ধারাবাহিক উপন্যাস “নরক”
পর্ব-৯
সবুজ চশমা খুলল। বাবা মায়ের ছবির উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে। মাথা নিচু করে চোখ মুছছে। ঢাকা থেকে ফিরেই উত্তরের ঘরে ঢুকে ছিল । ঐ ঘরের নিচ তলায় থাকতেন সবুজের মৃত বাবা আফাজ তালুকদার । বাবার রুমে দেওয়ালে টানানো মা বাবার ছবির সামনে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে দাড়িয়ে আছে সবুজ । কিছুক্ষণ পর করিম এসে বলল, বাবাজি আপনার খাবার দিছি। হাত ধোইয়া আহেন, ভাত খাবেন।
করিম, বয়স পয়তাল্লিশের কম হবে না। রোগা ধরনের শরীর। মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। সবুজদের জমিজমা দেখাশোনা করে। সবুজ মাথা মিচু করে বিষন্ন মনে ঘর থেকে বের হল।
সবুজ বাড়িতে আসার পর থেকে কিছুতেই মন বসছে না। বুকটা কেমন যেন খালি খালি লাগছে। সারাক্ষণ শুধু মনে হচ্ছে জীবন থেকে কিছু একটা হারিয়ে গেছে। কিন্তু সেটা কি কিছুতেই বুঝতে পারছে না। ছোট বেলা থেকে তার এই এক বাতিক, কিছু কিছু জিনিস সহজে বুঝতে পারে না। অনেক সহজ কথাই তার মগজে ঢুকে না।
সবুজ তার বাবার রুমে চেয়ারে আড়ষ্ট হয়ে বসে অলস মনে ভাবছে, কেন এই উদাসিনতা ? এই উদাসিনতার মূলে কি বর্ষার সাথে সম্পর্ক বিচ্ছেদ ? না না, তা হবে কেন ? যে সম্পর্ক কখনো গড়েই উঠে নি, সে সম্পর্ক বিচ্ছেদের প্রশ্নই উঠে না।
আবার ভাবছে, সম্পর্ক গড়ে না উঠলে বর্ষার জন্য খারাপ লাগবে কেন ? তাহলে কি নিজের অজান্তেই বর্ষার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক তৈগী হয়ে ছিল ? বর্ষা একদিন আমার হাত ধরে বলেছিল, তোমার সাথে দুঃখের সাগরে ভাসতে পারি, তোমার জন্য হাসতে হাসতে মরতেও পারি।
এটা কি কোনো কবিতার চরণ ছিল, না একান্তই ওর মনের কথা ? আজও তা বুঝতে পারি না। তবে আজ সকালে বর্ষার যে পত্রখানা পেয়েছি, বর্ষা তাতে রুষ্ট হাতে লিখেছেঃ-
<i> তুমি কী ভেবেছ ? আমাকে না বলে এভাবে চলে গেলেই তুমি আমাকে ফাঁকি দিতে পারবে, কখনো না, কখনো না । আমি কাকে বিয়ে করব, না করব, সে সিদ্ধান্ত নেবার বাবা কে ? জীবন আমার সিদ্ধান্ত আমি নিজেই নেব। আমাকে না বলে বাবার কথামত চলে গিয়ে কাজটা তুমি মোটেও ঠিক করনি। বাবার মুখে শোনার পর ছুটে গিয়েছিলাম তোমাদের হোষ্টেলে। সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম তুমি বাড়ি চলে গিয়েছ। রাগে আমার শরীর ফেঁটে যাচ্ছিল। একটি প্রশ্ন আমার মনের ভেতরটা কাঠবিড়ালের মত ঠোঁকরে খাচ্ছিল, কীভাবে পারলে তুমি ? সারারাত কেঁদেছি আর শুয়ে শুয়ে ভেবেছি, সকাল হতেই একদৌড়ে চলে যাব তোমার কাছে। হোষ্টেল থেকে ঠিকানাও নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু সকাল হতেই জানি না কেন মোড বদলে গেল। ভাবলাম তোমার মত কঠোর মানুষের সাথে ঘর করতে হলে আমাকেও কঠোর হতে হবে। তাইতো সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে শাস্তি তুমি আমাকে দিয়েছ, তার তিনগুন শাস্তি আমি তোমাকে দেবো।
বাবার কথা মত ব্যারিষ্টারি পড়তে লন্ডন যাচ্ছি। লন্ডন থেকে যেদিন ফিরব, সেদিন সোজা তোমার সামনে গিয়ে দাড়াব। সেদিন শত চেষ্টা করেও তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না। আর সে অবধি আমার জন্য তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে, এটাই তোমার শাস্তি । এর চেয়ে বড় কোনো শাস্তি এই মূহুর্তে খোঁজে পেলাম না বলে এত ছোট শাস্তি তোমাকে দিলাম।
তবে হে, আমার এ শাস্তিকে তুচ্ছ ভেবে তুমি যদি অন্যকাউকে বিয়ে করে ফেলো, তাহলে প্রস্তাবে। মনে রেখো, সেদিন তুমি যদি কারো স্বামী, কারো বাবা, কারো দাদাও যদি হয়ে যাও তবু তোমার রেহাই নেই। মাইন্ড ইট।
সাধারণত কোনো চিঠি-ই আমি একবারের বেশি পড়ি না, কিন্তু বর্ষার এই চিঠিটি একাধিকবার পড়েছি, কোনো মানে খোঁজে পাই নি। পাগলের প্র্লাপ ছাড়া আর কিছুই মনে হয় নি। </i>
বারিন্দায় জলচৌকিতে বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছে সবুজ। জলচৌকির একপাশে দাড়িয়ে আছে করিম। সবুজ থালে ভাত নিতে নিতে বলল, করিম চাচা।
করিম একেবারে ঝোঁকে এসে বলল, জে বাবাজি।
আপনাকে কষ্ট করে আর রান্নাবান্না করতে হবে না। আজ থেকে আমি নিজেই রান্না করব।
আপনি রাধতে পারবেন বাবাজি ?
কেন পারব না ? ঢাকায় মাঝে মাঝে রান্না করেছি, অভ্যাস আছে।
করিম বাধা দিয়ে বলল, আপনি ক্যান কষ্ট করবেন ?
সবুজ সঙ্গে সঙ্গে বলল, কষ্ট কিসের ? বাবা নিজে যদি রান্না করতে পারতেন, আমি কেন পারব না ? আমি তার ছেলে না ?
খাবারের উপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে খানিক পর আবার বলল, আয়োজন অনেক, কচুঁভর্তা থেকে শুরু করে ডাল পর্যন্ত। কষ্ট করে এতসব রেধেছেন কেন ? আমার জন্য ঝোলটোল হলেই চলবে।
সবুজ খুব আরাম করে খাচ্ছে । বহুকাল পরে যেন সে ভাত খেতে বসেছে । শহরের মেসের খাবার, এক গামলা পানিতে এক চিমটি ডাল, সেও আবার খাদ্য নাকি ?
কিছুক্ষণ পর করিম জিজ্ঞাস করল, পাক কেমন অইছে বাবাজি ?
সবুজ খেতে খেতে বলল, ভালো। আপনার রান্নার হাত ভালো।
আমি পাক করি নাই বাবাজি।
কে করেছে ?
বেগম করছে।
ও, বেগমের রান্নার হাতও ভালো।
করিম ভাতের বাটি হাতে নিয়ে বলল, আর কয়ডা ভাত দেই বাবাজি ?
সবুজ বাধা দিয়ে বলল, না। আপনি খেয়েছেন ?
অহন খামু বাবাজি।
বেগমের বিয়ে দেয়া দরকার। ওকে বিয়ে দিচ্ছেন না কেন ?
করিম হাত চুলকাতে চুলকাতে বলল, আইজকাল সুন্দর মাইয়াগরে বিয়া দিতেও টেহা পইসা লাগে, আমার মাইয়াডা কালা। হাতে টেহা পইসা নাই। কিযে করি বুঝবার পাইতাছি না।
সবুজ খাওয়া শেষ করে হাত ধোয়ে জিজ্ঞাস করল, টাকা মানে..যৌতুক ?
করিম সামান্য উত্সাহের সঙ্গে বলল , জে বাবাজি।
যৌতুক দিয়ে বিয়ে দিবেন কেন ? যৌতুক একদিকে যেমন বেআইনি, অন্যদিকে আমাদের ধর্মীয় বিধানের পরিপন্থি। যৌতুক দিয়ে বিয়ে দিবেন না।
করিম মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল। করিমের মাথা ঝাঁকানি দেখে মনে হল না সে সবুজের এই কথাটি মানতে পারবে।
করিমই বা কী করবে ? সমাজ ব্যবস্থার এই বেহাল দশার কাছে আমরা সবাই প্রায় জিম্মি। অন্যায় অনিয়ম আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমনভাবে ঢুকে গেছে, এখন ন্যায় আর অন্যায়ের মধ্যকার প্রার্থক্য সহজে পরিলক্ষিত হয় না। অন্যায়কে মনে হয় ন্যায়, অনিয়মকেই নিয়মের মত ঠেকে।
করিম ভাতের থালটাল নিয়ে চলে যাবার পর সবুজ বসে বসে ভাবছে, করিম চাচার বোকামির প্রশংসা না করে পারছি না। করিম চাচার বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে সামান্য পূর্ব দিকে। তার বাড়ির পাশেই আমাদের কাঁঠাল বাগান। গতকাল বিকালে হাটতে হাটতে বাগান দেখতে গিয়ে ছিলাম । বাগান দেখার একফাঁকে চোখ পড়ল করিম চাচার বাড়ির দিকে। পনের ষোল বছর আগে বাড়িটি যেমন ছিল, এখনো ঠিক তেমনি আছে, কোনো পরিবর্তন নেই। দুইখান ছনের ঘর, মাটির দেওয়াল, ছন আর কলাপাতার ছাউনি।
বুদ্ধিমানের সংস্পর্ষে এলে বোকা মানুষ যেমন ক্রমশ বুদ্ধিমান হয়ে উঠে, ঠিক তেমনি বোকা মানুষের সঙ্গ পেলে বুদ্ধিমানও ধীরে ধীরে বোকা বনে যায়। আমার বাবা মহাবোকা আফাজ তালুকদারের সঙ্গ পেয়ে করিম চাচাও বোকা হয়ে গেছেন। তা নয় তো আর কি ? গত সতের বছর ধরে যে লোকটি আড়াইশত বিঘা জমির এক রকম মালিক হয়ে আছেন। শুধু তাই নয়, আমাদের সিন্ধুক থেকে শুরু করে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে তিনি হাত দিতে পারেন না। সেই লোক বলছে মেয়েকে বিয়ে দেবার মত টাকা তার কাছে নেই ! না না, একে বোকা বলা যাবে না। এই লোককে বোকা বললে পৃথিবীর সমস্ত বোকা লোকদের সম্মানহানি হবার সম্ভবনা আছে। করিম চাচার জন্য বিশেষ কোনো উপাধি এই মূহুর্তে মাথায় আসছে না।
সবুজ উঠে দাড়াল। অনেকদিন পর বাড়ি ফিরেছে, হাতে কোনো কাজ নেই। সময় কাটানোর জন্য কিছু একটা করা প্রয়োজন। পুরো গ্রামটা ঘুরে দেখলে কেমন হয় ? বানার নদের পাড়ে বসে শুকনো নদের আর্তনাদ শোনা যায় কিনা, সে চেষ্টাও করা যেতে পারে। তাছাড়া একবার বাজারেও যাওয়া দরকার । বাজারে কোনো ফার্মেসি আছে কিনা তাও জানা প্রয়োজন।
ছয় মাস পর সবুজ তার বাবার ইচ্ছামত কাচারি ঘরটিতে চেম্বার বানিয়েছে। ইট দিয়ে পাকা করার ব্যাপারটি সে আমলে নেয় নি। বাড়িতে আসার কয়েকদিন পর থেকেই দুই একজন করে রোগি আসতে শুরু করেছে। গতকাল দক্ষিনপাড়ার কানাই দাস এসেছিল তার ক্লিষ্ট মেয়েকে নিয়ে। মেয়েটি মধ্যরাতে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে, চরম পানি শূন্যতায় ভোগছিল।
মেয়ের বেহাল অবস্থা দেখে কানাই দাসের স্ত্রী হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। এই গ্রামে কলেরা অতংক অনেক পুরানো।
সবুজ সাধ্যমত চিকিৎসা করল। দুপুরের দিকে মেয়েটি মোটামোটি সুস্থ হয়ে উঠল। মেয়েকে সুস্থ হতে দেখে কানাই-র স্ত্রী দৌড়ে গিয়ে সবুজের পায়ে পড়ে গেল। তারপর কান্নাসিক্ত কন্ঠে বলল, আপনি মানুষ না দেবতা, ভগবানের আরেক রূপ।
কালকের এই ঘটনাটি সবুজের মাথা থেকে কিছুতেই নামছে না। সকালের নাশতা খাওয়ার পর বারান্দায় বসে সবুজ শুধু ভাবছে, মাঝে মাঝে বাবা বলতেন দান করার মত আনন্দ অন্য কিছুতে নেই। বাবার এই কথার মর্মার্থ আমি তখন বুঝতে পারতাম না। ভাবতাম, নিজের জিনিস অন্যকে দেবার মধ্যে আবার কিসের আনন্দ ? আজ কিঞ্চিৎ হলেও বাবার কথার সারমর্ম বুঝতে পারছি।
সালামু আলাইকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম। সবুজ মুখ না তুলে না দেখেই সালামের জবাব দিলো।
ভাইজান আমাকে চিনতে পারেন নি ?
সবুজ মাথা তুলে আগতের দিকে তাকালো । খনিকের মধ্যেই দৃষ্টি সগিয়ে নিয়ে বলল, চিনতে পারব না কেন ? তুই মজনু।
মজনু হৃষ্ট ঠোঁটে মুচকি হাসল। মজনু সবুজের খালা’ত ভাই । মাঝারি লম্বা। গায়ের রঙ নিম শ্যামলা। চিকন দেহের গঠন। দেখে রোগাসোগা মনে হয়। মাথা ভর্তি কুঁকড়ানো চুল, মনে হয় না মাথায় কখনো চিড়নি লাগায়। ছোট বেলায় অর্থাৎ যখন কৈশর থেকে যৌবনে পা দিবে তখন মজনুর নিজের নাম নিয়ে গর্বের অন্ত ছিল না। বাবার অর্থ সম্পদ কম থাকলেও নিজেকে পৃথিবীর সেরা ধনবানদের একজন ভাবত। কারণ তার নামটি সর্বকালের সেরা প্রেমিকের নামে।
মেয়েদের সামনে বুক ফুলিয়ে নিজের নাম বলত, মজনু। পরে যখন জানতে পারল এটি একটি আরবি শব্দ, আর এর বাংলা অর্থ হচ্ছে পাগল।
তখন আবার নিজের নাম নিয়ে আফসোসের সীমা রইল না। জামা কাপড় কিংবা নিত্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিসের মত যদি নাম বদলানো যেত, হয়ত নিজের নামও বদলে ফেলত সে।
সবুজদের বাড়ির বাহির আঙ্গিনা ঘেষে সড়ক চলে গেছে। মজনু ভ্যানগাড়ী নিয়ে এসেছে। গাড়ীটি সড়কে দাড়িয়ে আছে। কাধের ব্যাগ নামিয়ে রেখে মজনু ভ্যানওয়ালাকে ডাকল, এই ভ্যানওয়ালা, এইদিকে আস।
ভ্যানগাড়ী আঙ্গিনায় চলে আসল। গাড়ীতে আরও দুইটি ব্যাগ আছে। মজনু ব্যাগগুলো নামাতে নামাতে ভ্যানওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে রুক্ষ স্বরে বলল, এখন চিনতে পেরেছ, তালুকদার বাড়ি কোনটা ?
ভ্যানওয়ালা কিছু না বলে বিরক্তিকর দৃষ্টিতে মজনুর দিকে তাকাল।
ভ্যানওয়ালা চলে যাবার পর মজনু সবুজের দিকে ঝোঁকে এসে বলল, বুঝলেন ভাইজান। একেবারে খাড়া পিসাস, বলে কিনা তালুকদার বাড়ি চিনে না।
সবুজ ঠান্ডা গলায় বলল, তাতো বুঝলাম। কিন্তু ব্যাগ ভোষণ নিয়ে তুই কোথায় যাচ্ছিস ?
মজনু মুচকি হেসে বলল, আপনার এইখানে।
মানে ?
হাসিমাখা মুখ নিমিষেই মলিন করে মজনু বলল, আপনি ছাড়া আমার আর কে আছে এই পৃথিবীতে ?
সবুজ মাথা নিচু করতে করতে বলল, তা ঠিক আছে। কিন্তু ব্যাগ ভোষণ নিয়ে কেন ?
মজনু সঙ্গে সঙ্গে জবাব করল, এক্কেবারে আইসা পড়ছি।
সবুজ আর কোনো প্রশ্ন করল না। মজনু পকেট থেকে টাকা বের বলল, এই টাকাগুলো রাখেন ভাইজান।
সবুজ কিঞ্চিৎ বিস্ময়ের সুরে বলল, একেবারে এসে পড়েছিস, টাকা, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। এগুলো কিসের টাকা ?
জমিন বেচা টাকা ভাইজান।
জমি বিক্রি করেছিস কেন ?
মজনু বিরস মুখে বলল, অল্প জমিন। ঐ জমিনের ধানে বছর তো পার হয়ই না, তার উপরে কেঁচাল আর কেঁচাল। দুইদিন পর পর ক্ষেতের আইল লইয়া চাচা’ত ভাইদের সাথে কেঁচাল বাজে। তারা হইল তিন ভাই আর আমি একলা, শক্তিতে তাদের সাথে পারব ? আমার আবার মাথা খারাপ, অন্যায় দেখলে সহ্য হয় না। এইদিকে আপনারও লেখাপড়া শেষ হয় নাই যে আপনার এইখানে আইসা থাকব। এখন কী করি ? দিশকূল না পেয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম জমিজমা বিক্রি করে দেশের কপালে লাথি মেরে বিদেশ চলে যাব। আর কখনো এই দেশে ফিরে আসব না, এত ঝামেলা ভালো লাগে না। সৌদি আরব যাব বলে জমি বিক্রি করে এক দালালকে টাকা দিলাম । দালাল শুধু ঘুরায় আর ঘুরায়। মিছা কথার ঢেঁকি। ভিসা আছে তো টিকেট নাই, টিকেট আছে তো ভিসা নাই, খালি ভংচং। এইদিকে খবর লইয়া জানতে পারলাম, সৌদির নিয়ম কানুন নাকি খুবই কড়া। মারামারি ঝগড়াঝাটি এক্কেবারে নিষেধ। তারপরও যদি কেউ মারামারি করে, জেলের জেল আবার জরিমানা। মারামারি করে যদি সামান্য রক্তও বের হয় তাইলে খবর আছে, জরিমানা প্রায় বাংলাদেশের চল্লিশ হাজার টাকা। দাঁত ভাংলে আশি হাজার, হাত ভাংলে যে কত ? তার কোনো হিসাব নাই। এইসব শোনে আমার মাথায় চক্কর দিলো। আমি পাগল ছাগল মানুষ। তেড়া কথা আমার বাপের শত্রু, কেউ তেড়া কথা বললে ইচ্ছা করে মচমচ করে চাবাইয়া খাইয়া ফালাই। চিন্তা করে দেখলাম বিদেশ গিয়ে লাভ নাই। খারাপ হইলেও দেশের মাটি সোনা। সঙ্গে সঙ্গে দালালের বাড়িতে গিয়া হাজির হইলাম। শক্ত করে বললাম, বিদেশ যাব না, টাকা ফেরত দাও।
দালালের কত তালবাহানা, এত কষ্ট করে সবকিছু রেডি করলাম আর এখন বলছ বিদেশ যাবা না, এইডা কেমন কথা ?
এইসব বলে আমাকে শীতল বাতাস করতে শুরু করল। টাল্টিবাল্টি বুঝতে পেয়ে আমি বললাম, দেখ, আমি পাগলা মানুষ, আমারে চেতাইও না। আমার রাগ উঠলে হাতের কাছে যা পাই, তাই দিয়া বসাইয়া দেই।
বেটা আমার চোখ দেখে ভয় পাইছে। কিছুক্ষণ পর বলল, ঠিক আছে। রাতে থেকে, সকালে টাকা নিয়ে যেও।
কাঁচারি ঘরে বিছানা করে দিলো। বাটপার হইলেও লোক ভালো। রাতে আন্ডা দিয়ে ভাত খাওয়াইছে। সকালে পাঁচ হাজার টাকা কম দিয়ে এক্কেবারে হাত চেপে ধরে বলল, মাফ করে দেন ভাই।
আমিও চিন্তা করে দেখলাম, নগদে যা পাওয়া যায় তাই ভালো। আদম বেপারি, এদের সাথে বাটপারি করে পারব না। পাঁচ হাজার টাকা কম নিয়েই আইসা পড়লাম। কাজটা ভালো করি নাই ভাইজান ?
সবুজ হ্যা না কিছু না বলায় মজনু সোজা হতে হতে বলল, আমি জমিন দিয়ে কী করব ? জমিজমা কি আপনার কম আছে ? লাগলে ওগুলোই চাষ করব।
সবুজ জিজ্ঞাস করল, তোদের জমি কতটুকু ছিল ?
মজনু মুচকি হেসে বলল, দেড় বিঘা।
দেড় বিঘা জমি মাত্র বাইশ হাজার টাকা !
মজনুর হাসিখুশি মুখ ক্ষনিকেই মলিন হয়ে গেল। তারপর মলিন মুখে বলল, জানি ঠকা হইছে। কী করব ? গ্রামের লোকগুলো খালি সুযোগ খোঁজে। আপনি যখন জমিন বেচতে চাইবেন তখন দাম বলবে কম। আবার যখন কিনতে যাবেন তখন দাম হাকাবে দিগুন। সব ঠকবাজের মুড়া। ঠকাক, আমারে যারা ঠকাইছে, আল্লাহ তাদেরকে ঠকাবে।
মজনুকে ভেতরে যেতে বলে সবুজ আবার অড়ষ্ট হয়ে বসল। মজনু মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বাড়ির ভেতর বাড়িতে ঢোকছে । তার চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে যেন স্বর্গে এসে পৌছেছে। আনন্দে মাটিতে পা পড়ছে না।
(এই বইটি ২০১৩ বইমেলায় প্রকাশিত)
(যা না বললেই নয়-এই উপন্যাসের সময়কাল নির্ধারণ করা হয়েছে ১৯৭১ থেকে১৯৯৩ পর্যন্ত)