স্বপ্ননীল
উপন্যাস স্বপ্ননীল,হতে-
ঈষত্ মেঘাচ্ছন্ন আকাশ । আকাশের গা ঘেঁষে ক্লান্তিহীন ছুটে চলছে এক ফালি চাঁদ । চলতি পথে সেই চাঁদ কখনো কখনো পৃথিবীর বুক জুড়ে আবছা আধার ঢেলে নিজেকে লুকিয়ে ফেলছে জমাট বাধা মেঘের আড়ালে, আবার কখনো সেই মেঘ ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে পৃথিবীকে জানিয়ে দিচ্ছে নিজের অবস্থান । এমনি এক ভীতিকর দুর্গম রজনীর জ্যোত্স্না আধারের খেলার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমি হেটে চলছি ব্রহ্মপুত্রের পাশ বেয়ে । আমার আগে আগে হেটে চলছে দশ এগারো বছরের এক কিশোরী মেয়ে । গায়ে তার ময়লাক্ত কামিছ, পরনে হাফ পেন্ট আর মাথার আউলা কেশ দেখে আমার কেন যেন হঠাত্ হঠাত্ মনে হচ্ছে, এই মেয়েটিকে আমি আগেও কোথাও দেখেছি । কিন্তু কোথায় দেখেছি ঠিক মনে করতে পারছি না । আমি শুয়ে ছিলাম বিভোর ঘুমে । ঘুমের ঘোরে শিরদেশে হঠাত্ কারও কান্না শোনতে পেলাম । জেগে দেখি কিশোরী এই মেয়েটি আমার শিথানে দাড়িয়ে কাঁদছে । আমি জিজ্ঞেস করলাম কেন কাঁদছে ? কোনো জবাব দিলো না । খানিক পর মেয়েটি যখন দরজার দিকে তাকাল সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেল । মেয়েটির পেছনে পেছনে আমিও ঘর থেকে বের হলাম । হঠাত্ দেখলাম আমরা ব্রহ্মপুত্রের কূল ঘেঁষে নিঃশব্দে হেটে চলছি । আমাদের এক পাশে সর্ষ ক্ষেত, আরেক পাশ দিয়ে কলকলিয়ে বয়ে চলছে জল তনয় ব্রহ্মপুত্র । মেঘের আড়ালে চাঁদ হারিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে জোনাকীরা এক সাথে জ্বলে ওঠে পৃথিবীকে আলোকিত করার বৃথা প্রয়াস চালাচ্ছে । দূর থেকে ভেসে আসা নৈঃশব্দ রজনীর নিঃসঙ্গতার করুণ বিলাপ ক্রমশ মনকে ভীত সংক্রান্ত করে তুলছে । নাকের ডগার সামনে হলদে সরিষার অবারিত প্রান্তর অথচ সর্ষ ফুলের সুবাস পাচ্ছি না মোটেও । এমন কি সুঘ্রাণ নেবার কোনো রকম চেষ্টাও করছি না আমি । কিশোরীর পেছনে পেছনে আমি এমন ভাবে হেটে চলছি, যেন আবেগহীন, অনুভূতিহীন পাথরের এক মূর্তি । কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, কার সাথে যাচ্ছি, আমার আগে আগে যে মেয়েটি হেটে চলছে, কে সে ? কেন সে একবারও পেছন ফিরে তাকাচ্ছে না ?ইত্যাদি কোনো প্রশ্নই আমার মনে জাগছে না !হেটে চলছি তো চলছি-ই, দ্বিধাহীন চিত্তে অজানার উদ্দেশ্যে ।
আমরা এক বাঁশবাগানে গিয়ে পৌছলাম । পাতলা পাতলা বাঁশের ঝোঁপ দেখে বাগানটিকে নতুন বলেই ঠাহরিত হচ্ছে । চন্দ্র হঠাত্ বির্বাসন নিলো মেঘের অন্তরালে । বাঁশের ছায়াগুলো গাঢ় থেকে গাঢ় হয়ে উঠছে । মেয়েটি হঠাত্ দাড়াল । মেয়েটিকে দুই কদম পেছনে ফেলে আমি থমকে দাড়ালাম । আমার শরীর শিহরিত হল । মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে অনুভূতি শক্তি ফিরে পাচ্ছি । ভেতরে ভেতরে ক্ষীণ কম্পন শুরু হয়েছে । মেঘ ফুঁড়ে চাঁদ বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে । আমার সামনে অর্থাত্ আমার থেকে চার পাঁচ গজ দূরে ঝকঝকে একটি গোর দেখতে পারছি ! একেবারেই নতুন গোর ! মনে হচ্ছে কয়েক দিন আগেই কাউকে দাফন করা হয়েছে । গোরের উপর পুঁতে রাখা খেজুরপাতাগুলো শুকায় নি অদ্য । গোরের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আরও সামনে তাকাতেই দেখলাম আদমখোর দুইটা শিয়াল শবের একটা অংশ নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে । মানুষের পা-এর মতো লাগছে । সেই পা থেকে মাংস ছিড়ে মজাদার চিবুনি দিচ্ছে লাশ খেকু শিয়াল দুটো । আমি ফের গোরের দিকে তাকালাম । না, কোথাও কোনো গর্ত দেখতে পারছি না । নতুন কবর যেমন থাকে, ঠিক তেমনি আছে । তাহলে লাশ এল কোথায় থেকে ?আশে পাশে তো আর কোনো গোর দেখতে পারছি না । আমার পেছনের ঝোঁপের বাঁশগুলো হঠাত্ শুর শুর শব্দে নাড়াচাড়া শুরু করল । ভয়ে আমার শরীর ঘামতে শুরু করেছে । ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড অস্বস্তি লাগছে । কাতর নয়নে আমি পেছন ফিরে তাকালাম । বাঁশ ঝোঁপটির দিকে তাকাতেই দেখলাম বিনা বাতাসে বাঁশগুলো এলোমেলো ভাবে দোলছে । মাটিতে তাকিয়ে দেখি মেয়েটি আমার পেছনে নেই । কী আশ্চার্য !মেয়েটি গেল কোথায় ? মেয়েটি যেখানে দাড়িয়ে ছিল ঠিক সেখানে একটি শিয়াল দাড়িয়ে আছে । আদমখোর শিয়াল বড় বড় চোখে অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ! ইতোপূর্বে কখনো আদমখোর শিয়াল না দেখলেও তার ভয়ংকর চোখ দুটো আমার কাছে পরিচিত মনে হচ্ছে । ভয়ে আমার সর্বাঙ্গ কাঁপছে । আমি ঝেড়ে দৌড় দিলাম । শিয়ালটিও আমার পেছনে পেছনে দৌড়াচ্ছে !আমি সর্ব শক্তি দিয়ে দৌড়াচ্ছি অথচ এগুতে পারছি না ।
ঘুমের ঘোরে আমি বোধ হয় চিত্কার চেঁচামেচি করতে ছিলাম । হঠাত্ দরজায় শব্দ শোনে আমার ঘুম ভাঙ্গল । (আসছে………..)