Today 10 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

আমার দেখা পৃথিবী

: | : ২৯/০৬/২০১৩

॥৩॥

মামাদের বাড়িতে একবার এক মজার ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। আমি দেউড়িঘরে পড়তে বসেছি, চেঙ্গিস আমার অদূরে বসে তাস মিলাচ্ছে। এমন সময় অন্তঃপুরে ব্যপক হইচই পড়ে গেল শুনা যাচ্ছে। চেঙ্গিস আর আমার নাম ধরে সজোরে ডাকা হচ্ছে। কারণ ঘরে আমরা দুজনই মাত্র জোয়ানপুরুষ। ধরতে গেলে, আমার বয়স তখন বার থেকে তের আর চেঙ্গিসের ষোল কি বা সতের। বাকিরা কচিকাঁচা। তাই মামিদের পর আমাদের দাপট। চেঙ্গিস আমাকে হুকুম করে, দেখ ত কী হয়েছে।

আমি বললাম, তোর কি ঠ্যাঙ মচকেছে? আমাকে অর্ডার করিস! এখন টিচার এসে বেত মারলে ওটা কি তুই খাবি?

চেঙ্গিস খেপে বলল, দেখিস-না বেয়াদব আমি খেলছি। তাস মিলাতে মিলাতে নিজে নিজে বলছে, বড়জনদের কথাও শুনবে না–অসভ্য কোথাকার। আমি ভেটকি মেরে বললাম, অরে মোর বড়জন রে। আমার পড়া থেকে তোমার তাস মারা বড় হইছে-না? ব্যঙ্গগলায় : শুন রে, সভ্যগাধা, তোর পাছা দোলাতে দোলাতে জীবন যাবে কিন্তু দুপয়সার উপকার কারও হবে না এটা নিশ্চিত বলতে পারি; তবে এমুহূর্তে পারলে আমার উপকারটা কর, একটু নিজে গিয়ে দেখ–কী হয়েছে। বলতে-না-বলতে আন্দরমহলে আরও হুলস্থূল–দুজন ওঠে দৌড় দিলাম। মামিরা বলছে, ওরে দরজা-জানালা বন্ধ কর, লাঠি নে, লাঠি নে। আমরা দরজা-জানালা ঝটপট বন্ধ করে নিলাম। জানতে চাইলাম ব্যাপার কী। প্রায় সমস্বরে : চকির নিচে বনবিড়াল। বনবিড়াল! কি কাণ্ড রে বাবা! টর্চ মেরে দেখলাম–কুচকুচে কালো, চোখ দুটো ঝলঝল জ্বলছে। অবিকল বিড়াল তবে একটু বড়। বন্ধুদের মধ্যে আমি ছিলাম খুব ভীতু ও দুর্বল এবং অনেকটা ক্ষীণদেহীও বটে। কিন্তু চেঙ্গিস খুব সাহসী এবং সবলও বটে। দলবলে থাকলে সে দৈত্যকেও কানমলা দিতে ভয় করবে না কিন্তু একাকী দিনের বেলায়ও পথ চলতে ভয় পাবে। সবাইকে সতর্ক করে বলল, এটা লাফ দিয়ে কামড় দিতে পারে। আমাকে বলল, তুই ঐদিকে দাঁড়া, লাফ দিলে মাথায় সজোরে লাঠির এক বারি বসাবি। আর সে বাঘমারা বাহাদুরের মতো মালকোঁচা মেরে লাঠি দিয়ে গুঁতাচ্ছে। বিড়াল চতুর সরাৎ করে বের হয়ে দেয়াল বেয়ে একদৌড়ে উঠে যাচ্ছে ছাদে আর চেঙ্গিসের উপর্যুপরি লাঠি খেয়ে দুড়ুম করে পড়তে হয় মাটিতে। তারপর আর কে করে রক্ষা। তার সঙ্গে লাঠির দুয়েক বারি আমিও বসাই। সেদিন থেকে চেঙ্গিসের নামের সঙ্গে আরেকটু বাড়তি মাত্রা যোগ করে দিলাম ‘বিলাইমারা চেঙ্গিস খাঁন’।

 

মৃত বিড়ালটাকে রাতে উঠানের একপাশে পুতে রাখলাম চেঙ্গিস আর আমি। সকালে বাড়ির অনেকে এসে সনাক্ত করে, এটা বনবিড়াল না–পাশের বাড়ির লিপুদের বাড়ির চরেখাওয়া বিড়াল। এখন ভর্তুকি দিতে হবে, আড়াই সের নুন। বিলাই মারলে নাকি তেমুহনি পথে আড়াই সের লবণ রাখতে হয়। নাহলে গুনাহ্গার হতে হবে। তখন এত কিছু বুঝতাম না। বড়দের কথামতো চেঙ্গিস ও আমি আড়াই সের লবণ এনে তেমুহনি পথে রেখে এলাম। তখন থেকে কোথাও বিড়াল দেখলে এ অপরাধটা আমাকে বারবার দুখী করে।

 

আমিরাতে একবার এক চালক তার ল্যাক্সেস দামী গাড়িটা চালাচ্ছে খুব ধীরে, এমন সময় দেখি গাড়িটার সামনে দিয়ে দে দৌড় একটা সাদাকালো বিড়াল; ভদ্রলোক চাইলে কিন্তু গাড়িটা থেমে দিতে পারত, কিন্তু না–বিড়ালটাকে চাপা দিয়ে চলে গেল। বিড়ালটা দেখি মাথা ফেটে রক্তে লাল হয়ে কাতরাচ্ছে। আমি দুজন পথচারীকে ডেকে বললাম, ভাই, একটু পানি ঢাল ত; বাঁচলে তোমাদের অনেক পুণ্য হবে, যে পুণ্য হাজার এবাদতেও কামাই করা সম্ভব না। তারা পানি এনে ঢালছে, আমি চোখের পানি থামাতে পারলেও মনের কান্নার পানি থামাতে পারছি না। একটু পর বিড়ালটা দৌড় দিয়ে দেখি বিশ-বাইশ গজ দূরে একটা গাছের শিকড়ে গিয়ে মাথা রেখে হাঁপাচ্ছে। আমরা আর সেবা দিতে গিয়ে তাকে জ্বালাতন করলাম না, আরামের উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিয়ে যার যার গন্তব্যে চলে গেলাম। বিড়ালটা বাঁচল কিনা জানি না। দেশে-বিদেশে কত দেখলাম ভদ্রলোকেরা গাড়ি চাপা দিয়ে বিড়াল মারতে কিন্তু লবণের কথা দেখি কেউ মনেও করে না–মুখেও আনে না! তা হলে আমাদের লবণ-জরিমানাটা? ভাবলে এখনো দুঃখের হাসি পায়।

চলবে…

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top