সমগ্রে প্রকাশ।
নমি কৃষি-তন্ত্রজীবী, স্থপতি, তক্ষক,
কর্ম, চর্মকার।
অদ্রিতলে শিলাখণ্ড-দৃষ্টি অগোচরে,
বহু অদ্রি-ভার!
কত রাজ্য, কত রাজা গড়িছ নীরবে
হে পূজ্য, হে প্রিয়!
একত্বে বরেণ্য তুমি, শরণ্য এককে.-
আত্মার আত্মীয়।
তথ্যসূত্র
বাঙ্গালা সাহিত্যের কথা – শ্রী সুকুমার সেন – সপ্তম সংস্করণ পৃষ্ঠা: ২৫০
২,২২৩ বার পড়া হয়েছে
শ্রদ্ধাঞ্জলি রইল।
ধন্যবাদ প্রয়োজনীয় এবং সুন্দর একটি পোষ্টের জন্য। কবি অক্ষয় কুমার বড়াল সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম।
“কাব্য নয়, চিত্ত নয়, প্রতিমূর্তি নয়,
ধরণী চাহিছে শুধু -হৃদয় – হৃদয়।”
মানব-বন্দনার এ হৃদয়বান কবির স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন প্রশংসার দাবীদার। বাংলা সাহিত্যের স্মর্তব্য সকল জনের জন্য এ মনোযোগ দাবী করি।