দুঃসাহসী শাহীন (পর্ব-৮)
এরপর ওরা শ্যামলীকে ডেকে জানিয়ে দেয়, সীমান্ত সমস্যার কারণে এদেরকে পাচার করতে আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে। শাহীনদের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখাসহ আরো কিছু নির্দেশনা শুনিয়ে ওরা চলে যায় বাইরে। এদের কথাবার্তা শুনে শাহীন এবার নিশ্চিত বুঝতে পারে যে, এরা আন্তর্জাতিক শিশু-কিশোর অপহরণ ও পাচারকারী দলের লোক। মানিক-মোস্তাক এ দলের মূল হোতা। কাল্লু-শ্যামলী ওদের সহযোগী। বিদেশে পাচার করার উদ্দেশ্যেই এরা শাহীনদেরকে অপহণ করে এনেছে। এখন শুধু সময় এবং সুযোগের অপেক্ষা করছে। এতটুকু বোঝাার পরই অস্থির হয়ে পড়ে শাহীনের কিশোর মন। শত চেষ্টা করেও সে আর ঘুমাতে পারে না। তার কৌতূহলী মনে প্রশ্ন জাগে, ওদেরকে কেনো পাঠাবে বিদেশে? এ বয়সে বিদেশে গিয়ে কী করবে ওরা? এমনি সব ভাবনায় সে এপাশ-ওপাশ গড়াগড়ি করতে থাকে।
মারাত্মক দুশ্চিন্তায় ঘুরপাক খেতে খেতে বিছানায় গড়াগড়ি করছিল শাহীন। এমন সময় তার দৃষ্টি পড়ে রুমের মেঝেতে ওদের ফেলে যাওয়া পত্রিকাটির প্রতি। সে দরজাসহ রুমের চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি দিয়ে চুপি চুপি বিছানা ছেড়ে উঠে। সাবধানে লক্ষ্য করে পাশের রুমের দরজাটা বন্ধ কি না। এরপর পত্রিকাটি হাতে নিয়ে চলে যায় বিছানায়। পত্রিকাটি কম্বলের ভিতরে নিয়ে সে বের করে ওদের আলোচিত ফিচারটি। বিরাট ফিচারের মাঝামাঝি এক জায়গায় তার চোখ আটকে যায়। সে পড়া শুরু করে, “—- এই চক্র দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নিজস্ব ভাড়াটে দালালদের মাধ্যমে, বিভিন্ন অপকৌশলে শিশু-কিশোর অপহরণ করে। অপহরণের সময় এরা শিশু-কিশোরদের অজ্ঞান করার জন্যে ক্লোরোফরম পর্যন্ত প্রয়োগ করে থাকে। এরপর অপহৃত শিশু-কিশোরদেরকে বিদেশে এমন একদল নরপশুর হাতে, মোটা টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দেয়, যারা মানুষের কিডনি ও হার্টসহ বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবসা করে – – – – – !” আর পড়তে পারে না শাহীন। দেহ-মনে কম্পন শুরু হয়ে যায় তার। থর থর করে কাঁপতে থাকে সে। কাঁপতে কাঁপতে পত্রিকাটি তার হাত থেকে বিছানায় পড়ে যায়। তার মনে পড়ে, প্রথম দিনের শ্যামলীর কথাগুলো। এখন পরিষ্কার হয়ে যায় শ্যামলীর মুখে শোনা ‘জাহান্নাম, আজরাইল’ ইত্যাদি শব্দগুলোর অর্থ। চোখে-মুখে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। তার কাছে মনে হয় এই সমাজ-সভ্যতা সবই মিথ্যা – অন্ধকার। এই অন্ধকারে সাধারণ মানুষকে ঘুমিয়ে রেখে, অপরাধের স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে এক শ্রেণীর মানুষরূপী নরপশু। এই নরপশুদেরই এক অসহায় শিকার সে। এরপর ভাবতে থাকে, এ নরপশুদের নির্মম শিকার শুধু সে একাই বা ওরা চৌদ্দ জনই নয়। পত্রিকার লেখা অনুযায়ী গোটা দেশে এমনি আরো হাজার হাজার শাহীন হয়তো শত শত নরপশুদের লোভ-লালসার শিকার। এ নরপশুদের আছে দেশীয় দালাল ; আছে বিদেশী মহাজন। আছে তথ্য সরবরাহকারী পুলিশের সোর্স ; আছে ছায়া প্রদানের রাজনৈতিক গডফাদার। সব মিলিয়ে দেশ-বিদেশ জুড়ে ওদের বিশাল নেটওয়ার্ক। সে কী করতে পারবে এই বিশাল নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে? তার কাছে মনে হয, এ সমাজের কেউ মানিক-মোস্তাক ; কেউ কাল্লু-শ্যামলী। কেউ ওদের সহযোগী দালাল ; কেউ ছায়া প্রদানকারী গডফাদার নামের ভদ্রবেশী অমানুষ। বাকিরা কেউ অসহায় ; কেউ নিষ্ক্রিয় অপদার্থ। কেউবা ব্যক্তি সার্থে অন্ধ, চোখ-কান বন্ধ ধান্ধাবাজ। ভাবতে ভাবতে তার দেহের রগগুলো টান টান হয়ে ওঠে। হাত দু’টি অজান্তেই মুষ্ঠিবদ্ধ হয়। মুষ্ঠিবদ্ধ একটি হাত উঁচু করে সে স্বগতোক্তি করে, একটা পথ তাকে খুঁজে পেতেই হবে! মুক্ত হতে হবে! তারপর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে! প্রতিশোধ নিতে হবে! সে শক্ত এবং স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে। শক্ত হয়ে উঠে বসে। পত্রিকাটি গুছিয়ে নিয়ে আগের জায়গায় রেখে আসে। এরপর শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকে মুক্তির কৌশল ও উপায় নিয়ে।