দুঃসাহসী শাহীন (পর্ব-৯)
॥ প্রথম গুলি ॥
মুক্তির উপায় এবং কৌশল নিয়ে ভাবতে গিয়ে শাহীন হারিয়ে যায় সীমাহীন অন্ধকার মরুভূমিতে, যেখানে নেই কোনো পদচিহ্ন। তালাবদ্ধ ঘরের ভিতরে কঠোর নজরদারীর মধ্যে থাকার কারণে এখনো পর্যন্ত সে জানতে পারেনি বাড়িটির অভ্যন্তরে কোথায় কি আছে ; অথবা বাহিরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাই বা কেমন। এমতাবস্থায় দীর্ঘ সময় চিন্তার আবর্তে ঘুরপাক খেতে খেতে একপর্যায়ে তার মাথায় আসে, শ্যামলী নামের ঐ মহিলার সাথে তার একটা গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। এ সম্পর্ককে ব্যাবহার করে একদিকে জেনে নেয়া যাবে বাড়িটির অভ্যন্তরীণ পরিবেশ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা। অপরদিকে সম্পর্ক গড়া যাবে গেটের পাহাড়াদার কাল্লুর সাথেও। এরপর এদের সম্পর্ককে ব্যবহার করে, হয় গেটের চাবি হাতে নিয়ে ; অথবা অন্য কোনো কৌশলে বেরিয়ে যেতে হবে এ জাহান্নাম থেকে। এর আগে সাথীদের সাথে আলোচনা করতে হবে এসব বিষয়। সাথীদেরকে জানাতে হবে অপহরণকারীদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কি। কেনো তারা ওদেরকে অপহরণ করে এনেছে বা কী হতে যাচ্ছে তাদের জীবনের পরিণতি। তবে সাবধানতা হিসেবে সাথীদেরকেও এখন জানানো যাবে না তার গোয়েন্দাগিরীর কথা বা পরিকল্পনার কথা। তাহলে কিভাবে জানানো যায় সাথীদেরকে সব? তার মাথায় আসে স্বপ্নের কথা। সে সিদ্ধান্ত নেয় যে, তার রাতের দেখা তিনজন মানুষ, ওদের কথাবার্তা ও তার পত্রিকা পড়ার ঘটনাগুলো সরাসরি এভাবে সাথীদেরকে বলবে না। বরং কৌশল হিসেবে স্বপ্নের বরাত দিয়ে পুরো ঘটনা ওদেরকে জানিয়ে মতবিনিময় করবে। এসব পরিকল্পনা করতে করতে একসময় শাহীন ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন ঘুম ভাঙতেও তার বেশ বিলম্ব হয়ে যায়।
সকালে ঘুম থেকে জেগেই শাহীন দেখে, শ্যামলী অন্যান্য দিন সকালের মতো ঘর পরিষ্কার করতে এসেছে। রাতের ঐ তিন জনের ফেলে যাওয়া মদের খালি পলিপ্যাক ও সিগারেটের বর্জসহ এলোমেলো গ্লাস ও থালা-বাটিগুলো শ্যামলী গুছাচ্ছে আর প্যান প্যান করছে, Ñ “একশ’ জনের আবর্জনা কি একজনে পরিষ্কার করা যায়?” শাহীন বুঝে নেয় এইতো সুযোগ! ঝটপট সে বিছানা থেকে উঠে শ্যামলীর দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে, “কী যে বলো খালা, আমরা এতগুলো পোলাপাইন থাকতে তুমি সব সময় একা কষ্ট করতে যাবে কেনো? আমরা কি এখানে মেহমান নাকি?” বলতে বলতে অনুগত সন্তানের মতো সে শ্যামলীর আগে আগেই থালা-বাটিগুলো গুছিয়ে বারান্দায় রেখে আসে। এরপর রুমে ঢুকে ঝাড়– হাতে নিয়ে শ্যামলীকে বলে, খালা, তুমি যাও। বাইরে গিয়ে থালা-বাটিগুলো পরিষ্কার করো। ততোক্ষণে আমি ঘর ঝাড়ু দিয়ে দিচ্ছি।
শ্যামলী শাহীনের মতলব বুঝতে না পারলেও, ওকে কাজ করতে দিতে চাচ্ছিলো না। তাছাড়া সে ভাবছিলো, ছেলেটা যেভাবে কথাবার্তা বলে, মনে হয় শিক্ষিত ঘরের পোলা। কাম-কাজ হয়তো কোনো দিনই করে নাই। সে কি আর পারবে ঘর ঝাড়– দিতে? এসব ভাবনার মাঝেই শাহীন নাছোড়বান্দার মতো শ্যামলীকে ঠেলে দেয় বারান্দায়। অগত্যা সে বারান্দা থেকে থালা-বাটিগুলো নিয়ে, গ্রিলে তালা লাগিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। শ্যামলী চলে যাওয়ার পর শাহীন ওর সাথী কামালকেও জাগিয়ে তোলে। এরপর দু’জন মিলে অনভ্যস্ত হাতেই বিছানাপত্র গুছানোসহ পুরো রুমটি ঝাড়– দিয়ে পরিষ্কার করে ফেলে। শ্যামলী থালা-বাটি ধুয়ে ফিরে এসে দেখে, পুরো রুম পরিষ্কার এবং বিছানাপত্র সব গুছানো। এতে সে খুশিই হয়। শাহীনও শ্যামলীর মুখের দিকে তাকিয়ে তা বুঝতে পারে। সে বিজয়ের আনন্দ অনুভব করে। এরপর শাহীন ভাবছিলো অন্য রুমগুলোও ঝাড়– দেয়ার প্রস্তাব করবে। কিন্তু কোনোরকম সন্দেহে সে পড়তে চায় না। তাই ধীরে ধীরে অগ্রসর হবার পরিকল্পনা করে। তখন শুধু শ্যামলীকে বলে, “খালা, এখন থেকে এঘর আমরাই পরিষ্কার করে রাখবো। আর তুমি কিছু মনে না করলে, তোমার সব কাজেই অন্তত আমি তোমাকে সহযোগিতা করতে চাই। তুমি সারা দিন গাধার মতো খাটবে, আর আমরা তোমার এতগুলো পোলা শুধু বসে বসে খাবো ; তা কতোদিন চলবে? এখন যাও, আমাদের নাস্তা-পানির ব্যবস্থা করো গিয়ে।” শ্যামলী শাহীনের দিকে মায়াবী দৃষ্টি দিয়ে চলে যায় রান্নার কাজে। শাহীন শ্যামলীর দিকে তাকিয়ে খুশিমনে ভাবতে থাকে, তার প্রথম গুলিটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। এভাবে শাহীন অল্প ক’দিনের মধ্যেই শ্যামলীর শূন্য মনে বিশ্বস্ত ছেলের মতো ছোট্ট একটি আসন করে নিতে সক্ষম হয়। আর সে সুযোগে এগুতে থাকে তার পরিকল্পিত মুক্তির পথে।