বাংলার সাহিত্য ও ইতিহাসের আলোকবর্তিকা সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর মৃত্যুবার্ষিকী আজ
এই লেখাটি ইতিমধ্যে 1947বার পড়া হয়েছে।
বাংলার ইতিহাস, বাংলাদেশের ইতিহাস, বাঙালির ইতিহাস, বাংলাদেশের মুসলমানদের ইতিহাস, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাস, উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক জাজ্বল্যমান তারকার নাম সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী। ব্রিটিশ আমলেই জন্ম, আর ব্রিটিশ আমলেই মৃত্যু তাঁর। স্বাধীনতার স্বাদ নিতে পারেননি। মুক্ত বিহঙ্গের মতো মুক্ত আকাশে ডানা মেলতে পারেননি। কিন্তু মুক্তচিন্তার অধিকারী এ স্বাপ্নিক মানুষটি মুক্তির চেতনায় ছিলেন সদা বিভোর। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু কলকাতা এলবার্ট হলে বলেছিলেন, ‘‘হিন্দু মুসলমানের অন্তরে সমভাবে দেশপ্রেম সৃষ্টির কাজে যাঁহারা আমাদের পথ প্রদর্শন করিয়াছেন নিঃসন্দেহে সিরাজী সাহেব তাহাদের অগ্রণী। ‘আপনি আচরি ধর্ম জীবের শিখায়’ এই কথা কয়টি সিরাজী সাহেবের জীবন সম্পর্কে নিখুঁতভাবে খাটে।’ স্বাধীনতার প্রত্যাশায় জেল-জুলুম, টর্চার সেল, নির্যাতন, নিপীড়ন কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করেননি। মানবতার মুক্তি এবং মানবাধিকার রক্ষার জন্য দেশব্যাপী চষে বেড়িয়েছেন এই হৃদয়বান মানুষটি। সরকারের হুমকি কিংবা পুলিশের ডান্ডাবেরী তাঁর কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে পারেনি। মুসলিম জাতির হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারে তাঁর কলম চালিত হয়েছিলো অপ্রতিহত গতিতে। তাঁর কলমের তুলিতে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে ওঠেছে ইসলামের ইতিহাস ঐতিহ্য আর শান শওকত। তিনি বলেছেন, মুসলমানদেরকে বিশ্ব সভ্যতায় স্থান নিতে হলে তাদের ডান হাতে কুরআন আর বাম হাতে বিজ্ঞান নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। আজ তার মৃত্যুবার্ষিকীতে চলন্তিকার পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
মহান নেতা সিরাজীর জন্ম ১৮৮০ সালের ১৩ জুলাই সিরাজগঞ্জে। লেখাপড়া করেন জ্ঞানদায়িনী মাইনর স্কুল এবং বিএল হাইস্কুলে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অনল প্রবাহ’ মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহর সহযোগিতায় ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত হয়। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৯ বছর। ১৯০৮ সালে কাব্যগ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হলে কাব্যে রাজদ্রোহ প্রচার এবং মুসলমান সমাজের মধ্যে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগে ১৯১০ সালের মার্চে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়। একই বছরের ০৯ সেপ্টেম্বর সশ্রম কারাদন্ড প্রদান। ১৯১২ সালের ১৪মে হাজারীবাগ জেল থেকে কারামুক্তি। সিরাজীই উপমহাদেশের প্রথম কবি যিনি স্বাধীনতার জন্য, জাতীয় জাগরণের জন্য কবিতা লিখে জেলের ঘানি টানেন। শুধু তাই নয় তাঁর কণ্ঠ রোধ করার জন্য তাঁর বক্তৃতা ও সভাস্থলে ব্রিটিশ সরকার ৮২ বার ১৪৪ ধারা জারি করেছিলো।
সিরাজী ছিলেন স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরী। আজীবন কংগ্রেসের রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ইংরেজদের হটাবার জন্য, স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যের জন্য তিনি কলম হাতে নিয়েছিলেন শৈশবকালেই। বড় হয়ে লেখনী আর ভাষণ দুটোই একত্রে চালিয়েছিলেন। তাঁর বাগ্মীতায় ব্রিটিশ সিংহাসন কেঁপে ওঠত। কলকাতায় কংগ্রেসের মহারাষ্ট্রীয় মহাসভার অধিবেশনে তিনি যোগদান করেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন লালা লাজপত রায়। সম্মেলনের অহিংস-অসহযোগের প্রস্তাব উঠলে ডাঃ এ্যানিবেশান্ত ও বিপিনচন্দ্র পাল এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেন, আর একবার ইংল্যান্ডে ডেপুটেশন পাঠিয়ে দেখা যাক।’ এই কথা বলামাত্র সিরাজী বারুদের ন্যায় জ্বলে উঠে বজ্রহুঙ্কারে বলেন, ‘I challenge you Mr. Poul? How many times do you wish to send deputation to England for India? Young generation do not like to hear you!’
এই কথা বলামাত্র কংগ্রেস মহলে হৈ চৈ পড়ে যায়। মি” পাল পুনরায় বলতে আরম্ভ করলে তিনি বলেন, ‘ Mr. President ! We do not wish to hear any single sold from Mr. Poul.’ মিসেস বৈশান্ত বলতে উঠলেও তিনি তীব্র আপত্তি করেন। সভাসুদ্ধ লোক সিরাজী সাহেবকে সমর্থন করতঃ ‘শেম’ ! ‘শেম’! করে বৈশান্তকে বসিয়ে দেয়। অতঃপর মহাত্মা গান্ধী বক্তৃতা করেন। তার তেজস্বীতা সন্দর্শনে বাঙালি মাত্রই বিশেষ উৎসাহিত হন।’
সিরাজী রচিত কাব্য, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনী ও সঙ্গীত বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থের সংখ্যা ৩২টি। এগুলো হলো- কাব্যগ্রন্থ উচ্ছ্বাস (১৯০৭), নব উদ্দীপনা (১৯০৭), উদ্বোধন (১৯০৮), স্পেন বিজয় কাব্য (১৯৮৪), মহাশিক্ষা কাব্য প্রথম খন্ড (১৯৬৯), মহাশিক্ষা কাব্য দ্বিতীয় খন্ড (১৯৭১)। উপন্যাস- রায়নন্দিনী (১৯১৫), তারাবাঈ (১৯১৬), নূরউদ্দীন (১৯১৯)। প্রবন্ধ গ্রন্থ- মহানগরী কর্ডোভা (১৯০৭), স্ত্রীশিক্ষা (১৯০৭), আদব কায়দা শিক্ষা (১৯১৪), সুচিন্তা প্রথম খন্ড (১৯১৬), তুর্কি নারী জীবন (১৯১৩), ভ্রমণ কাহিনী- তুরস্ক ভ্রমণ (১৯১৩)। সঙ্গীত গ্রন্থ- সঙ্গীত সঞ্জীবনী (১৯১৬), প্রেমাঞ্জলী (১৯১৬) প্রভৃতি। অপ্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ- সুধাঞ্জলী, গৌরব কাহিনী, কুসুমাঞ্জলী, আবে হায়াৎ, কাব্য কুসুমোদ্যান, পুস্পাঞ্জলী। অসমাপ্ত উপন্যাস- বঙ্গ ও বিহার বিজয় এবং জাহানারা।
১৯৩১ সালের ১৭ জুলাই মাত্র ৫১ বছর বয়সে অগ্নিপুরুষ সিরাজী ইন্তিকাল করেন। তাঁর জীবনাবসানে ব্রিটিশ সরকার হারায় তাদের শক্তিশালী প্রতিদ্বনদ্বীকে, অন্যদিকে বাঙালিরা হারায় তাদের শ্রেষ্ঠ সুহৃদকে। তাঁর অকাল মৃত্যুতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট কামাল আতাতুর্ক পুত্র আসাদউদ্দৌলা সিরাজীকে এক শোকবাণীতে বলেন, ‘আমার পুরাতন বন্ধু সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর মৃত্যুতে আমি গভীরভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি। তিনি যে কেবল ভারতের গৌরব ছিলেন তাই নয়, তিনি ইসলাম জগতের নেতা ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে ইসলাম জগতে এক মহান ব্যক্তির অভাব হলো। তুর্কিগণ আপনার শোকে সহানুভূতি প্রকাশ করছে ……….’।
১৯৪০ সালের ২২ মার্চ কলিকাতা ২/১ ইউরোপিয়ান অ্যাসাইলাম লেনে, সিরাজী পাবলিক লাইব্রেরী ও ফ্রি রিডিং রুম- এর উদ্বোধন করা হয়। উক্ত দ্বারোঘাটন অনুষ্ঠানে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রদত্ত সভাপতির ভাষণে বলেন, ‘সিরাজী সাহেব ছিলেন আমার পিতৃতুল্য। তিনি আমাকে ভাবিতেন জ্যেষ্ঠ পুত্র-তুল্য। তাঁহার নিকট যে স্নেহ আমি জীবনে পাইয়াছি তাহা আমার জীবনের পরম সঞ্চয়। ফরিদপুর কনফারেন্সে তাঁহার সহিত আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। তাঁহার সমগ্রজীবনই ছিল অনল প্রবাহ এবং আমার রচনায় সেই অগ্নি স্ফুলিঙ্গের প্রকাশ আছে। সাহিত্যিক ও রাজনীতিক ছাড়াও আমার চোখে তিনি প্রতিভাত হয়েছিলেন এক শক্তিমান দরবেশ রূপে। মৃত্যুকে তিনি ভয় করেন নাই, তুরস্কের রণক্ষেত্রে তিনি সেই মৃত্যুর সঙ্গে করিয়াছিলেন মুখোমুখি। তাই অন্তিমে মৃত্যু তাঁহার জন্য আনিয়া দিয়াছিল মহাজীবনের আস্বাদ।’
বাংলাদেশের জন্য বড় দুর্ভাগ্য যে আমাদের রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা মহান পুরুষ সিরাজীকে হীনমন্যতার কারণে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ। দেশের মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল পাঠ্যসূচিতে সিরাজী রচনাবলী উপেক্ষিত। সিরাজীর লেখা থেকে বঞ্চিত এদেশের শিক্ষার্থীরা। সিরাজী সম্পর্কে তরুণ সমাজকে জানতে দেয়া হচ্ছে না। অথচ সিরাজীর অনলবর্ষী বক্তৃতায় প্রকম্পিত হয়েছিলো ব্রিটিশ সিংহাসন। তাঁর কণ্ঠ ও লেখা থেকে বারুদের গন্ধ বের হতো। তাঁর বক্তৃতায় জেগে ওঠেছিলো লাখো লাখো তরুণ। সেখানে মুসলিম বা হিন্দু বলে কোনো প্রশ্নের সৃষ্টি হয় নাই। ব্রিটিশ রাজ শুধু তাঁকে কারাবন্দীই করেনি, তার কবিতাও নিষিদ্ধ করেছিলো। সেই স্বাধীনচেতা মহাকবিকে স্বাধীন রাষ্ট্রের কর্ণধাররা অবমূল্যায়ন করছেন। যারা মুসলমানদেরকে লাইভস্টক বা গৃহপালিত পশু বলে আখ্যায়িত করছে, যারা আমাদেরকে কাক পক্ষী, দস্যু, তস্কর, দানব, অসুর, অনার্য, ইতর, নরপশু, ডাকাত বলে গালি দিয়েছে তাদের জন্ম-মৃত্যু বার্ষিকী ঘটা করে পালন করা হয়। তাদের লেখা গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাটক পড়তে বাধ্য করা হচ্ছে কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের। অথচ সিরাজীর মত মহানায়কের রচনাবলী পাঠ্য বহির্ভূতই থেকে যাচ্ছে। বর্তমান বাংলাদেশের ক্রান্তিকালীন দুর্বিষহ অবস্থার প্রেক্ষিতে সিরাজীর মতো বিপ্লবী পুরুষের প্রসঙ্গ টেনে আনা অতীব জরুরী। ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এস. এম. লুৎফর রহমান লিখেছেন, ‘বাংলাদেশী জাতি সৃষ্টির এই গঠনকালে সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর উদারতা, দৃঢ়তা, অসাম্প্রদায়িকতা, স্বাতন্ত্র্যবাদ, ঐতিহ্য চেতনা, সংস্কৃতি চেতনা, বিজ্ঞান-ইতিহাস ও সাহিত্য-চেতনা প্রভৃতি থেকে প্রেরণা আহরণ একান্ত কর্তব্য। ঊনবিংশ শতাব্দির প্রথম দশক থেকে চল্লিশের দশক পর্যন্ত সারা উপমহাদেশের মুসলমানদের মনে যে জাতীয় ঐক্যবোধ, জাগরণ স্পৃহা আপন জাতীয় সত্ত্বার পরিচয় ফুটিয়ে তোলার আকাক্মখা এবং সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতিতে যে প্রতিষ্ঠা অর্জনের প্রয়াস তীব্র আবেগে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিল, আজকের স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবোধের প্রেক্ষিতে সেই উদ্যম নিষ্ঠা ও কর্ম-চাঞ্চল্য একান্ত আবশ্যক হয়ে উঠেছে। আবশ্যক হয়ে উঠেছে আজ আবার নতুন করে ঘনিয়ে ওঠা বিভ্রান্তির, দিশাহীনতার দিগন্তের কালো আবরণ ভেদ করে আলোকবন্যা আবাহনের জন্য নতুন করে গর্জে ওঠা হাজার হাজার সিরাজীর।’
তথ্যসুত্র –
১. নাজনীন মহল অঞ্জনা : সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী আমাদের চেতনার অগ্নিপুরুষ, দৈনিক আমাদের কণ্ঠ, গ্রীষ্ম সংখ্যা-১৪১৫।
২. সিরাজীচরিত : এম সেরাজুল হক, সিরাজী রচনাবলী, বাংলা একাডেমী, ঢাকা/ উদ্বৃতি- ঐ
৩. মাসিক প্রবাসী, ভাদ্র ১৩৩৮/উদ্বৃতি- সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, হোসেন মাহমুদ সম্পাদিত, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, জুন ২০০৩, পৃষ্ঠা ৫১৯।
৪. নজরুল রচনাবলী, চতুর্থ খন্ড, বাংলা একাডেমী ঢাকা, নতুন সংস্করণ মে ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ১১৬
৫. মুসলিম নবজাগরণে সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী- ড. এস. এম. লুৎফর রহমান : সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, হোসেন মাহমুদ সম্পাদিত, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, জুন ২০০৩, পৃষ্ঠা ২০৪।
২,০৮০ বার পড়া হয়েছে
বাংলা সাহিত্য ও ইতিহাসের আলোকবর্তিকা সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলী।
আমিও আমির ভাইয়ের সাথে একমত।
অনেক অনেক শ্রদ্ধা ।
শ্রদ্ধাঞ্জলী ।