‘ মেঘের কোলে রোদ ’ । ( পর্ব -২)
এই লেখাটি ইতিমধ্যে 1401বার পড়া হয়েছে।
।। ফকির কালাচান ।।
মৈমনসিং জেলার ব্রহ্মপুত্র নদীর ধারে পুর্বধলাপুর গ্রামে একমাত্র হাটটির অর্ধেক নদীর ভাঙ্গনে নদীগর্ভে বিলীণ হয়ে গেছে অনেক আগেই । যে টুকু হাটের অংশ বাকী আছে – তা যে কোনসময় ভাঙ্গনের কবলে পড়বে এতে কোন সন্দেহ নেই । এই হাটের পার্শ্বেই বাড়ী ছিল ফকির কালাচানের । বাড়িতো নয় অর্ধেক বাড়ি অর্ধেক দোকান । মুদিখানা থেকে শুরু করে সাংসারিক ব্যবহার্য্য সব ধরনের সামগ্রী দোকানে রাখা । দোকানে বেচা বিক্রি হতো বেশুমার । ফকির কালাচানের বাবা সাকেদ আলী ফকির জোয়ান বয়সে জিদ করে কাকে যেন খুন করে ফেরারী হয়ে ব্রিটিশ আমলে আসাম রাজ্যের ধুবগুড়ি এলাকার বাপদাদার পৈত্রিক ভিটেমাটি ছেড়ে এক দিন এক রাত মহাজনি নৌকায় করে ভাটি অঞ্চলের এই হাটে এসে আশ্রয় নেয় । তখন ওই এলাকা থেকে অনেক পাটের মহাজনি নৌকা মৈমনসিং শহরে আসতো । ভাটি অঞ্চলে আসতো পাটের চালান বিনিময়ে মহাজনরা নিয়ে যেতো ইলিশ মাছের চালান । সাকেদ আলী ফকির একমাত্র ছেলেকে বলতো – হুন বাপজান , হেইসুম ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি হগল সময় থাকত টইটম্বুর । সেই যেই বছর জার্মানীর হিটলাররা জাপানে এটম বোমা ফালায় আমি সবে মাত্র ডাংগর হইছি । বাজান আমারে কইলো , ঘাটে নৌকা বাধা মহজনী নাও , রাইতভর পাহারা দেওন লাগবো , তোর লগে আইজদ্দী বেপারীর বড়পোলা আইনুল্লা থাকবো , দুইজনে রাইত ভর পাহারা দেইছ, কাইলকা হক্কালবেলা নাও লিয়া যামু মৈমনসিং। আমরা দুইজন করলামকি পূর্বপাড়ার রইস মন্ডলের মাইয়া অমিচা বেগমরে রাইতে নায়ে আইতে কইলাম । চান্নি পসর রাইতে অমিচা বেগমরে দেহা যায় পরির লাহান । আমরা ছিলাম দুইজনই অমিচা বেগমের লাইগা পাগল । আইনুল্লা আমারে কইল, অমিচা বেগমের দিকে চোখ তুইলা তাকাইছ তো তোমারে জ্যান্ত হাত-পা বাইধা নাও থেইকা নদীতে ফালাইয়া দিমু । আমি করলাম কি, আমার মাথায় ততক্ষনে রক্ত উইঠা গেছে । দিলাম বৈঠা দিয়া তার মাথায় বাড়ি । বান্দির পুত এক বাড়িতে নাও থেইকা পানিতে পড়বো এইটা তখন চিন্তা করিনাই । মনে করলাম ভালই হইছে পথের কাটা দুর হইছে । কিন্তু বুঝবার পারলাম যখন তখন লাশ ভাইসা গেছে অনেকদুর । বাপজানরে সত্য কথা কইলাম । হেসে কইল , হক্কাল বেলা মহাজনী নৌকায় পলাইয়া যাওগা মৈমনসিং । তো ভয় ছিল শহরেতো হরহামেশা হগ্গলে আসে । কখন কার লগে দেহা হয় , তাই হেসে এই নদীর পারের পুর্ব ধলাপুর হাটে নাইমা যাই । এইহানে মাইনষের দোকান- বাড়িতে ফাইফরমাস খাইটা কয়েক বছরের মধ্যে হাটের পার্শ্বে জমি নিয়া বাড়ি করলাম । অর্ধেক বাড়ি অর্ধেক দোকান । মাইনসে বলে সাকেদ ফকিরের দোকান । দোকান করলে হবে কি বাপদাদার পৈত্রিক শখ ছিল দোতারা বাজাইয়া মারফতি গান গাবার । দোকানে বেচাকেনা শেষে রাতে সাকেদ ফকির রাতে দোতারায় গান ধরে – আমার মন বালানাগো .. আমার প্রাণ বালানা … ।দিনতো ভালই যাচ্ছিল সাকেদ আলী ফকিরের । আয়-রুজি দেইখাই এই গ্রামেই সফদর আলী বেপারীর কণ্যা পরিবানুর লগে সাকেদ ফকিরের বিবাহ হয় । প্রথম সন্তান ছিল মাইয়া । কিন্তু বউএর বয়স কম বইলা মরা বাচ্চা প্রসব করে পরিবানু । এর পর আরেকটি মাইয়ার জন্ম হয় । সাকেদ ফকিরের মন চায় একটা পোলা হইব । দোকান, বিষয়-সম্পত্তি রক্ষা করবো । পরি বানুরে লইয়া একবার গেলো খাজে দেওয়ান বাবার পিরের আস্তানায় । ব্রহ্মপুত্রের তিন ক্রোশ উজানে নদীর ধারেই পিরের আস্তানা । বাবার দাওয়া ও দোয়ার বরকতে এক বছরের মধ্যেই কালাচান আসে পরিবানুর পেটে । কি জব্বর পোলা । খাসা মাংস পিটানো কালো শরীর । মুখটা ছিল পুর্ণিমার চান্দের লাহান । তাই তার নাম রাখছিলো কালাচান । আর ফকির বংশের শেষে উপাধি লাগিয়ে কালাচান ফকির । মা বাবার মন ভরলো ঠিকই । কিন্তু সুখ বেশীদিন সইলনা কপালে তাদের । তিন/চার বছরের মধ্যে ব্রহ্মপুত্র গ্রাস করলো তাদের বাড়ি, দোকান- বিষয় সম্পত্তি । দুই/তিন বছর নৌকায় থেকে ব্যবসা করলো কিন্তু ভাগ্যের ফের ব্যবসা পাতি লাটে উঠল ।এই দুঃখে বাপজান হঠাৎ মরলো । এক বছরের মধ্যে পরিবানুও ইহলিলা সাঙ্গ করে । কি আর করা মৈমনসিং শহরে কিছুদিন ঘোরাঘুরি করে কালাচান ফকির খুব একটা সুবিধা করতে না পেরে রেলস্টেশনে একটি ছোট ভাতের হোটেল দেয় । তখন হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা লাগার বছর যাকে বলে রায়টের বছর । কালাচান ফকির দেখেছে চোখের সামনে হিন্দু বাড়িতে হামলা ও লুটপাট । কতো হিন্দু মানুষকে যে জবাই করা হয়েছে তার ইয়ত্তা নাই । ইলিশ মাছে ভর্তি রেলের মাল বগিতে টিকিঅলা কাটা মুন্ড দিয়ে বোঝাই করে পশ্চিম বঙ্গে চালান করা হয়েছে । তার পর ইন্ডিয়া পাকিস্তান হয়েছে । কিন্তু কালাচান ফকিরের ভাগ্য বদল হয়নি । ভাতের হোটেলে মানূষ খেয়ে যায় ঠিকই কিন্তু বাকীর কাস্টমার বেশী থাকায় এই ব্যবসা গুটিয়ে কালাচান ফকির চলে যায় জামালপুর শহরে । তখনকার দিনে মহকুমা শহর হলে হবে কি মৈমনসিং শহরের থেকে লোকজন এখানকার অনেক ভালো । বাপে যাইতো প্রায় পীরের আস্তানায় । কেন জানি কালাচানকে এই কারণেই পীর ফকিরের আস্তানা খুব টানে । প্রথম দিনেই রেল স্টেশনে পরিচয় হয় শাহ সুলতান আজমেরী পাগলা বাবার সঙ্গে । ইয়া মস্তবড় গোঁফদাড়ি লম্বা বাবরী চুল আর গেরুয়া পোষাক । গাজার সুখটানের চিহ্ন স্পষ্ট মুখের দাড়িগোঁফে হাতে বিচিত্র লাঠি । ছয়মাস কি এক বছরও শরীরে গোছলের ছাপ বোঝা মুশকিল । কালচানরে বলে বাপ, এই লাইনে আসবিতো মহাসাধক হবি । তবে সংসার বিরাগী হতে হবে তবেই সন্ধ্যান মিলবে মনের মাইনসের লগে । এই জন্য লোভ, লালসা, কাম, ক্রোধ সবই ত্যাগ করতে হবে । কিছুদিন আজমেরী বাবার সঙ্গে ঘোরাঘুরির পর তারে আর এই সব ভালো লাগেনা । তবে, এই বাবার তরফে তার যে পরিবর্তন ঘটে , তাহলো- আজমেরী বাবার অবিকল বাহ্যিক সুরত ধারন । ঠিক তার মতোই গোঁফ দাড়িতে গাজার সুখটানের স্পষ্ট চিহ্ন , গেরুয়া পোষাক হাতে বিচিত্র লাঠি । গ্রাম গঞ্জের মানূষও যথেষ্ট সমিহ বা আদর আপ্যায়ন করে । কিন্তুু মানুষের মন বড়ো বিচিত্র । এই আদর আপ্যায়নের ধারাটা বেশীদিন থাকেনা । এক রকম বাধ্য হয়ে পাড়ি জমায় বাহাদুরাবাদ হয়ে যমুনা পাড়ি দিয়ে ফুলছড়ি হয়ে ট্রেনে চেপে উত্তর বঙ্গে । ট্রেনের বগিতে পরিচয় হয় সরিষাবাড়ি থেকে যমুনার ভাঙ্গনের শিকার একটি পরিবারের কর্তা আক্কেল আলী মুন্সির সাথে । একই কামরায় তার সাথে যাচ্ছে তার স্ত্রী, তিন ছেলে , দুই মেয়ে, এতিম ভাজতি কলসুমসহ বাড়ির কাজের লোক মইজুদ্দী । তারা যাচ্ছে সুদুর দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁওয়ের রাণিগঞ্জ এলাকায় । সেখানে বসতবাড়ি ও জমি কেনা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে । এলাকাটি খুবই ভাল আবাদ ফসলের দিক থেকে । জমি খুবই সস্তা । আর সব থেকে ভাল হচ্ছে সেখানকার মানুষজন খুবই সহজ সরল । তবে, আবাদের জমির ফাকে ফাকে রয়েছে বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে জঙ্গল । যেখানে বুণো শুয়োরের পাল আর বাঘের ছড়াছড়ি । সাবধানে থাকতে হবে বসবাসযোগ্য ঐ এলাকায় । ( চলবে)
১,৩৬১ বার পড়া হয়েছে
বেশ ভাল লেগেছে ভাই,
কেমন আছেন আপনি ?
ভাল লেগেছে জেনে আমিও খুশি হলাম । আর কেমন আছি ? ভালইতো ! আপনি ?
ভাল লাগল পরের পর্ব কই
dhonnoybad apu . shiggir porer porbo post korbo . amee ektu oshushtoy. doa rakhben.