নরক (পোস্ট৩)
এই নরকখানায় আমাকে বেশিদিন থাকতে হয় নি যদিও। তবে বাবাকে অনেকদিন থাকতে হয়েছে। বুবুর বিয়ের পর বাবা সবচেয়ে বেশি একা হয়ে গেলেন।
আমি শহরে থাকি, স্কুলের বন্ধুবান্ধবদের সাথে কোনো না কোনোভাবে সময় কেটেই যায়। নিঃসঙ্গ অবস্থায় পড়ে সময় কাটানোর জন্য বাবা সারাদিন হুক্কা টানতেন আর খবরের কাগজ পড়তেন। তার সতীর্থদের অনেকেই পরামর্শ দিলেন ফের বিয়ে করতে। বাবা কারো কথা কানে তুলেন নি।
বুবুর বিয়ের পর বাবা তার বাকী জীবনের পুরোটা সময় পুরুষের রান্নাই খেয়েছেন। বেশিরভাগ সময় করিম চাচাই রান্না করতেন। বাবা তার ডায়রীর ঊনাশি নম্বর পৃষ্ঠায় মাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন,
<i> আমিনা, আজ তোমার স্বামী নিজ হাতে রান্না করেছে। আড়াইশত বিঘা জমির মালিক আফাজ তালুকদার, লবণহীন পানসে ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে কাঁৎ হয়েছে। আর এসবি তোমার জন্য, সে রাতে তুমি যদি আমার সাথে বের না হতে, তাহলে আজ আমাকে এতটা একাকী থাকতে হত না। কেন যে তুমি সেই রাতে আমার কথায় রাজি হলে ? বাঙালি বধূদের নিয়ে এই এক সমস্যা, স্বামীর আদেশকে তারা ধর্মীয় বাণীর মতন মনে করে। আমরা স্বামীরা বধূদের কত কথা দু-পায়ে ডলে যাই দুর্বা ঘাসের মত। আর তোমরা স্ত্রীরা স্বামীর কোনো কথাকে অগ্রাহ্য করতে চাও না। সে রাতে যদি আমার কথা অগ্রাহ্য করে কিংবা মাথা ব্যাথার ভান করে ঘরে শুয়ে থাকতে তাহলে আজ আমাকে এতখানি নিঃস্ব হতে হত না। তুমি হয়ত বলবে আমি ইচ্ছা করেই নিঃস্ব সেজে বসে আছি। আজকাল অনেকেই বলছে আবার বিয়ে করতে, তা কি করে সম্ভব বলো ? তোমার মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। তোমার ছেলে শহরে থেকে লেখাপড়া করছে। এমতাবস্থায় আমি যদি আবার বিয়ে করি ওদেরকে লোকসমাজে বিব্র্রত হতে হবে না ? তুমি হয়ত এটাও বলবে কাজের লোক রাখলেই পারি। যে আমি সবাইকে উপদেশ দিয়ে বেড়াই নিজের কাজ নিজে করতে, নিজ স্বার্থের জন্য সেই আমি কাজের লোক রাখি কীভাবে ?
আজকাল একেবারেই সময় কাটতে চায় না। তুমি অভিমান করে দুরে চলে গেলে, একবারও আমার কথা ভাবলে না। যুদ্ধের ময়দানে পাওয়া তোমার চিঠিখানা আজ অনেকবার পড়েছি। খবরের কাগজ খোললেই নানা রকমের সংবাদ, যা পড়লেই মন খারাপ হয়ে যায়। যে দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছি, সেই দেশে এখন অনেক কিছুই হয় যা কখনো কল্পনাও করতে পারি নি !</i>
বাবার ডায়রীর এই লেখাটি সবচেয়ে দীর্ঘ। অন্যকোনো পৃষ্ঠায় এতক্ষণ ধরে আর লেখেন নি। বাবার এই লেখাটি পড়ার পর তার সম্বন্ধে আমার ধারনা অনেকটাই বদলেছে। বাবাকে সব সময় মনে হত একরোখা ও গম্ভীর প্রকৃতির, আসলে বাবা সে রকম ছিলেন না।
মেট্টিক পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি এসেছি। একটা লম্বা অবসর পাওয়া গেছে। ভেবেছিলাম এই অবসরের অনেকটা সময় বুবুদের ওখানে কাটাব। কিন্তু আমি বাড়ি এসেছি এই খবর শোনে বুবু নিজেই চলে এসেছেন।
প্রায় দুই বছর পর বুবুকে দেখে আমি রীতিমত চমকে গেলাম । আমার দ্বিতীয় প্রিয়জনকে চিনতেই পারছি না ! বুবু শাড়ী পরে আছে, দেখতে ঠিক মহিলা মহিলা লাগছে। বুবুর একটি মেয়ে হয়েছে, সবে মাত্র হাটতে গিয়ে পড়তে শিখছে। দুইতিন বার মা-মা-করার পর আমাকে মামা বলে ডাকছে। নামের বাইরে এই প্রথম কেউ আমাকে সম্বোধন করছে। ভাগ্নির মুখে মামা ডাক শোনে সামান্য লজ্জাই লাগল। নিজেকে মুরব্বি মুরব্বি লাগছে !
পরীক্ষার রেজাল্ট শোনার পর অন্যরা কতটুকু চমকে ছিলেন তা বলতে পারব না । তবে ইতোপূর্বে আমি কখনো এতখানি বিস্মিত হই নি। ভেবে পাচ্ছিলাম না আমার রেজাল্ট এত ভালো হল কীভাবে ? স্কুলের সেরা ছাত্র আমি ! টোটাল মার্ক আটশত সাতষট্টি। রেজাল্টের কথা শোনে বাবা অনেকক্ষণ আমাকে তার বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে রাখলেন। বুঝমান হবার পর সেদিনই বোধ হয় প্রথম তিনি আমাকে তার বুকের সাথে জড়িয়ে ধরেছিলেন। খুশিতে আমি লাগাতার তিনরাত তিনদিন ঘর থেকে বের হলাম না।
আমার এই এক বাতিক, যখন মন অত্যাধিক ভালো থাকে তখন একা থাকতে ইচ্ছা করে। কত লোকজন এল আমাদের বাড়িতে, আমি কারো সাথে দেখা করি নি। প্রথম রাতের অনেকটা সময় মায়ের ছবির পাশে দাড়িয়ে কেঁদেছি। বার বার জানতে ইচ্ছা করছিল মা বেঁচে থাকলে তার অনুভূতি কি হত ?
করিম চাচা মহিশের গাড়ী করে ফুলবাড়ীয়া থেকে মিষ্টি নিয়ে এলেন। বাবা নিজে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মিষ্টি বিতরণ করলেন। দ্বিতীয় দিন স্কুলের পিওন এল আমাদের বাড়িতে, আমাকে নিয়ে যেতে। তার সাথে যাওয়া তো দূরের কথা, ঘর থেকেই বের হলাম না।
পিওন সেও নাছোড় বান্দা, আমাকে না নিয়ে কিছুতেই যাবে না। রাতে রয়ে গেল। বাবা যতটা পরোপকারী ও সহনশীল ছিলেন, তার চেয়েও বেশি ছিলেন অতিথি পরায়ন। বাড়িতে যদি কোনো ফকিরও মেহমান হয়ে আসত কিংবা কোনো পথচারী যদি রাত কাটানোর জন্য আশ্রয় নিতো তাহলে আর রক্ষে নেই। এমন মেজবানি করবেন যেন কোনো রাজা বাদশাহ আমাদের বাড়িতে নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন। করিম চাচাকে দিয়ে পুকুর থেকে মাছ ধরালেন। গরম গরম বাজার করালেন পিওনকে খাওয়ানোর জন্য।
খুশির তৃতীয় দিনে খুব ভোরে আমার ঘুম ভেঙে গেল। ঘর থেকে বের না হয়ে মায়ের ছবির সামনে দাড়িয়ে চোখের জল ঝরাচ্ছি। মন ভরে কান্নাকাটি করার পর যখন পিছন ফিরে তাকালাম, দেখলাম বাবাও আমার পিছনে দাড়িয়ে কাঁদছেন। বাবাকে সেদিনই প্রথম কাঁদতে দেখলাম।
নাশতা খাওয়ার পর বাবা আমাকে স্কুলে যেতে বললেন। বাবার প্রতি আমার যত চাপা অভিমানই থাক না কেন, তার কোনো কথাই আমি অগ্রাহ্য করতে পারতাম না। কেন পারতাম না তা এখনো জানি না।
বাবার কথামত পিওনের সাথে স্কুলে গেলাম। স্কুলে পৌছার সঙ্গে সঙ্গে আরো বেশি চমকে গেলাম। গত পাঁচ বছর এই স্কুলে লখাপড়া করার পরও যারা আমাকে চিনত না বলে আমার ধারনা, তারাও আমাকে নিয়ে মাতামাতি শুরু করল। আমি যেন পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেউ হয়ে গেছি। সকল বলাবলির মূলে আমি, আমার রেজাল্ট।
হেডস্যার আমার মাথায় হাত রেখে আবেগ আপ্লুত হয়ে বললেন, সত্যি তুমি তোমার বাবার যোগ্য সন্তান।
হেডস্যারের এই কথাটি শোনার পর মনে হল তিনি আমার বাবাকে চিনেন। আমার জানা মতে গ্রামের গণ্ডি পেরিয়ে কখনো কোথাও গিয়ে থাকেন নি যে লোকটি, আমার সেই বাবাকে হেডস্যার কীভাবে চিনেন ঠিক বুঝতে পারছি না।
জীবনের প্রথম বড় কোনো পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করার পর লেখাপড়ার প্রতি ঝোঁক আরো বেড়ে গেল। ইন্টার মিডিয়েটের রেজাল্টও ভালো হল। তবে ইন্টারমিডিয়েটের রেজাল্টের কথা শোনে বাবা কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেলেন।
বাবা জলচৌকিতে শুয়ে হুক্কা টানছেন। তার কাশি তখন চরমে। সামান্য দূরে দাড়িয়ে রেজাল্টের খবর বললাম। উঠে বসতে বসতে হাত দিয়ে ইশারা করে আমাকেও চৌকিতে বসতে বললেন।
বাবার পায়ের কাছে আমি বসলাম। কাশি থামার পর আরো কাছে গিয়ে বসতে বললেন। সেদিন বাবাকে কেমন যেন অচেনা অচেনা লাগছিল। মাঝে মাঝেই বাবাকে আমার অচেনা লাগে, সেদিন একটু বেশিই লাগছিল। কেন লাগছিল জানি না।
তারপর তিনি গম্ভীর স্বরে আর শান্ত মনে কিছু কথা শোনোলেন। ঠিক কথা নয়, মন্ত্র । হ্যা মন্ত্রই বটে, মন্ত্রই যদি না হত ঐদিন বাবার মুখে কথাগুলো শোনার পর আমার জীবনের, আমার চিন্তা ভাবনার এমন পরিবর্তন হবে কেন ? ফের যেন নতুন করে জন্ম নিলাম আমি। বাবার প্রতি সব রাগ অনুরাগ ধোয়ে মুছে গেল এক নিমিষেই।
বাবার এত কাছাকাছি এর আগে কখনো বসি নি। একেবারে গা ঘেঁষে বসিয়ে প্রথমে বললেন, গত দশ বছর ধরে যে কথা বুকের ভিতরে চেপে রেখেছি, আজ তা বলার সময় এসেছে।