নরক (পোঃ5)
ঢাকা মেডিকেল কলেজে চান্স পেতে যতখানি কাঠ খড় পোড়াতে হয়, তার কিছু না পুড়িয়েই আমি চান্স পেয়ে গেলাম। এত সহজে কীভাবে চান্স পেলাম বোধগম্য হচ্ছে না। সপ্তাহখানেক বিশ্বাসই হচ্ছিল না। হয়ত বাবার দোয়ার কারণেই পেয়েছি। আমি ঢাকায় চলে এলাম। বাবা অনেক খুশি হলেন। তার উদ্ভাসিত মুখখানা আমি দেখতে পারি নি যদিও। করিম চাচার মুখে শোনেছি, আমাদের এলাকায় যদি কেউ অসুস্থ হত বাবা নাকি মুচকি হেসে বলতেন, রোগের গোষ্ঠি আর ক’টা দিন সবুর কর।
আমার ছেলে ডাক্তার হয়ে ফিরে আসুক, পরে দেখব থাকিস কোথায় ?
অতি অল্পতেই সন্তুষ্টি প্রকাশ করতেন। মানুষের সাথে প্রাণ খুলে কথা বলতেন, যা তিনি গত দশ বছর ধরে বলতেন না। আমার ভর্তির খবর শোনে খুশি হয়ে গরু জবাই করে আমাদের এলাকার লোকজনকে খায়িয়ে ছিলেন।
ঢাকায় আসার পর থেকে প্রতি মাসে আমার জন্য টাকা পাঠাতেন। একেবারে হিসেব করে যা লাগে তাই, এক পয়সাও বেশি না। আগে মাঝে মাঝেই আমার মনে একটি প্রশ্ন জাগত, মেডিকেলে ভর্তি হবার আগে বাবা বলতেন, অমাকে ডাক্তার বানানোর জন্যে প্রয়োজনে সে তার সমস্ত সম্পত্তি উজাড় করে দিবেন। আর এখন কিনা হিসাব করে টাকা পাঠাচ্ছেন ?
তিন মাস পর এই প্রশ্নের জবাব খোঁজে পেয়েছিলাম। বাবা কেন এত হিসেব করে টাকা পাঠাতেন ? অতিরিক্ত টাকা খরচ করলে যদি আমার মধ্যে বিলসিতা এসে যায়, সে জন্যই হিসাব করে টাকা পাঠাতেন। যাতে আমি বিলাসিতা শিখতে না পারি। বাবা বোকা হলেও তার অনেক পদক্ষেপই শিক্ষনীয় ছিল, অনুকরণীয় ছিল।
ঢাকায় আসার মাস তিনেক পর একদিন পায়ে হেটে চাঙ্খারপুল যাচ্ছিলাম । নতুন বন্ধুদের চটপটি খাওয়ানোয় মাস শেষ হবার কয়েকদিন আগেই টাকা ফুরিয়ে গিয়েছিল ঐ মাসে। সেজন্য দুইদিন ধরে পকেট খালি। খালি পকেট নিয়ে বিষন্ন পায়ে হেটে চাঙ্খারপুল যাচ্ছি।
হঠাৎ এক মটরসাইকেল এসে থামল আমার সামনে। আমি তব্দা খেয়ে দাড়ালাম। মটরসাইকেল আরোহী গাড়ী থেকে নেমে এসে আমার নাম জিজ্ঞেস করলেন। আমি আমার নাম বললাম। তারপর ভদ্রলোক আমার বাবার নাম বললেন, আমাদের গ্রামের নাম বললেন। আমি রীতিমত চমকে গেলাম ! এইলোক আমার বাবাকে চিনেন কীভাবে ?
মটরসাইকেলে বসিয়ে রেষ্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে নাশতা খাওয়ালেন। আমি কয়েকবার জিজ্ঞাস করলাম, আপনি আমার বাবাকে কীভাবে চিনেন ? ভদ্র্রলোক কিছু না বলে পাঁচশত টাকার একখানা নোট আমার পকেটে জোরপূর্বক ঢুকিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।
এতক্ষণ খালি পকেটে হাটতে ছিলাম, মন সামান্য খারাপ ছিল। এখন পাঁচশত টাকার চকচকে একখানা নোট পকেটে, তবু মন ভালো নেই। পাঁচশত টাকার নোট পকেটে নিয়ে হাটছি আর ভাবছি, কে এই লোক ? কেনই বা আমাকে টাকা দিয়ে গেলেন ? এই টাকা খরচ করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে ? ইত্যাদি ইত্যাদি।
এক রাতে নাইট শো দেখে নিউ মার্কেট থেকে আমি আর রতন পায়ে হেটে হোষ্টেলে ফিরছি। রতন আমার ক্লাসম্যাট। আমি সিনেমা দেখি না যদিও, কারণ বারণ আছে। সিনেমায় গিয়ে সিনেমা দেখা, অযথা বদ্ধুবাদ্ধদের সাথে ঘুরে বেড়ানো, বেহুদা টাকা খরচ করা এসব আমার গাইডলাইন বিরোধী। বাবার দেয়া গাইডলাইন ফলো না করলে লক্ষ্যচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা ঢের। যা আমি কখনই চাই না। তার দেখানো রাস্তা ধরেই আমাকে হাটতে হবে, এছাড়া আর কোনো পথ নেই।
কিন্তু ডাক্তার হওয়াই রতনের একমাত্র লক্ষ্য নয়, টুকটাক রাজনীতিও করে। মিটিং মিছিলে যায়, সুযোগ পেলে ভাষণ দিয়ে গলা ফাঁটায়। জীবনে অনেক বড় রাজনীতিবিদ হতে চায়। এছাড়া ছবি দেখা রতনের সবচেয়ে বড় শখ। ফাইনাল পরীক্ষা মিস দিতে রাজি আছে, কিন্তু রাজ্জাক কবরীর ছবি নয়। রাতে মিথ্যা বলে রিকশায় বসিয়ে আমাকে নিউমার্কেট নিয়ে গেল । আমার কোনো দোহাইকে পাত্তা না দিয়ে টেনে নিয়ে ঢোকল সিনেমা হলে।
নাইট শো শেষ করে ফেরার সময় পড়ে গেলাম টহল পুলিশের গাড়ীর সামনে। তখন দেশে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন চলছে। ছাত্রদের উপর পুলিশ ভীষণ ক্ষেপে আছে, সুযোগ পেলে ছাড় দেয় না।
হাবিলদার আর দুইজন সিপাহী নেমে এল। হাবিলদার তার গলায় এক হাড়ি কর্কশতা ঢেলে জিজ্ঞাস করলেন, এই কারা তোরা ?
আমি তো বিষম খেয়ে দাড়ালাম। শরীরে কাঁপুনি উঠে গেল, কাপড় নষ্ট করার যো। রতন মোটেও ভয় পাচ্ছে না। শনশনে গলায় জবাব দিলো, দেখতে পাচ্ছেন না, মানুষ।
হাবিলদার আরো কাছে এসে বাঁকা চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখে তো মানুষ বলে মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে চোর। তা চুরি করা শেষ, না করতে যাচ্ছিস ?
হাবিলদার এমন ভাবে ভাষণ দিতে শুরু করল, তার কথা শোনে মনে হচ্ছে চোরেরা মানুষ না, জন্তু জানোয়ার।
তারপর সিপাহী দুইজন আমাদের শরীর তল্লাসী শুরু করল। রতন শনশনে গলায় ফের বলল, আমাদেরকে আপনার চোর মনে হচ্ছে ? আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ।
রতন বোধহয় এখানেই ভুল করল। ওর বলা উচিৎ ছিল, আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ছাত্রদের উপর পুলিশ যতই ক্ষেপে থাক না কেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শোনলে একটু হলেও ভয় পায়। রাজনীতি করলেও রতন বোধহয় তখনো মিথ্যা বলা শিখেনি। ও বোধহয় তখনো জানত না, আমাদের দেশের রাজনীতিতে আজকাল যে অধিক মিথ্যাচার আর উপর লেভেলে বেশি বেশি তোষামোদ করতে পারে সে তত বড় নেতা হতে পারে।
ছাত্রের কথা শোনে হাবিলদার আর কোনো প্রশ্ন করলেন না। গলা টান করে বলল, গাড়ীতে ওঠ।
গাড়ীতে উঠার কথা শোনে রতনের শনশনে গলা একেবারেই মিনমিনে হয়ে গেল। উত্তম-মাধ্যমের কথা শোনলে বড় বড় নেতাদেরও কাপড় ঢিলে হয়ে যায়, আর রতন তো সবে মাত্র রাজনীতিতে পা রেখেছে।
কণ্ঠে নমনীয়তা এনে রতন বলল, গাড়ীতে উঠব কেন, আমরা কী অপরাধ করেছি ?
হাবিলদার তার গলার কর্কশতার সাথে দুই গামলা ধমকের ঝোল ঢেলে বলল, গাড়ীতে উঠবি, না থাপ্পর খাবি ?
থাপ্পর মারার আগেই আমরা গাড়ীতে উঠে বসলাম। পুলিশের গাড়ীতে বসে প্রায় সারা শহরময় ঘুরে বেড়ালাম। দিনের বেলা হলে ভালো হত, বিনা খরচে ঢাকা শহর ঘুরে দেখা যেত। রাতেও দেখছি, তবে এক অন্য ঢাকা। দিনের বেলার ঢাকা আর রাতের ঢাকার মধ্যে বিস্তর ফাঁরাক আছে। ভোরে আমাদেরকে থানায় নিয়ে গেল।