বিজ্ঞানী পিসি রায়ের বাড়ি
বাঙালির রসায়নচর্চার পথিকৃৎ স্যার পিসি রায় [প্রফুল্ল চন্দ্র রায়]। চিরকুমার এ মানুষটির যথার্থ উত্তরাধিকারী ছিল তারই অনেক শিক্ষার্থী। তার তত্ত্বাবধানে তৈরি হয়েছিল নব্য রাসায়নিক গোষ্ঠী। ১৮৬১ সালের ২ আগস্ট খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার রাড়ুলি গ্রামে তার জন্ম। তার মায়ের নাম ভুবনমোহিনী দেবী এবং বাবা হরিশ চন্দ্র রায়; যিনি স্থানীয় প্রসিদ্ধ জমিদার ছিলেন। ছেলেবেলা থেকে পিসি রায় অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। তার পড়াশোনা শুরু হয় তারই পিতার প্রতিষ্ঠিত এমই স্কুলে। অতঃপর ১৮৭২ সালে তিনি কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন, কিন্তু রক্ত আমাশয়ের কারণে তার পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটে। বাধ্য হয়ে তিনি নিজ গ্রামে ফিরে আসেন। গ্রামে থাকার সময় তার জীবনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে। তিনি বাড়ির গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত নানা বিষয়ে প্রচুর বই পড়েন।
ওই সময় কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন অলেকজান্ডার পেডলার। খ্যাতিমান এ অধ্যাপকের সানি্নধ্যে এসে রসায়নের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায় তার। কলেজের পাঠ্যবই ছাড়াও বিভিন্ন পাঠাগার থেকে রসায়নের বই সংগ্রহ করে পড়তেন। নিজের চেষ্টায় বাড়িতে পরীক্ষাগার স্থাপন করে রসায়ন সম্পর্কে নানারকম পরীক্ষাও চালাতেন। তিনি গিলক্রিস্ট বৃত্তি নিয়ে স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। এখান থেকে তিনি বিএসসি এবং ডিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল, ‘কপার ম্যাগনেসিয়াম শ্রেণীর সম্মিলিত সংযুক্তি পর্যবেক্ষণ’ [Conjugated Sulphates of Copper Magnesium group : A Studz of Isomorphous Mistures and Molecular Combination]। দুই বছরের কঠোর সাধনায় তিনি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ওই সময় তিনি শ্রেষ্ঠ গবেষণাপত্রের জন্য ‘হোপ প্রাইজ’-এ ভূষিত হন। ইউরোপের নানা দেশ ঘুরে ১৮৮৮ সালে প্রফুল্ল রায় দেশে ফিরে আসেন। সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। ওই সময় তার বিখ্যাত ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, নীল রতন ধর, পুলিন বিহারী সরকার, রসিক লাল দত্ত, মেঘনাদ সাহা প্রমুখ। বিজ্ঞান শিক্ষার পাশাপাশি প্রফুল্ল চন্দ্র তার ছাত্রদের নৈতিক স্বাদেশিক শিক্ষায়ও দীক্ষিত করেছিলেন। তিনি তার ছাত্রদের বলতেন_ ‘গরিব মানুষের পয়সায় লেখাপড়া শিখছিস। এদের কৃতজ্ঞতার ঋণের বোঝা কিন্তু একদিন ফিরিয়ে দিতে হবে।’ ১৮৯৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে তার প্রথম গবেষণাপত্রের নাম ছিল ‘অন দি কেমিক্যাল একজামিনেশন অব সার্টেন ইন্ডিয়ান ফুড স্টাফস, পার্ট ওয়ান, ফ্যাটস অ্যান্ড অয়েলস।’ পরবর্তীতে তার গবেষণার মূল বিষয় ছিল নাইট্রাইট যৌগ নিয়ে; যা তাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়। বিজ্ঞান গবেষণায় স্বীকৃতির অন্যতম ক্ষেত্র ‘নেচার’ পত্রিকায় তার লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হয়। ১৮৯৫ সালে তিনি মারকিউরাস নাইট্রাইট [HgNO2] আবিষ্কার করেন যা বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। এটি তার অন্যতম প্রধান আবিষ্কার। তার সমগ্র জীবনে মোট ১২টি যৌগিক লবণ এবং পাঁচটি থায়এস্টার আবিষ্কার করেন।
প্রফুল্ল চন্দ্র স্বদেশী আন্দোলনের প্রথম পর্যায় থেকেই যুক্ত হয়েছিলেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে যখন বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলন সক্রিয় হয়ে ওঠে, তখন গোপনে অস্ত্র ক্রয়ের জন্য তিনি বিপ্লবীদের সাহায্য করেন।
১৯১৬ সালে কলকাতায় তিনিই প্রথমবারের মত মহাত্মা গান্ধীর জনসভা আয়োজন করেছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি ও নাইট উপাধি অর্জন করেন।