Today 10 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

ধারাবাহিক উপন্যাস “নরক”

: | : ০৩/০৭/২০১৩

পর্ব-৬

থানার দেওয়াল ঘেঁষিয়ে আমাদেরকে বসিয়ে রেখেছে। রাত জাগা হাবিলদার আর পুলিশ সাহেবেরা হয়ত বিশ্রাম করতে চলে গিয়েছেন। সাড়ে চার ঘন্টা থানার দেওয়াল ঘেঁষে বসে থেকে সিড়দাড়া বাঁকা করার পর একজন কনস্টেবল এসে বলল, স্যার আপনাকে ডাকে। আমি মাথা তুলে তাকানোর আগেই রতন দাড়িয়ে প্রস্তুতি নিলো পা বাড়ানোর জন্য। কনস্টেবল ততক্ষনাৎ বলল, আপনি না, ওনি। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে ইশারা করে ফের বলল, আসেন ভাই।

কনস্টেবল ডাক দেবার সাথে সাথে আমার গায়ে একশত তিন ডিগ্রি জ্বর উঠে গেল। নিশ্চয় হাবিলদার ডাকছে ! আমি তো তার সাথে কোনো রকম কথাই বলি নি। কথা যা বলার রতন বলেছে, বেয়াদবি করে থাকলে ও করেছে, ছ্যাঁছা দিতে হলে ওকে দিবে, আমাকে ডাকছে কেন ? নিশ্চিত ছ্যাঁছা দিবে। এই কনস্টেবলের আচরণ সন্দেহজনক, কেমন ওনি ওনি করছে ? অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ হলেও এখন মনে হচ্ছে মারের লক্ষণ। ছ্যাঁছা দেবার জন্যই এত ভালোভাবে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ যখন বেশি ভালো ব্যবহার করে তখন বুঝতে হবে, হয় পুলিশ নিজে বেকায়দায় আছে, না হয় সামনের জনকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করছে।
এক বুক দ্বিধা আর সংসয় নিয়ে স্যারের রুমে ঢোকলাম। সেদিন যে লোকটি জোরপূর্বক আমার পকেটে পাঁচশত টাকার নোট ঢোকিয়ে দিয়েছিল, সেই ভদ্রলোক পুলিশের পোশাক পরে চেয়ারে বসে আছেন ! চকচকে পোশাক তার গায়ে, মনে হল দারোগা টারোগা হবে।
ভিতরে ঢুকতেই একেবারে নরম স্বরে বললেন, বসো।
আমি বসতে সাহস পেলাম না। থানা পুলিশের ব্যাপার কোনটাতে দোষ আর কোনটাতে যে গুন ধরে বলা মুশকিল। আমি ভীত সংক্রান্ত নজরে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি।
লোকটি ফের বললেন, চেয়ারে বসো।
আমি সামনের চেয়ারটিতে বসলাম। লোকটি অত্যান্ত মমতামাখা কণ্ঠে বললেন, তোমাদেরকে ধরে এনেছে কেন ?
আমি বলালম, পানি খাব।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে নাশতাসহ চলে এল। আমি বুঝতে পারছিলাম না কি হচ্ছে এসব ? তবে যা হচ্ছে তা ভালো হচ্ছে বলেই মনে হল। পানি খেয়ে ধরা খাওয়ার বিবরণ দিলাম।
সবকিছু শোনার সাথে সাথে হাবিলদারকে ডাকালেন। হাবিলদার বোধহয় শোয়ে পড়েছিল। হারমার করে এসে সেলুট দিয়ে দাড়াল। লোকটি হাবিলদারকে ইচ্ছামত ঝাড়লেন। একেবারে সাপের বিষ যেভাবে ঝেড়ে নামায়। চাকরী যায় যায় অবস্থা। হাবিলদার কিছুক্ষন পর পর শুধু সরি স্যার, সরি স্যার, বলছে।
হাবিলদার বেরিয়ে যাবার পর লোকটি আমাদেরকে তার বাসায় যেতে বললেন। আমার জানতে খুব কৌতূহল হল আসলে কে এই লোক ? আমার জন্য এতসব কেন করছে ? জিজ্ঞাস করতে সাহস পেলাম না। আমি হোষ্টেলে যেতে চাইলাম, কিছুতেই যেতে দিলেন না।
তারপর আমাদেরকে তার বাসায় নিয়ে গেলেন। ফ্যামিলি নিয়ে সরকারী বাসভবণে থাকেন। আমরা সেখানে গোসল করলাম। ভদ্রলোকের স্ত্রী নিজে ভাত বেড়ে আমাদেরকে খাওয়ালেন। আমরা বাসায় যাওয়ায় মনে হচ্ছে লোকটি অনেক খুশি হয়েছেন, তার চলা ও বলায় তারি প্রমাণ পাচ্ছি।
ভদ্রলোক খাবার টেবিলে বসেই পরিচয় দিলেন। নাম আবু তাহের। বাড়ি আমাদের থানায়। শুধু আমার বাবাকেই নয়, আমাদের বাড়িঘর সবি চিনেন। নিজের পরিচয় দেবার পর এক সময় আদ্র স্বরে বললেন, আজ আমি যা, এসবি তোমার বাবার অবদান। আমাদের পরিবার ছিল নিতান্তই দরিদ্র পরিবার। মেট্টিকে ভালো রেজাল্ট করার পরও যখন লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারছিলাম না। তখন আমার মা নিয়ে গেল তোমার বাবার কাছে। তোমার বাবা আমার লেখাপড়ার সকল ব্যবস্থা করে দিলেন। লেখাপড়া শেষ করে সরকারী চাকরী পেলাম। আজকে থানার ওসি। পৃথিবীতে যে এখনো এত ভালো মানুষ আছে মাঝে মাঝে বিশ্বাস হয় না। মনে হয় পুরো ব্যাপারটাই কাল্পনিক।
তাহের সাহেবের নয়ন উপচে অশ্রু ঝরে পড়ল। বাসার আসবাবপত্র দেখে মনে হচ্ছে না এত বড় চাকরী করেন।
তাহের সাহেব চোখ মুছে ফের বললেন, চাকরী পাবার পর সবার আগে গিয়েছিলাম তোমাদের বাড়িতে। স্যারের পা ধরে সালাম করলাম।
আমি আশ্চার্য হয়ে যাচ্ছি তাহের সাহেব বাবাকে স্যার বলছেন কেন ? তিনি আর খেতে পারলেন না। তার স্ত্রী খালি প্লেট এগিয়ে দিলো।
তাহের সাহেব হাত ধোয়ে টাওয়েলে মুখ মুছে ফের বললেন, আমার চাকরীর খবর শোনে স্যার অনেক খুশি হলেন। আমি তার হাত ধরে কিছু একটা চাইতে বললাম। অনেক ভেবে স্যার আমার কাছে চাইলেন, যা চাইলেন তাও অনন্য। একজন মানুষের চিন্তা ভাবনা যে এত উচ্চ মানের হতে পারে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করা আমি তাহের তখনো জানতাম না। আমার হাত ধরে প্রতিজ্ঞা করালেন। আমিও হাসিমুখে প্রতিজ্ঞা করলাম, জীবনে যতদিন রোজগার করব একটি পয়সাও অবৈধভাবে উপার্জন করব না। আমার বাসা দেখে একটু হলেও আন্দাজ করতে পারছ স্যারের কথা আমি রেখেছি কিনা ? সারা জীবন রেখে যাব।
তাহের সাহেব নাকি মাঝে মাঝেই চিঠি লিখে বাবার শরীর স্বাথ্যের খবর নেন। তার সাথে আমার যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিল অর্থাৎ যেদিন তিনি আমার পকেটে পাঁচশত টাকার নোট ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, তার দুইদিন আগে নাকি বাবার একখানা পত্র পেয়েছেন। বাবা যেখানে আমার মেডিকেলে পড়ার ব্যাপারটি উল্লেখ করেছেন। বাবার চিঠি পেয়েই তিনি আমার সাথে দেখা করতে গিয়ে ছিলেন।
আমরা হোষ্টেলে ফিরে এলাম। তাহের সাহেবের কথা শোনে বাবার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ সহস্রগুন বেড়ে গেল। উদ্বুদ্ধ হলাম, বাবার সাথে করা ওয়াদা পালনে নতুন করে অনুপ্রেরণা পেলাম।
আমি ঢাকা চলে আসার বছর খানেক পর বাবা মারা গেলেন ! করিম চাচা বলছিল, রাতের খাবার খাওয়ার পর তার সাথে অনেকক্ষণ ধরে গল্প করেছেন। তার আগে কখনো নাকি এত দীর্ঘক্ষণ গল্প করেন নি। কাচারী ঘরটি ইট দিয়ে করবেন। আমি ডাক্তারি পড়া শেষ করার পর সেখানে চেম্বার বানাব। বাহির বাড়ির আঙ্গিনায় আরেকটি টিউবওয়েল বসাবেন। দূর দূরান্ত থেকে রোগি আসবে, তারা যাতে ঠান্ডা পানি খেতে পারে, ইত্যাদি।
গল্প শেষ করে গভীর রাতে শোতে গেলেন। সেই যে চোখ বন্ধ করলেন আর খুলেন নি।
করিম চাচা বলেন, একদম সুস্থ অবস্থায় নাকি আমার বাবা মারা গেছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে করিম চাচার এই কথাটি বিশ্বাস করা ঠিক হবে কিনা জানি না। তবে মানুষ হিসাবে এতটুকু আমাকে মানতেই হবে, প্রত্যেক মানুষের জীবনকে সময়ের ডোরে বেধে দেয়া হয়েছে। সেই ডোর ছিড়ে গেলে উড়াল না দিয়ে উপায় নেই।
আমার বাবাও উড়াল দিলেন। ধীরে ধীরে আমার সকল প্রিয়জন দূরে চলে গেল।
জানাযার নামাজের সময় আমি শেষবারের মত চমকালাম। বাবা মরে গিয়েও আমাকে চমকালেন। জানাযায় এত লোক হল, ইতোপূর্বে এত বড় লোক সমাগম আমি কখনো দেখি নি। যাদেরকে আমাদের বাড়ির ত্রি-সীমানায় কখনো দেখি নি, যাদেরকে আমি চিনি না, এমন লোকজন অগুনিত। আমাদের এলাকার এম পি, চেয়ারম্যান, শিক্ষক গন্যমান্য কেউ বাকী নেই। সবাই আফসোস করলেন, প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন বাবার আদর্শ আর নৈতিকতা নিয়ে।
যদিও সেই আফসোস, প্রশংসা আমার কাছে তেমন মূল্য রাখে না। মরার পর কাউকে ভালো কিংবা মন্দ বললেই কি আসে যায় ? মৃত মানুষ অনুভূতিহীন, লাশেরা এসবের ধারধারে না।
যদিও আমাদের দেশে অনেকক্ষেত্রে তাই করা হয়। এটা আমাদের জাতিগত বৈশিষ্ট হয়ে দাড়িয়ে গেছে। মরার পরই আমরা মানুষকে মূল্যায়ন করি।
একজন মুক্তিযোদ্ধা তার জীবদ্দশায় ভিক্ষা ভিত্তি করে জীবিকা নির্বাহ করে, আমরা কিংবা রাষ্ট্র কেউ খবর লই না। অথচ মারা যাবার পর রাষ্ট্র পুলিশ পাঠিয়ে দেয় সম্মান জানানোর জন্য।
লাশের কী আদৌ সম্মানের প্রয়োজন আছে ? শুধু তাই নয়, আমাদের রাষ্ট্রীয় বড় বড় পদকগুলো, যেমন, একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক, যারা পায় তাদের অধিকাংশই মরণাত্তর।
আমি বুঝতে পারি মৃত মানুষের পুরষ্কারের কী প্রয়োজন ? সম্মান যদি কাউকে জানাতেই হয়, জীবিত থাকতে নয় কেন ? যে কাউকে তার সৃষ্টি শৈলির যৌবনে মূল্যায়ন করা উচিৎ। এতে যাকে সম্মান জানানো হবে শুধু সে একাই নয়, পক্ষান্তরে সমাজ ও রাষ্ট্রও উপকৃত হবে। যিনি সম্মানিত হবেন, আরো ভালো কিছু করার অনুপ্রেরণা পাবেন।
গত এক বছর ধরে আমার নিজের চেহারা সম্বদ্ধে নতুন কিছু ধারনা হয়েছে। এর আগের চব্বিশ বছর আয়না দেখেছি খুব কম। এখন মাঝে মাঝে দেখি। গত চব্বিশ বছর ধরে আমার চেহারা সম্বদ্ধে যে খারাপ ধারনা ছিল ধীরে ধীরে তা ভুল বলে প্রমানিত হচ্ছে। আমার চেহারা যতটা খারাপ আমি ভেবেছিলাম, আসলে তত খারাপ নয় । এমন ধারনা হবার যুক্তিসংগত একটা কারণও আছে অবশ্য।
গত বছর বসন্ত বরণ অনুষ্ঠানে আমি একটি গান গেয়ে ছিলাম। গুন গুন করার শখ আগে থেকেই ছিল, মঞ্চে উঠে সেদিন-ই প্রথম গাইলাম। বাবা বেঁচে থাকলে এই ব্যাপারটি কীভাবে নিতেন জানি না। তবে আমার ধারনা গান কবিতা এসব বিলাসিতার মধ্যে পড়ে না, তাইতো ছাড়ি নি।
গান কেমন হয়েছিল তা বলতে পারব না। অনুষ্ঠানের শেষের দিকে পরিচয় হল বর্ষার সাথে। আপনারা হয়ত ভাবছেন, বসন্তকালে বর্ষা এল কোথায় থেকে ? (এই উপন্যাসটি ২০১৩ইং বইমেলায় এশিয়া পাবলিকেশনস থেকে প্রকাশিত হয়েছে)

 

(যা না বললেই নয়, এই উপন্যাসের সময়কাল নির্ধারণ করা হয়েছে 1971 থেকে 1993 পর্যন্ত)

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top