লারা আপুর পাইলট হওয়ার গল্প
লারা আপুকে যদি কেউ একবার জিজ্ঞাসা করতে পারে, `বড় হয়ে তুমি কী হবে সোনা?’ আর কোনো কথা নেই, সাথে সাথে বিছার মতো লাফিয়ে উঠে জবাব দিবে, `আমি পাইলট হবো, পাইলট। পাইলট বুঝ? ওই যে বিমানটা উড়ে যাচ্ছে, ওটা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কে, জানো? পাইলট। আমি হবো সেই পাইলট। বিমান চালাবো, হু।’
শুধু কি তাই? পাইলট হয়ে কীভাবে বিমান চালাবে তাও দেখিয়ে দিত আপু। আপু তার দুটো হাত ছড়িয়ে মুখে বিমানের মতো শব্দ করে এক পাক ঘুরে এসে বলত, `আমি পাইলট হয়ে এভাবে বিমান চালাব। বুঝেছ এবার?’
তারপর?
`তারপর আবার কি? আমি বিমান চালিয়ে ওই আকাশের মেঘের ভেতর দিয়ে শূণ্যে উড়ে যাব। আমার বিমানে থাকবে অনেক মানুষ। তাদের নিয়ে আমি একদেশ হতে চলে যাব আরেক দেশে। বুঝতে পারছ কী মজা হবে তখন?’
আমাদের বিমানে করে নেবে না, মা?
`ওম্মা, বলে কি! নেব না মানে? একশোবার নেব, হাজার বার নেব। তোমরাইতো হবে আমার বিমানের ফার্ষ্ট প্যাসেঞ্জার। আমার আম্মুকে, আব্বুকে, আপু আর ভাইয়াকে নিয়ে বসাব ঠিক আমার পাশে। তারা দেখবে, আমি কত উপর দিয়ে শোঁ-শোঁ করে বিমানটা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। তখন তারা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলবে, `এ কী করছিস! একটু আস্তে চালা না, আমরা তো ভয়ে মরে যাচ্ছি!’
আমি কি আর আস্তে চালাব, আরো জোরে চালিয়ে ভয় পাইয়ে দেব না! এক দেশ হতে নিয়ে যাব আরেক দেশে। তাঁরা আনন্দে বড়মুখ করে সবাইকে বলবে, `আমার মেয়ে একটা, লারা। পাইলট। জানের ভয় নেই। পেট ভর্তি সাহস আর বুদ্ধি। আমার জীবনেও এমন মেয়ে দেখিনি। বাপরে বাপ, কী দুঃসাহস তার!’ এভাবে প্রতিদিন লারা আপু পাইলট হওয়ার কথা চিন্তা করে রাতে ঘুমুতে যায় আর স্বপ্ন দেখে, পাইলট হয়ে বিমান নিয়ে উড়ছে আকাশে।
এতো সোজা না পাইলট হওয়া। অনেক টাকা লাগে। অনেক পড়াশোনা করতে হয়, অনেক সাহস থাকতে হয় আর করতে হয় অনেক পরিশ্রম। পাইলট হওয়ার ট্রেইনিং নিতে হয়। পরীায় পাস করলে পরেই না পাইলট।
লারা আপু আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বড় হচ্ছে তার পাইলট হওয়ার স্বপ্ন।
লারা আপু যখন পাইলট হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে কথা বলে তখন তার মা-বাবার অনেক আনন্দ হয় কিন্তু টাকা-পয়সার কথা মনে হলেই চিন্তায় পড়ে যায় তাঁরা।
লারা আপু এসব নিয়ে মা-বাবার সাথে প্রায়ই গল্প করে, একদিন তার মা বলে, `মা তুমি যে এতো পাইলট হবো, পাইলট হবো করো, পাইলট হতে হলে যে কতো টাকা-পয়সা লাগে তা কি তুমি জান?’
`লাগুক, তোমরা দিবে টাকা। বলে লারা আপু।’
মা বলে, `তোমাকে পাইলট করার মতো এতো টাকা-পয়সা তো আমাদের নেই, মা।’
লারা আপু একটুও চিন্তা করল না। একটুও মন খারাপ করল না। সে আনন্দের সাথে বলে, `মা পাইলট হতে শুধু টাকাই লাগে না, আরো অনেক কিছু লাগে।’ হাতে তুড়ি মেরে বলে, `টাকা কোনো ব্যাপার না, সাহস আর ইচ্ছাটাই হলো আসল। দেখবে টাকা ম্যানেজ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।’
লারা আপুর কথা শুনে মা মুচকি হাসি দিয়ে বলে, `আস্ত পাগল।’
একদিন লারা আপু বলল, `মা আমি পাইলট প্রশিণে ভর্তি হব।’
মা-বাবার সেই একই কথা। `এতো টাকা পাবো কই?’
লারা আপু বলে, `যা পার তাই দাও। বাকী টাকা আমি ম্যানেজ করব।’
`তুমি ম্যানেজ করবে মানে? এটা কি একটা দুটা টাকার ব্যাপার যে তুমি ম্যানেজ করে ফেলবে?’
কেউ জানত না, লারা আপু পাইলট হওয়ার জন্য সেই কবে থেকে যে টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে, ছাত্র পড়িয়ে টাকা জমাতে শুরু করেছে।
আপু পাইলট প্রশিক্ষণে ভর্তি হয়ে গেল। তার জীবনের সবচেয়ে বড় আশা পূরণ হতে যাচ্ছে। এ যে কতো বড় আনন্দের, কতো বড় সুখের তা বলার মত নয়। তার স্বপ্ন দিনে দিনে যেন আকাশের মতো বড় হতে লাগল। সে আকাশ ছুঁবে। দিন যায় মাস যায়, পুরোদমে চলছে প্রশিক্ষণ।
লারা আপু প্রশিক্ষণে খুব ভাল করছে। প্রশিক্ষণ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। সে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হতে এসে পাইলট হওয়ার নানান কথা বলে মা-বাবার সাথে। কীভাবে বিমান চালিয়ে আকাশে উড়ে, বিমানটা যখন উপরে উঠতে থাকে তখন কেমন লাগে, তারপর কীভাবে আকাশের বুকে ভেসে বেড়ায়, কীভাবে ডানে মোড় নেয়, বামে মোড় নেয় তারপর শোঁও শোঁও করে নেমে আসে মাটিতে। `মা তোমরা বিমানে না উঠলে জীবনেও বুঝতে পারবে না, এটা যে কেমন একটা ব্যাপার। আমি খালি অপোয় আছি, কবে তোমাদের নিয়ে উঠব বিমানে।’
প্রশিক্ষণ বিমান নিয়ে আকাশে উড়েছে আপু। শোঁ-শোঁ করে উড়ে চলেছে বিমান। হঠাৎ আকাশে বিকট শব্দ! বিমানটি ফেটে আগুনের গোলা হয়ে আছাড় খেয়ে পড়ল মাটিতে। এক মুহূর্তে সবকিছু শেষ হয়ে গেল। আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল পাইলট লারা আপু। লারা আপু আর নেই। আমাদের মাঝে রয়ে গেছে তাঁর অদম্য সাহস আর ইচ্ছা পূরণের গল্প।
(2009. হোটেল শেরাটন (এখন রূপসী বাংলা)। একটি পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন-এর সাথে দেখা। তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে আলাদা একটি জায়গায় বসে তাঁর অনেক কথা বললেন। তখন তিনি তাঁর মেয়ে লারার কথাও বললেন। লারা কীভাবে পাইলট হলো এবং কীভাবে দর্য়টনায় মরে গেলো। তখন তাঁর চোখ ভিজে গিয়েছিল। পরে তিনি আমাকেও আশীর্বাদ করলেন এবং সাহস দিয়ে বললেন, ইচ্ছা করলে তুমিও বড় কিছু হতে পারবে ইত্যাদি। আমি লেখিকা সেলিনা হোসেনের মেয়ে লারাকে নিয়ে লিখেছি এই গল্পটি।