হুমায়ুন আহমেদ এর সাক্ষাৎকার সমগ্র – “সংগ্রহ-১৫”
এই লেখাটি ইতিমধ্যে 1355বার পড়া হয়েছে।
হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে ইমদাদুল হক মিলনের একটি লেখা আছে, নাম – হুমায়ূন আহমেদ এবং হুমায়ূন আহমেদ। লেখাটিতে হুমায়ুন আহমেদ এর সাক্ষাৎকার এর সাথে সাথে বেশ কিছু মজাদার হাসি তামাশাও চলে এসেছে যাতে হুমায়ুন আহমেদের চির হাস্যমুখর প্রানবন্ত অনুভুতিও ফুটে উঠেছে। আগের পর্বে কিছু অংশ ছিল। আজ আবার কিছু তুলে দিলাম।
এবার অন্য রকম একটি প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলি। তারপর আবার হুমায়ূন আহমেদের পেছনের জীবনের দিকে ফিরব।
হুমায়ূন ভাইয়ের যেকোনো লেখাই গভীর আগ্রহ ও আনন্দ নিয়ে পড়ি। আমার ধারণা, তাঁর এমন কোনো লেখা নেই, যা আমি পড়িনি। বছর তিনেক আগের কথা, তখন অপেক্ষা করে থাকতাম তাঁর ‘বলপয়েন্ট’ লেখাটির জন্য। ‘সাপ্তাহিক ২০০০’-এ প্রতিসপ্তাহে বেরোচ্ছে ‘বলপয়েন্ট’। এত স্বাদু রচনা, পড়তে শুরু করলে কখন শেষ হয়ে যায় টেরই পাই না। শেষ হওয়ার পর বিরক্ত লাগে। কেন মাত্র দেড়-দুই পৃষ্ঠা করে লিখছেন তিনি? কেন এই লেখা আরো বড় করে লিখছেন না?
এর মধ্যে একটি পর্বে দেখলাম আমাকে নিয়ে দু-তিনটি প্যারা লিখেছেন। পড়ে সন্ধ্যাবেলা তাঁকে ফোন করলাম। তিনি বিক্রমপুর থেকে ফোন ধরলেন। বিক্রমপুরের দীঘিরপার এলাকায় নাটকের শুটিং করতে গেছেন। গ্রামটির নাম কামাড়খাড়া। এই গ্রামের পাশের গ্রাম বাণীখাড়ায় ছিল শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়দের বাড়ি। এলাকাটি আমার বিশেষ পরিচিত। ওই গ্রামে আমার এক দাদার বাড়ি। অর্থাৎ বাবার ফুফাতো চাচার বাড়ি। কিশোর বয়সে বহুবার সেই বাড়িতে গেছি। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটির নাম রজতরেখা। হুমায়ূন ভাই ওই এলাকায় শুটিং করছেন আর সেদিনই অনেক দিন পর তাঁর সঙ্গে আমার কথা হচ্ছে ভেবে ভালো লাগল। আমাকে নিয়ে তিনি লিখেছেন সেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য ফোন করেছিলাম। কথায় কথায় বললাম, ‘বলপয়েন্ট’ লেখাটিকে মনে হচ্ছে ‘কলম ছেড়ে দেওয়া লেখা’। কোনো পরিকল্পনা নেই, মাথায় এলোমেলোভাবে আছে স্মৃতিগুলো। কোন স্মৃতি আগের, কোনটি পরের_কোনো হিসাব নেই, কলম যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, লেখাও এগোচ্ছে সেইভাবে। বলপয়েন্টের মূল আকর্ষণ এই জায়গায়।
কিন্তু যে কথা বলার জন্য হুমায়ূন ভাইকে ফোন করেছিলাম সেই কথাটাই বলা হলো না। এখন বলি। হুমায়ূন ভাই, আপনি লিখেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর সমরেশ মজুমদার ঢাকায় এসেছেন। সন্ধ্যাবেলা পার্টি হচ্ছে কোথাও। ঢাকার লেখক-শিল্পীরা অনেকেই আছেন সেখানে। পানাহার হইহল্লা আড্ডা চলছে। সেই আড্ডায় আমি সুনীল-সমরেশকে সমানে তুমি তুমি করে যাচ্ছি।
এখানটায় একটুখানি গণ্ডগোল আছে।
আমি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে কখনো তুমি বলি না। তাঁকে আপনি করেই বলি। সুনীলদা আপনি, বলি।
সমরেশ মজুমদারকে তুমি করে বলি। পেছনে একটা ঘটনা আছে। সতেরো-আঠারো বছর আগে সমরেশ মজুমদার প্রথম ঢাকায় এলেন। ফেব্রুয়ারির বইমেলা চলছে বাংলা একাডেমীতে। সমরেশকে ঢাকায় এনেছেন পার্ল পাবলিকেশন্সের আলতাফ হোসেন। আপনার-আমার দুজনের প্রিয় মিনু ভাই। মিনু ভাই অকালে চলে গেছেন। এই মুহূর্তে তাঁর কথা খুব মনে পড়ছে। মিনু ভাই ঠোঁটকাটা লোক ছিলেন, হঠাৎ রেগে যেতেন; কিন্তু মনটা খুব ভালো ছিল! একবার তাঁর বিদেশে থাকা এক আত্মীয় খুবই সুন্দর পিংক কালারের বেশ দামি একটা টি-শার্ট গিফট করেছেন মিনু ভাইকে। মিনু ভাই সেটা নিয়ে আমার গেণ্ডারিয়ার বাসায় গিয়ে হাজির। ওই টি-শার্টে নাকি আমাকে খুব মানাবে। বহুদিন মিনু ভাইয়ের দেওয়া সেই টি-শার্ট পরে আমি ঘুরে বেরিয়েছি। ফেব্রুয়ারি বইমেলায় মিনু ভাইকে একটা বই দেব বলে অনেক দিন ঘুরিয়েছিলাম, সে কথা মনে করে আজ অনুতপ্ত হচ্ছি।
তো, সমরেশ ঢাকায় এসে মিনু ভাইয়ের সঙ্গেই আছেন। বাংলা একাডেমীতে মিনু ভাইয়ের স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তখনো বাংলাদেশের পাঠক সমরেশকে সেভাবে চেনে না। আমি হাঁটতে হাঁটতে গেছি মিনু ভাইয়ের স্টলের সামনে। মিনু ভাই সমরেশের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সমরেশের লেখা সম্পর্কে আমার কিছু ধারণা ছিল। তাঁর বহু লেখা আমি পড়েছি। বিশেষ করে ‘উত্তরাধিকার’ উপন্যাসটি আমাকে মুগ্ধ করেছিল। পরিচয়ের মুহূর্তেই সমরেশ যেটা করলেন, আমার কাঁধে একটা হাত দিলেন, দিয়ে বেশ একটা দাদাসুলভ ভঙ্গিতে কলকাতার ভাষায় বললেন, ‘তা, কী লিখছ আজগাল?’ আচরণ এবং প্রশ্নে আন্তরিকতার অভাব ছিল না। কিন্তু আমার মনের ভেতর খুট করে একটা শব্দ হলো। বয়সে ছোট ইত্যাদি ভেবে কি তিনি আমাকে তুমি করে বলছেন? নাকি লেখকসুলভ কোনো ভাব! লেখকদের তো নানা ধরনের ভাবচক্কর থাকে।
আমার মাথায় দুষ্টু একটা পোকা কামড় দিল। তাহলে আমিও সমরেশের সঙ্গে একটু ভাব নিই। আমি ঘাড় বাঁকা করে সমরেশের মুখের দিকে তাকিয়ে অতিশয় নির্বিকার গলায় বললাম, ‘তা, তুমি কী লিখছ?’
সমরেশ কিন্তু ব্যাপারটা সহজভাবেই নিলেন। ওই বিকেলেই আমাদের বন্ধুত্ব হয়ে গেল। আমি সমরেশকে তুমি করেই বলতে লাগলাম। সঙ্গে ‘দা’টা লাগিয়ে দিলাম। কিন্তু হুমায়ূন ভাই, আপনি এই তুমি তুমিটা একদমই পছন্দ করছিলেন না। একদিন খুবই বিরক্ত হয়ে কথাটা আমাকে বলেছিলেন। যখন আমি ঘটনাটা বললাম, শুনে আপনি খুব মজা পেয়েছিলেন। তবে তারপর দু-একবার সমরেশদাকে আমি আপনি করে বলার চেষ্টা করেছি, ব্যাপারটা তিনি স্বাভাবিকভাবে নেননি। মাইন্ড করেছেন।
২০০৯-এর এপ্রিলে কলকাতায় গেছি। সমরেশের সঙ্গে দেখা। বললাম, কেমন আছেন, সমরেশদা? সমরেশদা গম্ভীর গলায় বললেন, ‘তুমি কিন্তু আমাকে তুমি করে বলতে?’
১,৪৮৩ বার পড়া হয়েছে
পর্বগুলো ভাল লাগছে।
সাক্ষাৎকারটি ভাল লাগল।
পর্বগুলো ভাল লাগছে।
অনেক কিছু জানলাম ।
+++ osadharon+++
উফ কি যে ভাল লাগতেছে পড়ে। ধন্যবাদ আপনাকে