ধারাবাহিক উপন্যাস “নরক”
পর্ব১২
করিমের বাড়ি। রাত দশটার উপরে বাজে। করিমের বাড়িতে দুইটা মাত্র ছনের ঘর। বাড়িতে মোটামোটি সাজসজ্জা করা হয়েছে। কলাগাছ দিয়ে তোরণ বানানো হয়েছে। রঙিন কাগজ কেটে সাজানো হয়েছে চারপাশ । বেগম বধূ সেজে বিবাহের মজলিসে বসে আছে। মেয়েরা তাকে ঘিরে আনন্দ উল্লাস করছে।
বেগম শারীরিক ভাবে সামান্য মোটা। গ্রামের ভাষায় যাকে বলে দোহারা বান্ধ। লম্বা কেশ। গায়ের রঙ কালচে। ঘটক যদিও বরপক্ষের কাছে একেই শ্যামলা বলে জোর দাবি করেছে। বাস্তবে বেগম শ্যামলার চেয়েও কিঞ্চিৎ বেশি কালো।
কালো হলেও বেগমের মুখশ্রীতে মায়াবি ভাব আছে। ইদুরের দাঁতের মত চিকন দাঁত। চিকন দাঁতে যখন মুচকি হাসে মনে হয় যেন মেঘ ফোঁড়ে তারা ফুঁটেছে আকাশে।
বাহিরে শামিয়ানা খাটিয়ে মেহমানদেরকে বসতে দেওয়া হয়েছে। এলাকার মুরব্বিদের পাশাপাশি সবুজ আসাদ ও মজনু বিবাহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত আছে। ভোজন কার্য একটু আগেই সম্পাদিত হয়েছে।
সবুজ ও আসাদ শামিয়ানার বাহিরে চেয়ারে বসে গল্গ করছে। মজনু সামান্য দূরে দাড়িয়ে আছে। সবুজ যেখানে থাকবে, মজনুও সেখানে থাকবে আজকাল এটাই যেন স্বাভাবিক হয়ে দাড়িয়েছে। সবুজের কাছাকাছি থাকাটা বর্তমানে মজনুর সবচেয়ে বেশি আনন্দের ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
বারান্দায় হারিকেন জ্বলছে। অগ্রাহায়ণ মাসের দবদবে জ্যোৎস্নার কাছে হারিকেনের আলো ম্লান হয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ শামিয়ানার ভেতরে চেঁচামেচি শোনা গেল। সুরগোল শোনতেই সবুজ ও আসাদ উঠে শামিয়ানার দিকে গেল। ওদের পেছনে পেছনে মজনুও তাবুতে ঢুকল।
বরের বাবা চেঁচামেচি করছে। করিম তার সামনে নতশিরে দাড়িয়ে একের পর এক মিনতি করে যাচ্ছে।
তার সকল আকুতি মিনতিকে অগ্রাহ্য করে বরের বাবা তার তেঁতু স্বরের ভাষণ অব্যাহত রেখেছেন, আপনারা বলেছেন মেয়ে শ্যামলা, এখন দেখছি মেয়ে জাম কালো। এমন একটা মিথ্যা বলার পরও আমরা বিয়ে করাতে রাজি হয়েছি। আর এখন বলছেন টাকা দিবেন পরে ! এতবড় ধাপ্পাবাজি !
করিম মিনতি করে বলল, একটু রহম করেন। মাইয়াডার একটা ব্যবস্থা অইলেই ভিটা বাড়ি বেইচা আমি সব টেহা দিয়া দিমু।
বরের বাবার মুখে ফের খরাত্তাপ, না, তা হবে না। বিয়ের আগেই যখন এতবড় ধাপ্পাবাজি, বিয়ের পর কী হবে কে জানে ? আগে দশ হাজার টাকা গুনে দিবেন, তারপর ছেলে কবুল বলবে। তার আগে না।
বরের বাবার এমন হাই ভলিউম আওয়াজ শোনে সবুজের মেজাজ গরম হয়ে গেল। চুরির চুরি, তার উপরে সিনা জোরি !
সবুজ বলল, আপনারা শান্ত হয়ে বসুন।
বরের বাবা সঙ্গে সঙ্গে বলল, আর বসাবসি নয়। আমার সোজা কথা, টাকা দিতে পারলে এ বিয়ে হবে, নচেৎ নয়।
বরের বাবার এহেন কর্কশতা ও বচনাঘাত সবুজের মেজাজ গরম করে দিলো ক্ষনিকেই। সামান্য উত্তেজনার সুরে বলল, আপনারা জনেন না ? যৌতুক নেয়া ও দেওয়া, দুটোই সমান অপরাধ।
এই কথা শোনার পর বরের বাবার গলার ভলিউম আরো বেড়ে গেল। ক্ষনিকেই নিজেকে ভিলেন থেকে কমিডিয়ানে নামিয়ে রসিকতার সুরে বললেন, আমরা তো ভেবেছিলাম আপনারা বিয়ে দেবার জন্য আমাদেরকে ডেকেছেন, এখন দেখছি জ্ঞান দেবার জন্য পাঠশালা খুলে বসেছেন।
এই কথা শোনার পর সবুজের মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে গেল। সে বুঝতে পারছে না এখন কী বলবে ? একবার ভাবছে, এমন মুর্খ লোকের সাথে কথা বলাই উচিৎ হয় নি। আবার ভাবছে, কেন কথা বলবে না ? করিমকে তো সে কখনো পর ভাবে নি। সবসময় পরিবারের একজন ভেবে এসেছে, আপনজন বলেই জেনেছে। আর আপনজনদের বিপদে আপদে আপনজনরাই তো সবার আগে ছুটে আসবে।
খানিক চুপ থেকে সবুজ বলল, যৌতুক বাবদ এক টাকাও দেওয়া হবে না।
বরের বাবা সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে বললেন, এই তোরা শোনিস নি, এখনো বসে আছিস কেন ? উঠে আয়, উঠে আয় ।
বরযাত্রী খালি ফিরে গেল। এই খবর বেগমের কাছে পৌছতেই তার জ্যোৎস্না উজ্জ্বল মুখে অমবস্যার ঘোর অন্ধকার নেমে এল। পাথরের মূর্তির মত শক্ত হয়ে বসে আছে সে। তাকে ঘিরে বসে থাকা মেয়েরা মুখ কালো করে একে একে সবাই উঠে চলে যাচ্ছে। ভরা বাড়ি খালি হয়ে যাবার পর করিমকে দুশ্চিন্তা করতে বারণ করে সবুজ ও আসাদ নিজ নিজ বাড়ির উদ্দেশে রওনা হল।
করিমের বাড়ি খালি হয়ে গেছে। মাথার উপর পূনির্মার চাঁদ। দবদবে চাঁদের আলোয় এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। বেগম একাকী ঘরের ভেতর বসে আছে । তাকে সান্ত্বনা দেবার ভাষা করিম অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছে। তাইতো সেও অসহায়ের মত মাটির দেওয়াল ঘেঁষে বারান্দায় বসে পড়ল।
করিমের বাড়ি থেকে বের হবার একমাত্র পায়ে হাটার পথটির দুই পাশে গাছপালায় ভর্তি। একপাশে কাঁঠাল বাগান, আরেকপাশে বাঁশের ঝোঁপ। বলা যায় বাড়িটি এক রকম জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত।
সবুজ মাঝপথে এসে জঙ্গলে ছায়ার মত কিছু একটা দেখে থমকে দাড়াল। তীক্ষ্ন চোখে ভালো ভাবে খেয়াল করে দেখল, ছায়া নয় জঙ্গলে জীবন্ত মানুষ দাড়িয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাস করল, কে, কে ওখানে ?
কালো ছায়াটি হারমার করে কাছে এসে বলল, ভাইজান, আমি মজনু।
আজকাল মজনুর কোনো কিছুতেই সবুজ বিস্মিত হয় না। কারণ তার সব কর্মকান্ডই বিস্ময়কর।
মজনু মানুষ হিসাবে যেমন অন্য আট দশজনের মতন নয়, তার কর্মকান্ডও একেবারে ভিন্ন।
সবুজ জিজ্ঞাস করল, মধ্যরাতে জঙ্গলে দাড়িয়ে আছিস কেন ?
মজনু আমতা আমতা করে বলল, কাজ আছে ভাইজান।
গভীর রাতে জঙ্গলে কী কাজ ? তত্ক্ষনাত প্রশ্ন সবুজের ।
মজনু জঙ্গলে দাড়িয়ে যে কারণে মশার কামড় খাচ্ছে, তা সবুজকে বলা সমুচিন হবে কিনা বুঝতে পারছে না। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, সবুজের সঙ্গে সে মিথ্যা বলতে পারে না।
সবুজ ফএর জিজ্ঞাস করল, হাতে কি ?
মজনু হাত পিছনে নিতে নিতে বলল, কাস্তে ভাইজান।
সবুজ জিজ্ঞাসিল, কাস্তে দিয়ে কী করিস ?
মজনু বিড়বিড় করে বলল, কাজ আছে ভাইজান।
কী কাজ ? আবারো সবুজের জিজ্ঞাসা ।
মজনু খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল, ভাইজান, আমার ধারনা বেগম আত্মহত্যা করবে। সে যদি গলায় ফাঁসি দেয়, এই কাস্তে দিয়ে রশি কেটে দেবো।
সবুজ কিঞ্চিৎ বিস্ময়ের সুরে বলল, কী সব উদ্ভট কথা বলছিস ?
মজনু শান্ত গলায় বলল, গ্রামের মেয়েদের বিয়ে ভেঙ্গে গেলে তারা আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে ভাইজান।
সবুজ বলল, বেগম যে গলায় ফাঁসি দিয়েই আত্মহত্যা করবে, সে কথা তোকে কে বলেছে ?
মজনু তার হটকারী ভাষণ শুরু করল, মেয়েরা আত্মহত্যা করার জন্য তিনটি পথ অবলম্বন করে। বিষ খায়, গলায় ফাঁসি দেয়, আর দৌড়ে গিয়ে গাড়ীর নীচে পড়ে। বিয়ের আসরে হঠাৎ যখন কেঁচাল শুরু হল, তখন আমি করিম চাচার ঘরে খোঁজে দেখছিলাম বিষ টিষ আছে কিনা। ঘরে বিষ নেই। আর গ্রাম এলাকায় গাড়ীও নেই। আত্মহত্যা করতে হলে বেগমকে ফাঁসিই দিতে হবে। আর ফাঁসি দিতে এলেই কাস্তে দিয়ে রশি কেটে দেবো।
মজনু কী বলছে, সবুজ তার আগমাথা কিছুই বুঝতে পারল না। একেতে মেজাজ খারাপ, তার উপরে মজনুর হটকারীতা। সবুজের মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেল। সবুজ কিছু একটা বলতে গিয়ে আবার বলল না। জোর পায়ে বাড়ির দিকে চলে গেল।
মজনু জঙ্গলের মাঝখানে বসে আছে। মশা কামড়াচ্ছে তবু নড়াচড়া করছে না। দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনো চোর লম্বা তাড়া খেয়ে এসে জান বাঁচানোর জন্য জঙ্গলে হামাগুড়ি দিয়ে পড়েছে।
প্রায় শেষ রাতের দিকে মজনুর উদ্ভট কথাই বাস্তবে পরিনিত হল। রশি হাতে নিয়ে বেগমকে বাগানের দিকে আসতে দেখা যাচ্ছে। বেগমকে আসতে দেখে মজনু সতর্ক অবস্থান নিলো।
বেগম কাঁঠাল গাছের দিকে যাচ্ছে। মজনুও চুপি চুপি তার পেছনে পেছনে এগুচ্ছে।
বেগম গাছে রশি টানিয়ে গলায় ফাঁসি লাগানোর সাথে সাথে মজনু দৌড়ে গিয়ে রশি কেটে দিলো। তারপর চিৎকার করে করিমকে ডাকতে শুরু করল।
করিম জেগেই ছিল। আর জেগে থাকাটাই স্বাভাবিক। যে বাবার মেয়ের জীবনে এতবড় ঝড় বয়ে গেল, সেই বাবার চোখ তো নিদ্রাচ্ছ হবার কথা নয়। গ্রাম অঞ্চলে একটি কু-প্রথা প্রচলিত আছে। গ্রামে বিবাহের মজলিসে বসার পর যদি কোনো মেয়ের বিয়ে ভেঙ্গে যায়, পরবর্তীতে সেই মেয়ের বিয়ে দেয়া মুশকিল।
করিম মাটির দেওয়াল ঘেষে বসে নিজ কিসমতকে দোষারোপ করছিল। হঠাৎ ঘরের পিছনে গলা ফাঁটা চিৎকার শোনে ধেয়ে জঙ্গলের দিকে দৌড় দিলো। কাছাকাছি গিয়ে উচ্চ স্বরে জিজ্ঞাস করল, কেরা ?
মজনু বলল, চাচা, আমি মজনু।
কী অইছে ? সামান্য দূর হতেই জানতে চাইল করিম ।
বেগম গলায় ফাঁসি দিচ্ছিল। চেঁচিয়ে জবাব দিলো মজনু ।
করিম কাছে গিয়ে দেখল, বেগম মাথা নিচু করে দাড়িয়ে ফোঁফিয়ে ফোঁফিয়ে কাঁদছে। এক হাতে রশি আরেক হাতে কাস্তে নিয়ে তার পাশে দাড়িয়ে আছে মজনু।
করিম একেবারে কাছে গিয়ে বেগমের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বলল, এইডা তুই কী করতে ছিলি রে মা ? এত অবুঝ অইলে চলে ? মুশকিল যে দিছে আছানও হে-ই দিবো, হের উপরে ভরসা রাখ।
বেগমের ফোঁফানো কান্না গলা ফেঁটে বেরিয়ে এসে বিলাপে পরিনিত হল। বেগম আছড়ে পড়ল বাবার বুকে। মেয়েকে বুকে নিয়ে কান্না সিক্ত কন্ঠে করিম ফের বলল, সবুজ বাবাজি শিক্ষিৎ মানুষ। হে সবকিছু বুঝেই বিয়ায় বাধা দিছে। আমরা মুরক্ষরা কথায় কথায় ভুল করলেও শিক্ষিৎরা এত সহজে ভুল করে না।
বাবা মেয়ের সম্প্রীতি দেখে মজনুর চোখ ভিজে যাচ্ছে। জীবনে এই প্রথম ভালো কোনো কাজ করেছে। নিজ কর্মের জন্য গর্বে বুক ভরে যাচ্ছে তার।
(এই বইটি ২০১৩ বইমেলায় প্রকাশিত)
(যা না বললেই নয়-এই উপন্যাসের সময়কাল নির্ধারণ করা হয়েছে ১৯৭১ থেকে১৯৯৩ পর্যন্ত)