Today 10 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

ধারাবাহিক উপন্যাস “নরক”

: | : ২৭/০৬/২০১৩

বেলা দেড়টা। সূর্য কাঁৎ হতে চলছে পশ্চিমে। একটু আগে সবুজ ঢাকা থেকে ফিরেছে। বাড়ি ফিরেই সর্বপ্রথম বাবার রুমে ঢুকেছে। গ্রাম অঞ্চলের আট দশটি বাড়ির মতই সবুজদের বাড়ি। বিভিন্ন গাছপালায় ঘেরা বিশাল এক বাড়ি। পুকুর সংলগ্ন বাড়ির পশ্টিমের গোয়াল ঘরটি ব্যতিত আরো দুইটি ঘর আছে । উত্তরের ঘরটি টিন ও কাঠ দিয়ে গড়া দোতলা ঘর।
ঐ ঘরের নিজ তলায় সবুজের মৃত বাবা আফাজ তালুকদার যে রুমে থাকতেন, সবুজ এখন সেই রুমে বাবার ছবির সামনে দাড়িয়ে আছে। বাবার ছবির পাশেই মায়ের ছবি টানানো।
সবুজ তালুকদার। বয়স পঁচিশ বছর নয় মাস। উচ্চতা পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি। ফর্সা, মুখমন্ডল গোল, নাক সরু, চুল হালকা বাদামি রঙের। মাঝারি স্বাথ্যের অধিকারি হলেও লম্বা হওয়ায় স্বাথ্য বুঝা যায় না। চোখে চিকন ফ্র্রেমের চশমা পরে । সব মিলিয়ে মুখশ্রীতে নিষ্পাপ ভাব পরিস্ফুটিত । তবে নিজের চেহারা সম্বন্ধে গত চব্বিশ বছর ধরে সবুজের আলাদা একটি পর্যবেক্ষন ছিল, যা এই এক বছরে ধীরে ধীরে ভুল প্রমানিত হচ্ছে। এজন্য সবুজ নিজেকে নিয়ে বেশ সংসয়ে আছে। আর সংসয়ে আছে বলেই নিজ চেহারা সম্পর্কে মন্তব্য করার দুঃসাহস দেখায় না কখনো।
গত চব্বিশ বছর ধরে সবুজের ধারনা ছিল সে দেখতে খুব বিশ্রী। প্রেম না করেও ঐ চব্বিশ বছর তার জীবন ছিল বিরহ মোড়কে মোড়ানো, যাপন করেছে নিরামিষ জীবন।
বাবার রুমে ঢোকার সাথে সাথে সবুজের হাস্যজ্জ্বল মুখ মলিন হয়ে গেল। সবুজ তলিয়ে গেল স্মৃতির গহীণ অতলে। ফিরে গেল সতের বছর আগের জীবনে। সবুজের বয়স যখন সাড়ে সাত বছর, অর্থাৎ সে যখন দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র তখন কলেরায় আক্রান্ত হয়ে সবুজের সবচেয়ে প্রিয়জন তার মা-র মৃত্ত্যু হয়। সে বছর কলেরার মহামারি এতটাই প্রকট হয় ছিল যে তিনদিনের মধ্যে সবুজদের গ্রামের তেরজন লোক মারা গিয়েছিল।
ভয়াবহতা দেখে অনেকেই গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেল। আর যারা মারা গেল তাদের অধিকাংশই ছিল হত দরিদ্র পরিবারের সদস্য। ছয়জন ছিল সবুজদের বর্গাচাষী । সবুজের বাবা আফাজ তালুকদার দিশকূল না পেয়ে তথাকথিত গ্রাম্য প্রথা অনুযায়ী সন্ধ্যার পর কাউকে কিছু না বলে সবুজের বড় বোন আফরোজা আর সবুজকে ওদের খালার বাড়ি ভালুকজান রেখে আসলেন।
আফরোজা সবুজের চেয়ে ছয় বছরের বড়। আফরোজার ছোট আরো এক বোন ছিল। আট বছর বয়সে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছে সে । তারপর তালুকদার সাহেবের আর বাচ্চা হয় নি। সবুজরা এখন এক ভাই, এক বোন।

সেই রাতের স্মৃতি আমি (সবুজ) কখনো ভুলতে পারব না। সাড়ে সাত বছর বয়সের ছেলেমেয়েরা অন্যের ভালোবাসার রসদ ভোগ করতে পারলেও নিজ প্রেমের ডানা অন্যের প্রতি বাড়িয়ে দিতে পারে না। তাই তো সে সময় ভালোবাসার ভাষা আমি জানতাম না। বুবুর বয়স তখন তের চৌদ্দ বছর হবে। কুরআন শরীফ খতম দিয়েছে। খালামনির পাশে আমি বুবু আর আমার খালা’ত মজনু দাড়িয়ে আছি। মজনু আমার চেয়ে তিন বছরের ছোট।

বাবা আমাদের রেখে চলে যাচ্ছেন। আমি নির্বাক দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে আছি। কুপি বাতির জীর্ণ আলোয় বাবার মুখখানা নিতান্তই কালো দেখাচ্ছে। অসহাত্ব কাকে বলে ঐ বয়সে আমি বুঝি না, বাবাকে অসহায় দেখাচ্ছিল কিনা বলতে পারব না। আমি দাড়িয়ে আছি খালামনিদের বারান্ধার খুটি ধরে। বাবা আঙ্গিনায় পা রাখতেই বুবু কাঁদতে কাঁদতে বলল, বাবা যেও না।
ঘুরে দাড়িয়ে লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বাবা বললেন, যুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় সংকটে পড়েছে আজ আমাদের গ্রামের মানুষ। ওদের দুর্দিনে আমি গা ঢাকা দিতে পারি না। যাদের জন্য যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করলাম তারা সবাই রোগে ভোগে মরে যাচ্ছে আর আমি জান বাঁচিয়ে বেড়াবো এ কী করে সম্ভব ?
বাবা যা যা বললেন, তার কিছুই আমি বুঝতে পারলাম না। বুবু হয়ত বুঝতে পেরেছিল। না বুঝলে, বাবা তাকে এসব বলবেন কেন? বুবু আর কিছুই বলল না। বাবা আমার কাছে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে কেঁদে ফেললেন। আমার চোখে জল না এলেও বাবার কান্না দেখে ভীষণ মন খারাপ হল। মনে হল বাবা বুঝি আর ফিরে আসবেন না। খালামনি এগিয়ে এসে আমাকে কোলে নিলেন।
বাবা চলে যাচ্ছেন আমরা তাকিয়ে দেখছি। আঙ্গিনার ওপারে অন্ধকারে বাবা হারিয়ে গেলেন। সে সময় খাবার সেলাইনের প্রচলন ছিল কিনা জানি না। বাজার থেকে কঁচি লাউ কিনে এনে কলেরা আক্রান্তদের মধ্যে বিতরণ শুরু করলেন আমার বাবা। তাতে রোগিরা কতখানি উপকৃত হয়েছিলেন তা বলতে পারব না। তবে এইটুকু বলা যায়, কঁচি লাউ কলেরার জন্য উপকারী কারো কাছে শোনেই বাবা এই কাজটি করেছিলেন এতে কোনো সন্দেহ নেই।
তৎকালে কলেরার নাম শোনলে মানুষ যেখানে ভয়ে ঘর থেকে বের হত না, বাবা সেখানে রোগিদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গুড়, চিড়া, শুকনো খাবার ইত্যাদি সরবরাহ করলেন। বাবা শুধু একাই এসব করতেন না, তার সাথে সাথী ছিলেন আমার মা।
আমার দাদাকে আমি দেখি নি, তার কথা বলতেও পারব না তেমন একটা। তিনশত বিঘা জমির মালিক ছিলেন আমার দাদা সাকাওয়াত তালুকদার। ব্রিটিশ আমলে নিজে জিম্মা হয়ে ব্যাংক থেকে কোনো এক গরীব ব্যবসায়ীকে পাঁচশত টাকা ঋণ নিয়ে দিয়ে ছিলেন। সেই টাকা সময় মত পরিশোধ না করায় ইংরেজরা দাদার চল্লিশ বিঘা জমি বাজেয়েপ্ত করেছিল। এই ঘটনার পর দাদা আর বাড়ি থেকে বের হন নি। দশ বিঘা জমির উপর একটি ইয়াতিমখানা বানিয়ে ছিলেন। ব্রিটিশরা এদেশ ছাড়ার আগেই নৈতিকভাবে পরাজিত হয়ে ঘৃণায় লজ্জায় পৃথিবী ছেড়ে দিলেন আমার দাদা।
তার কিছুদিন পরই ব্রিটিশরা এদেশ ছাড়তে বাধ্য হল। জন্ম নিলো পাকিস্তান । পাকিস্তান আমলে আড়াইশত বিঘা জমির মালিক আমার বাবা আফাজ তালুকদার। পাকিস্তান আমলে তিনি মেট্টিক পাস করেছিলেন। তারপর আর লেখাপড়া করেন নি। তবে একজন ভালো মানুষ হতে হলে শিক্ষাই যে মুখ্যম কিছু না, বাবা তারই দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন তার নিজ কর্মকান্ডের মাধ্যমে। মানুষের যে কোনো সংকটে, সমাজের দুর্দিনে, দেশের আহবানে বাবা ছিলেন অগ্রগামী। পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে, ঢাকাতে প্রায়শই যখন কারফিউ, হরতাল, অবরোধ, গুলি, বাবা তখন পায়ে হটে ফুলবাড়ীয়া, ময়মনসিংহ গিয়ে দেশের খবর বার্তা শোনতেন। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। শুধু তাই নয়, এলাকার তরুণদেরকে দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ করতেন। নিয়মিত বঙ্গবন্ধুর বিবৃতি শোনতেন।
পরে যখন চূড়ান্তভাবে যুদ্ধের ডাক এল, এই এলাকা থেকে আমার বাবাই নাকি প্রথম যুদ্ধে যাবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে ছিলেন। অথচ তিনি চাইলে এর উল্টোটিও করতে পারতেন। যুন্ধে না গিয়ে পরে বিজয়ী পক্ষের সাথে যোগ দিতে পারতেন। অথবা নিজ সম্পদ বাড়ানো কিংবা রক্ষার জন্য অনেকের মতন পাকিস্তানি দোসর হতে পারতেন। বাবা তার জীবনে যা কিছু করেছেন এই সিদ্ধান্তটি আমার কাছে সবচেয়ে বেশি পছন্দনীয়। দেশ প্রেম, সমাজসেবা, সৎকর্ম, এসবের জন্য আমার বাবা কোনো পুরষ্কার পায় নি। পেলে নিতেন কিনা জানি না। তবে তিনি প্রমাণ করে গেছেন, মানুষের জন্য কিছু করতে হলে, দেশের জন্য কিছু করতে হলে নিঃস্বার্থ করতে হয়। <b>(২০১৩ বই মেলায় প্রকাশিত উপন্যাস নরক থেকে)</b>

( যা না বললেই নয়, এই উপন্যাসের সময়কাল নির্ধারণ করা হয়েছে ১৯৭১ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত ।)

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top