একটি অনুবাদ গল্প
(গল্পটি বৃটিশ কমন আরবান লিজেন্ড হিসেবে প্রচলিত)
সেটা ছিল অক্টোবরের এক কনকনে ঠান্ডা রাত। লন্ডনে প্রায়ই এ সময় বৃষ্টি হয় আর বৃষ্টির কারণে ঠান্ডার প্রকোপটা বেড়ে যায় অনেকগুণ।
জর্জ্ আর মেরি তাদের পুরনো আউডি গাড়িটা চালিয়ে বাড়ি ফিরছিল। চেস্টশায়ারের এ অঞ্চলটি তেমন জনবহুল না হওয়ায় এরকম দুর্যোগময় রাতে রাস্তা একেবারে সুনসান। গাড়ির ছাদে বৃষ্টির ধারাপাতের সংগীতময় ছন্দ আর গাড়ির ভিতরে হতে থাকা স্থানীয় বেতারে প্রচারিত ধ্রুপদী সংগীতের সুর একাকার হয়ে এক অন্যরকম গীতল পরিবেশ তৈরি করেছে। জর্জ্ গাড়ি চালাচ্ছিল নিশ্চিন্তে আর মেরি চোখ বন্ধ করে উপভোগ করছিল সে মদির পরিবেশটি।
তারা হ্যারিসনের বাড়ি গিয়েছিল। তাদের বন্ধু হ্যারিসনের বড় মেয়ে লিসার বাগদান অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। তাদের বাড়ি চেস্টশায়ারেই মেরিদের বাড়ি থেকে মাইল সাতেক দূরে। এখনও পাঁচ মাইল মতো বাকি বাড়িতে পৌঁছতে এমন সময় রেডিওর গানে ছেদ পড়লো।
স্থানীয বেতারগুলো জনস্বার্থে জরুরী ঘোষণা প্রচার করার জন্য ব্যবহার করা হয়। যান চলাচল নিরাপদ রাখার জন্য রাস্তার অবস্থা, সাবধানতা, যে কোন বিপদবার্তা ইত্যাদি প্রচার করা হয় এসব রেডিওতে।
মেরির চোখ খুলে গেল। কান খাড়া করে এ মুহূর্তে প্রচারিত ঘোষণাটা শুনছে দু‘জন। বেতারে বলছে, ‘চেস্টশায়ার পুলিশ জনসাধারণের জন্য একটি জরুরী বিপদবার্তা জারি করেছে।‘ বাক্যটি ঘোষক দুইবার বললো। ‘আজ বিকেলে কলফোর্ড্ মেন্টাল হসপিটাল থেকে একজন মানসিক রোগী পালিয়ে যাওয়ার পর এ বিপদবার্তাটি জারি করা হয়েছে। পলাতক রোগীর জন ডাউনি একজন মানসিক বিকারগ্রস্থ ভয়ানক প্রকৃতির খুনী। গত দু‘বছর আগে ধরা পড়ার আগে সে ছয়জন মানুষকে খুন করেছে। ডাউনি দেখতে বিশালকায়, প্রচন্ড শক্তিশালী এবং খুবই ভয়ংকর। চেস্টারশায়ার এলাকার জনগণকে সাবধান করা যাচ্ছে যে, তারা যেন বাড়ির দরজা-জানালা বন্ধ রাখে এবং যে কোন ধরণের অস্বাভাবিক কিছু দেখলে সাথে সাথে পুলিশকে জানায়।‘
মেরি আতঙ্কে প্রায় চিৎকার করে ওঠে, ‘একটা উন্মাদ খুনী আশেপাশেই আছে! এটাতো ভয়ঙ্কর, জর্জ্।‘
“এ নিয়ে ভেবো না। আমরা তো বাড়ির কাছাকাছিই চলে এসেছি।“ স্বামী অভয় দেয়। “আমি ভয় পাচ্ছি অন্য কারণে।“
মেরি একটু অবাক হয়ে স্বামীর মুখের দিকে তাকায়।
জর্জ্ বলে, “গাড়ির কার্বুরেটরের সেই পুরনো সমস্যা মনে হয় আবার দেখা দিচ্ছে। যে কোন সময় গাড়িটা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এরকম হলে আমাদের কোথাও থেকে হ্যারিসনকে খবর দিতে হবে। হয়তো তার বাড়িতেই আবার ফিরে গিয়ে গাড়ি ঠিক হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।“
কথাগলো বলতে বলতেই গাড়ি ক্রমশঃ ধীরগতিতে নেমে আসছিল। জর্জ্ এক্সেলেরেটরে চাপ বাড়াল কিন্তু ইঞ্জিনটা কাশির মতো কয়েকটি শব্দ করে শেষ পর্ন্তেক সম্পূর্ণ্ নীরব হয়ে গেল। জর্জ্ ঠেলে গাড়িটাকে রাস্তা থেকে সরিয়ে একটা বড় গাছের নীচে এনে রাখলো।
‘যাহ্! এখন এ বৃষ্টির মাঝে আমাদের হাঁটতে হবে।‘ রাগতঃ স্বরে বললো জর্জ্।
‘কিন্তু হাঁটলে তো এক ঘন্টার বেশি লাগবে। তার উপর এই বৃষ্টির মাঝে আমার এত দামী জুতো, জামা সব তো পুরো নষ্ট হয়ে যাবে।‘ শঙ্কিত মেরি বললো।
জর্জ্ একটু চিন্তা করে বললো, ‘তাহলে বরং এক কাজ করি। তুমি গাড়িতে অপেক্ষা করো। আমি হ্যারিসনকে ফোন করি কাছাকাছি কোথাও থেকে। ওরা নিশ্চয়ই কোনভাবে আমাদের পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করবে।‘
‘কী বলছো জর্জ্?‘ আতঙ্কিত মেরি প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে। ‘রেডিওতে কী বলেছে তুমি শুনোনি? একটা পাগল ভয়ানক খুনী এখানেই কোথাও আছে। এ অবস্থায় তুমি আমাকে একা রেখে যেতে পারোনা!‘
‘একটা কিছু তো করতে হবে সোনা।‘ জর্জ্ বুঝায় মেরিকে, ‘তুমি গাড়ির সব কটা দরজা বন্ধ করে পিছনের সীটের নীচে কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে থাকবে। আমি ফিরে দরজায় ঠিক তিনবার টোকা দিলে দরজা খুলবে।‘
‘তিনবার টোকা না শুনলে সাবধান দরজা খুলবে না।‘ মেরিকে আবার সাবধান করে বৃষ্টির মধ্যে দৌড়ে অন্ধকারে মিশে গেলো জর্জ্।
মেরি দ্রুত গাড়ির সবকটা দরজা ঠিকমতো বন্ধ করে জর্জের কথামতো পেছনের সীটের নীচে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো। সে খুব শক্ত মনের মেয়ে হলেও পরিস্থিতির কারণে বেশ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে।
তার স্বামী ফিরতে সময় নেবে সেরকমই ভেবেছিল মেরি। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ির ছাদে কিছু অদ্ভূত শব্দ শুনতে পেয়ে চমকে উঠলো সে। চরম ভীতি নিয়ে নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ করে তার স্বামীর ফেরার অপেক্ষা করতে থাকলো।
আরো মিনিট পাঁচেকের মধ্যে মেরি তার কাঙ্খিত তিনটি টোকা দরজায় শুনতে পেলো। কিন্তু গাড়ির ছাদেও একইভাবে টোকা কে দিচ্ছে? তার স্বামীরতো দরজায় কেবল তিনটি টোকা দেয়ার কথা। সে কি দরজা খুলবে? ছাদের শব্দটা বন্ধ হয়নি।এটা নিশ্চয়ই অন্য কিছুর শব্দ।
দ্বিধান্বিত মেরির ভয় আর উৎকন্ঠা সমস্ত শরীর জুড়ে কাঁপুনির সৃষ্টি করলেও সে নিজেকে কঠিনভাবে গাড়ির ভিতরে লুকিয়ে রাখে। ছাদের সে শব্দটা কয়েক মিনিটের জন্য বন্ধ হয়ে আবার শুরু হয়েছে। তবে এবার একটি নির্দিষ্ট তালে। প্রতিবার শব্দের পর একই বিরতি দিয়ে পরের শব্দটা – যেন কিছু ছাদটাকে ঘষে দিয়ে চলে যায়, আবার আসে, আবার ঘষে দিয়ে চলে যায়।
কয়েক ঘন্টা পার হলো। কনকনে শীতের রাতে কম্বলের নীচে মেরি ঘেমে ভিজে জবজবে। ইতোমধ্যে সূর্য্ উঠেছে। গাড়ির ছাদের সে শব্দটা নিরবিচ্ছিন্নভাবে চলছে। একবারের জন্যও থামেনি। মেরি ভেবে পাচ্ছেনা জর্জ্ কোথায় গেলো? কেন সে সারা রাতের মধ্যেও ফিরলো না?
হঠাৎ মেরি রাস্তায় তিন চারটা গাড়ির আওয়াজ শুনতে পায়। গাড়িগুলো খুব দ্রুতগতিতে এসে তার গাড়ির চারপাশে দাঁড়িয়েছে টের পেলো। যাক্! শেষ পর্ন্তধ্ কেউ আসলো বোধহয়-এরকম একটা স্বস্তিকর ভাবনা নিয়ে মেরি ত্বরিৎ উঠে বসে জানালা দিয়ে তাকায়।
গাড়িগুলো পুলিশের। চারটে গাড়ি থেকে ঝপ ঝপ করে পুলিশরা নেমে সবাই মেরির গাড়ির দিকে দৌঁড়ে আসে। ততক্ষণে মেরি দরজা খুলেছে। একজন পুলিশ তার হাত ধরে। বলে, ‘গাড়ি থেকে নেমে ঐ পুলিশ ভ্যানের দিকে চলুন, মিস্। আপনি এখন নিরাপদ। সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে চলুন। দৃষ্টিটা আমাদের গাড়ির উপর রেখে হাঁটুন। দয়া করে পিছনে তাকাবেন না।‘
পুলিশটির কথায় কী যেন ছিল। মুহূর্ত্ মাত্র আগে রাতভর ভয়ে উ্ৎকন্ঠায় কাটানো মেরি ভয়মুক্ত হয়েছিল। পুলিশটির কথায় আবার যেন সে ভয়, উৎকন্ঠা কয়েকগুণ বেশি হয়ে ফিরে এলো। আর মাত্র দশ গজের মধ্যে পুলিশের গাড়ি যাতে তাকে উঠতে বলছে ওরা। সে কোনভাবেই নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না।
মেরি থামলো, ঘুরলো, পিছনে তাদের পুরনো আউডি গাড়িটার দিকে তাকালো।
জর্জ্ ঝুলছে। গাড়িটা যে গাছের নীচে ছিল সে গাছটার একটা ডাল থেকে নেমে আসা রশি পেছিয়ে আছে জর্জের গলায়। বাতাসের দোলায় পেন্ডুলামের মতো তার শরীরটা দুলছে। আর জর্জের পা গাড়ির ছাদটাকে ঘষে দিয়ে চলে যাচ্ছে, আবার আসছে, আবার ঘষে দিয়ে চলে যাচ্ছে।
মেরি তারপর আর কিছু দেখে না; তার চোখ ঝাপসা হতে হতে সম্পূর্ণ্ অন্ধকারে নিমজ্জিত।