ভৌতিক উপাখ্যান
এই লেখাটি ইতিমধ্যে 1350বার পড়া হয়েছে।
(নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া সত্য ঘটনা নিয়ে লেখা গল্প—এমন কি ঘটনার স্থানকাল-পাত্রও সত্যের ওপর আধারিত। এ ক্ষেত্রে পাঠকের বিশ্বাস অবিশ্বাস সম্পূর্ণ তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।)
উমেশ বৈদ্যকে চিনতাম। ও ছিল আমারই এক ক্যাম্পে। আমি তখন সরকারের তরফ থেকে ওদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে, সেবক পদে বহাল ছিলাম।
দণ্ডকারণ্য প্রজেক্টের কথা বলছি। বোধহয় সেটা ১৯৭০ সালের কথা। বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত কিছু পরিবার ভারতে আশ্রয় নিয়ে ছিল। ভারত সরকার তাদের পুনর্বাসনের জন্যে পাঠিয়ে ছিল দণ্ডক বনে। উদ্দেশ্য উদ্বাস্তু পরিবারদের পুনর্বাসের ব্যবস্থা করা।
ক্যাম্পে স্কুল ছিল,স্কুলের এক মাত্র শিক্ষক ছিল–বেণু ভূষণ সরকার। বেলদার ছিল,প্রফুল্ল বলা। আর ছিল ফার্মাসিস্ট,ভদ্র বাবু। সবাই সরকারী স্টাফ।
উমেশ আমার কোয়াটারের পাশ দিয়ে যাবার সময় প্রায়ই আমায় ডাক দিয়ে যেত,সেবক বাবু,তাস খেলতে যাবেন নাকি?
আমি এ ব্যাপারে নিরস লোক ছিলাম। তাস খেলা আমি জানতাম না। আর এ জন্যেই যেন উমেশ অনেকটা রসিকতা করেই আমায় একবার ডেকে যেত। তাসের আড্ডায় আমি যেতাম না–বাকী স্টাফরা যেত।
এমনি চলছিল–ইতিমধ্যে জেনে ছিলাম উমেশ ও লক্ষ্মীর দেশ বাড়িতে প্রেম বিবাহ হয়ে ছিল। ওরা একই স্কুলের দু ক্লাস ওপরে নিচে পড়ত। দাম্পত্য জীবনের দিনগুলিও ওদের ভালই কাটছিল।
ইদানীং দেখতাম উমেশ বেশ মনমরা হয়ে থাকত। জিজ্ঞেস করেছিলাম,কি শরীর ভাল আছে তো?
ম্লান হেসে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেছিল,চলছে সেবক বাবু–বিশেষ একটা ভাল নেই!
জিজ্ঞেস করলাম,তাস খেলা ছেড়ে দিয়েছ নাকি?
–বিশেষ একটা খেলি না–আজকাল কিছু তেমন ভাল লাগে না, উমেশ উত্তর দিয়ে ছিল।
আমি তখন অবিবাহিত ছিলাম। উমেশ মাঝে মাঝে আমার কুয়াটারে এসে বসত। তার সুখ দুঃখের দু চারটে কথা আমায় বলত। স্ত্রীকে খুব ভালবাসে ও—ওর ধারণা ছিল,স্ত্রীর ভালবাসা তার ওপর থেকে দিনকে দিন কমে যাচ্ছে ! বিয়ের পর এই পাঁচ বছরে ওদের কোন সন্তান হয় নি বলে ওর স্ত্রী অসুখী।
উমেশ বলেছিল,জানেন,লক্ষ্মী আমায় ছেড়ে চলে যাবে বলেছে ! উমেশের চোখে দুঃখের ছায়া দেখে ছিলাম।
এরপর মাসখানেক কেটে গেল। একদিন সকালে উমেশ হন্তদন্ত হয়ে আমার কাছে এসে কেঁদে বলল,জানেন সেবক বাবু ! আমার বউ আমায় ছেড়ে চলে গেছে !
আশ্চর্য হয়ে বললাম,সে কি ! কোথায় ?
–শেডল–বাপের বাড়ি–আর কিছু বলার মত ওর অবস্থা ছিল না। কান্নায় ভেঙে পড়ে ছিল উমেশ।
এ ঘটনার দু দিন পরের কথা। ক্যাম্পের কয়েকজন সকাল সকাল আমার কোয়াটারের সামনে এসে দাঁড়ালো। ওরা নিজেদের মধ্যে কিছু বলাবলি করছিল। আমি ঘরের দরজা খুলতেই একজন বলে উঠলো,সেবক বাবু ! উমেশের ঘরের দরজা বন্ধ–ও দরজা খুলছে না !
আমার বুক যেন ধক করে উঠলো।
ওরা বলল,আপনি শিগগির আসুন সেবক বাবু !
আমি প্রফুল্ল,বেণুকে ডেকে নিয়ে উমেশের ঘরের দিকে রওনা হলাম।
ক্যাম্পের ঘর টেম্পোরারি মাটির দেওয়াল,টিনের চালার তৈরি। কাঠের দরজা হলেও মজবুত কিছু না। আমরা সবাই উমেশের জীবন সংশয়ের কথা ধরেই নিয়ে ছিলাম। তাই বললাম,দরজা ভাঙো তোমরা।
দরজা ভেঙে দেখা গেল উমেশ ফাঁসিতে ঝুলছে ! আগেই মারা গেছে। জিভ মুখের বাইরে ঝুলে পড়েছে। চোখ দুটো ঠিকরে পড়ার অবস্থা। বেচারা এতটাই কি দুঃখ পেয়েছিল ! দুঃখ তো যার যার নিজের কাছে–কতটা গভীর বাইরে থেকে তা বোঝা যায় না।
পুলিশে খবর দেওয়া হল। পুলিশ এসে স্টেটমেন্ট নিয়ে পঞ্চনামা লিখে দেহ পোস্টমর্টেমের জন্যে পাঠিয়ে দিল।
গল্প এখানেই শেষ হয়ে যাবার কথা ছিল। কিন্তু আসল গল্প শুরু হল এখান থেকেই।
আমি,বেণু আর প্রফুল্ল বিকেলের দিকে হাঁটার অভ্যাস করে ছিলাম। ইভনিং ওয়াক আর কি !
উমেশ বৈদ্যের মৃত্যুর দিনও যাব না,যাব না,করেও শেষে হাঁটতে বেরিয়ে গিয়ে ছিলাম। তিন কিলোমিটার হেঁটে পর পর দুটো গ্রাম পার করে ফেরার পথ ধরলাম। প্রফুল্লর একটা দোষ ছিল। হাঁটতে গেলেও সঙ্গে সাইকেল রাখত। অনেক টোকার পরেও সে অভ্যাস তার যায় নি।
তিনজনই ফিরে আসছিলাম কোয়াটারের দিকে।
দন্ডকবনের গ্রাম,ক্যাম্পগুলি প্রায়ই জঙ্গলের মাঝে মাঝে বসানো। আমাদের জঙ্গল পথেই হাঁটতে হয়।
সে দিন প্রায় কোয়াটারের কাছাকাছি এসে গেছি। দু পাশে ক্যাম্পের আশপাশটায় বেশ হালকা জঙ্গল। ছোট ছোট গাছ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
আমি হঠাৎ থমকে দাঁড়ালাম–আমার চোখে পড়ল,স্পষ্ট চোখে পড়ল,উমেশ বৈদ্য–উমেশ বৈদ্য জঙ্গলের ভিতর থেকে আসছে !
থমকে ছিলাম আমি। দিনের আলো তখনও স্পষ্ট—সন্ধ্যের ছায়া তখনও আসে নি।
ভীষণ ভয় পেলাম,বেণুর একটা হাত চেপে ধরলাম।
–বেণু !-বলে চাপা চীৎকার করে ডেকে উঠলাম।
দেখি বেণুও থমকে দাঁড়িয়ে আছে–তার চোখও উমেশের দিকে মনে হল।
হ্যাঁ,বেণু দেখেছে–তার মুখ থেকে ভীত কাঁপা কণ্ঠ বেরিয়ে এলো,হ্যাঁ !
তত সময় দেখি উমেশের ছায়াশরীর আমাদের দিকেই আসছে। ওর পরনে সব সময়ের মত সাদা ধুতি আর গেঞ্জি। প্রফুল্ল কিছু লক্ষ্য করে নি। ও আমাদের ছেড়ে সাইকেল হাতে অনেকটা এগিয়ে গিয়ে ছিল।
উমেশ বৈদ্য আসছে–আমাদের দিকেই আসছে !
মনে হচ্ছিল ভয়ে আমার মাথার সমস্ত চুল দাঁড়িয়ে গেছে। দুজনেই আমরা হতবাক। এ অলৌকিক দৃশ্য কোন দিন নিজের চোখে দেখতে পাব তা স্বপ্নেও ভাবি নি। ভয় হচ্ছিল আমি জ্ঞান না হারিয়ে ফেলি। এদিকে উমেশ আমাদের থেকে হাত পাঁচ সাত দূরত্বের মধ্যে এসে গেছে।
আচমকা সঙ্কটে মানুষ বুদ্ধিভ্রংশ হয় বটে,কিন্তু কিছুটা স্থিতির পর তার মধ্যে বাঁচার শেষ প্রয়াসের নাকি তাগিদ আসে। আমার বেলাতেও তাই হল,আমার অবচেতন মন যেন বলে উঠলো, নিজেকে বাঁচাতে হবে—
সঙ্গে সঙ্গে রাস্তা থেকে পাথরের ঢিল তুলে নিলাম। তারপর পাগলের মত ছুঁড়তে লাগলাম বিদেহী উমেশের দিকে। সে সঙ্গে গলা ফেড়ে জীবনের জানা সমস্ত গালি দিয়ে যেতে লাগলাম।
পাথরের ঢেলা উমেশের ছায়াশরীরে লেগেছিল কিনা বুঝতে পারি নি–দেখলাম,উমেশের দেহ প্রথমটায় কেঁপে উঠলো—কয়েক বার কেঁপে উঠে হওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে গেল!
বেণু স্তব্ধ হয়ে স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে ছিল। এবার নড়ে উঠলো।
আমি ভাঙা অস্পষ্ট গলায় বলে উঠলাম,দেখলি?
তখনও,হ্যাঁ,শব্দটুকু দীর্ঘ শ্বাস ফেলার মত করে কোন মত বলতে পেরেছিল বেণু।
উমেশের দেহের ছায়া,মানুষের দেহের রঙের ছায়ার মতই ছিল,ওর পরনের গেঞ্জি ও ধুতি সাদা রঙেরই ছিল। অনেকটা আমাদের দেখা পুরনো দিনের সিনেমার রিল কেটে যাওয়া ছবির মত—উমেশের দেহ কাঁপতে কাঁপতে অদৃশ্য হয়ে গিয়ে ছিল !
জীবনের এ অভিজ্ঞতা কখনও ভোলার নয়।
সমাপ্ত
১,৬০৮ বার পড়া হয়েছে
পড়তে ভাল লেগেছে আপনার ভৌতিক অভিজ্ঞতার ঘটনা।সে আপনর লিখার দক্ষতার কারনে।আমার প্রশ্ন অন্য জায়গায় আপনি কি চিতায় দাহ করার সময় ছিলেন? আপনি কি নিশ্চিত ছিলেন যে উমেশ মারা গিয়েছে।হয়তবা কাদম্বরীর ঘটনার মত তো হতে পারে।আমি এসব গল্প কখন ও বিশ্বাস করিনা। হয়তবা উমেশের কথা ভাবতে ভাবতে আপনি অনেকটা অবসেসড হ্যালুসিনেটেড হয়ে ছিলেন যার কারনে তাকে দেখেছেন।
তবে বরাবরের মত আপনার লিখার ষ্টাইলটা চমৎকার।
ঐ যে বললাম,বিশ্বাস আবিস্বাস নিজের ওপর–না,তার দাহ কাজ ক্যাম্পের লোকরাই করেছে।তবে ময়নাতদন্তের পর উমেশের কাঁটাছেঁড়া লাশ দেখেছি।হ্যালুসিনেটেড হবার প্রশ্ন ছিল না–কারণ উমেশের আত্মাকে একই সময় একই অবস্থায় আমি ও বেণু দুজনে দেখেছি।হ্যালুসিনেশানে এমনটা হয় না।
বাপরে কি ভয়ংকর…
এমনো কি হতে পারে
… লেখা ভাল লেগেছে
আমি জীবন ভর বিশ্বাস করতে বাধ্য থাকব। আপনাকে আমার গল্পে এবারই কি প্রথম পেলাম?অনেক ধন্যবাদ।
ভৌতিক উপাখ্যান ভাল লাগল। আরো লিখুন।
হ্যাঁ,আরও লেখার ইচ্ছে আছে।ধন্যবাদ।
চমত্কার হয়েছে ভৌতিক গল্পটি।ভাল লাগা জানালাম ।
চমৎকার,শব্দটি শুনতে কার না ভাল লাগে।এ জন্যে আপনাকে জানাই ধন্যবাদ।