জীবনের প্রথম গল্প লেখা,তাই নাম এখনো ঠিক করি নাই,(১ম পর্ব)
যে কখনো জলে নামেনি তার জলে নামার অথবা ভেজার প্রতি বরাবরই বেশ কৌতুহল থাকে কিন্তু ভীতি যে এক্কেবারে থাকে না, তা বোধ হয় বলা ঠিক হবে না । জলে নামাতে বা গাছে চড়াতে সবাই ভূমিকা নেয় কিন্তু সাঁতার শেখাতে বা গাছ থেকে নামানোর সংখ্যা খুব একটা সুবিধাজনক নয় । বর্তমানে জলে ডুবে মরতে বসলে, জল থেকে ডাঙ্গায় তুলতে যতোটা না হাত জলে ভেজে, তার থেকে সহস্রাধিক উৎসুক চোখ-হাত জলের কিনারে দাঁড়িয়ে উদ্ধারকারীর হর্ষধ্বনিতে শীষ দিতে কিংবা বাঁচানো না গেলে কপট মায়াজাল-হাহাকার আহা বলতে অথবা তার চৌদ্দুগুষ্ঠি নিয়ে বা চরিত্র নিয়ে চটকাচটকি করার অভাববোধ হয় না, আর এসব সম্ভব হয়েছে শুধু আকাশ সভ্যতার উল্লঙ্গতার কল্যানে নৈতিকতার নোঙ্গর থেকে ছিটকে পড়ার কারনে ।
তা বলে এটি শূন্য সংস্কৃতির অবদানে আহরিত নয়, নিছক একটা গ্রামীণ অজপাড়াগাঁয়ের ঝিয়ারীর জীবন কাহিনী । মেয়েটির নাম কি আর বলব, সত্যিটাই বলি, নাম তার শ্যামা ।
বার কি তের বছরের কিশোরী । আট ক্লাসের বিদ্যার্থী বলে শুনেছিলাম । এ বয়সের ছেলেরা যখন পাড়ায় পাড়ায় খেলাধুলো করে ঘুরে বেড়ায়, ফল ফলাদি বন্ধুরা মিলে চুরি করে তৃপ্তে ভক্ষণে বদহজম করে, হাঁস-মুরগি চুরি করে রাতের অন্ধকারের এক কোনে চড়ুইভাতি করে; তখন মফস্বলের কিশোরীদের কারো স্বামী সন্তান নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় অথবা মায়ের হাতের কাজের সাহায্যকারী হয়ে ধণ্য থাকতে হয় । সংসারের ব্যস্ততা ডিঙি্গয়েই তবে এদের বিহঙ্গের মতো ডানা মেলবার ফুসরত মেলে ।
রোববার কি সোমবার হবে, সঠিক মনে নেই । এমনি একদিন শ্যামা বন্ধুদের সাথে পাঠশালা থেকে বাটীতে ফিরছিল, পথিমধ্যে চোখে ধরা পড়ল, তার বাবা তেরাস্তার পূব পশ্চিম বাঁকে দাঁড়িয়ে অচেনা মোচয়ালা বাবার বয়সী একজনের সাথে কথা বলছে । সন্নিকটে আসা মাত্র সবুজ মিয়া তাকে মা বলে ডাকল । শ্যামা হাঁসতে হাঁসতে তার বাবার দিকে এগিয়ে গেল । স্কুলে সব কটা ক্লাস হয়েছে কি না, পড়া পেরেছে কি না, এসব কথা জিজ্ঞাসা করার পর সবুজ মিয়া শ্যামার হাতে বিশটি টাকা গুঁজে দিয়ে বাড়ি চলে যেতে বলল । শ্যামা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে ইতস্তত করতে-করতে টাকাটা নিয়ে মনে-মনে ভাবতে-ভাবতে ধীর পায়ে বাড়ির পথ ধরল । যে বাবার কাছে এক টাকা চেয়ে কখনো পায়নি, আজ সে কিনা না চাইতে এক টাকা দু টাকা নয় বিশ বিশটি টাকা পেয়ে খুশি না হয়ে কিছুটা দ্বিধায় পড়ল।
বাড়ীতে এসে বই খাতা বিছানার পরে ছুড়ে দিয়ে আনমনস্ক হয়ে মাটির পাটিতে বসে পড়ল। ওদিকে মা সুরমা বেগম ডাকাডাকি করছে কাজ করার জন্য ।
যে হাতে কখনো জল সরেনি আজ সে হাতে রীতিমত ঘি সরল, আর লোকটিই বা কে ? অন্যদিকে যার এক বেলা কাজে না গেলে হাঁড়ি চুলোয় চাপে না, উপোষের সাথে সহবাস করতে হয় আর সবাইকে, আজ কাজ ফেলে সে কিনা বাজারে ! এসব বিস্তর ভাবনার জলে সাঁতার কাটতে গিয়ে শ্যামা ঘেমে ভিজে জগাখিচুড়ী অবস্থা ।
কি রে মা, এখনো কাপড় ছাড়িস নে, একা-একা বসে কি করছিস ? মন খারাপ নাকি ? নে মা উঠ, আমার হাতে অনেক কাজ বাকী, ওদিকে তোর বাবা এক্ষুনি বাজার থেকে ফিরে এসে খেতে চাবে, জলদি আয় মা, আমার গোস্ত রান্না এখনো বাকি আছে । মায়ের চলে যাবার পর, বলে যাওয়া গোস্তের কথা শুনে আরো বেশি হতবাক হয়ে ভাবনার বিড়ম্বনায় পড়ে গেল । যে বাটিতে ঈদের দিন গোস্ত কেনার কানাকড়ি থাকে না, সে বাড়িতে আজ গোস্ত !সবকিছু গোলক ধা ধা লাগছে শ্যামার । ব্যাপার খানা কি ?
মাযের পীড়াপীড়িতে আনমনায় স্তফা দিয়ে পুকুরে পানি আনতে গেল । ফিরবার পথে পাশের বাড়ির এক চাচী বেশ তাচ্ছিল্যতায় বলল ‘কি রে শ্যামা, তরা নাকি আজ গোস্ত দে ভাত খাবু, তোগো বাড়ীত নাকি আজকা ঈদ, ব্যাপারডা কি রে বেডি, দেখস যেন চিত খারাপ লস না নোতন বাড়ীত গে । শ্যামা একট থতমত খেয়ে গেল চাচীর শেষ কথাটা শুনে । তার সাথে এসব কি হচ্ছে, কেনই বা হচ্ছে, এসবের কোন উত্তর কারো কাছে না পেয়ে সে চিন্তাকে একটি আঁইলের উপর খাঁড়া করাল যে, সে কবিরাজ চাচার কাছে গিয়ে এর একটা বিহিত করবে, কারন এ মুহুর্তে সে কবিরাজ চাচা ছাড়া আন কাউকে নিজের করে ভাবতে পারল না।
জল অদ্ভুত এক পদার্থ, সমান্তরালে ঢাললে কখন সে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে আবার কখন বা মাটির পিপাসায় শুষে নেয়, যদি বা নিন্ম পথে ঢালা হয়ে তাহলে তলদেশ ঠিকই খুঁজে নেয় ।