দুঃসাহসী শাহীন (পর্ব-১৩)
॥ কামালের সৎ মা ॥
আবদুল করিমের নতুন স্ত্রী সানিয়ারও কিছু গুণ আছে। তারপরও তিনি খালেক মাতবরের মেয়ে। একেবারে বাপের মতো না হলেও, বাপের কিছটাু মিল তো থাকবেই তাঁর স্বভাব-চরিত্রে। তিনি বাপের মুখে আবদুল করিমের সাজানো সংসারের কথা শুনেই এসেছিলেন সুখের কল্পনা করে। কিন্তু বাপের বিরাট বড় বাড়ি থেকে আবদুল করিমের ছোট্ট বাড়িতে পা দিয়েই তিনি কিছুটা হতাশ হয়ে যান। এরপর আবার বিয়ের ক’মাস যেতে না যেতেই সে ছোট্ট বাড়িও এভাবে তছনছ হয়ে যাবে ; আর এমন সর্বহারার স্ত্রী হিসেবে বাপের বাড়িতে গিয়ে ওঠতে হবে, তা তিনিও চিন্তা করেননি। এরপর বাপের বাড়িতে উঠার পর বাপ-ভাইদের মুখে তাঁর স্বামী সম্পর্কে তাচ্ছিল্যমূলক কথাবার্তা শোনার পর, তিনিও স্বামী আবদুল করিমকে অযোগ্য হিসেবেই ভাবতে শুরু করেন। সানিয়া তখন হিসেব করা শুরু করেন, তাঁর স্বামীর বেহিসেবী জীবন-যাপনের জন্যেই আজকে তাঁকে বাপ-ভাইদের কাছে ছোট হতে হচ্ছে। আগে যদি তিনি হিসেব করে খরচ করতেন, এবং কিছু কিছু সঞ্চয় করতেন, তাহলে তাঁর আজকে অনেক জমানো টাকা থাকতো। সে টাকায় সহজেই অন্যত্র বাড়ি-ঘর করতে পারতেন। অথবা তাঁর বাপের মতো বাড়ির পাশে ছাড়াও যদি কিছু জমি কিনে রাখতেন, তাহলেও আর আজকে এ অবস্থায় পড়তে হতো না। তাই বেহিসেবী আবদুল করিমের এ ভাসমান সংসারের একজন গৃহিনী হিসেবে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছিলেন না সানিয়া।
তারপরও দিন যায় – মাস যায় – বছর যায়। শিশু কামাল চার বছর পেরিয়ে পাঁচ বছরে পা দেয়। ততোদিনে সানিয়াও একটি পুত্র সন্তানের মা হন। আবদুল করিম হাসি মুখে আরো বেশি পরিশ্রম করতে থাকেন ছেলে দু’টির ভবিষ্যৎ চিন্তা করে। কঠোর পরিশ্রমের মধ্যেও আবদুল করিম ভুলে যান না শিশু কামালের লেখাপড়ার ব্যাপারে পরলোকগতা স্ত্রীর আকাক্সক্ষার কথা। তাই তিনি কামালের জন্য ইংরেজি-বাংলা বর্ণমালাসহ ছড়ার বই, কায়দা এবং চক-স্লেট কিনে আনেন। এরপর স্ত্রী সানিয়াকে তাছলিমার আকাক্সক্ষার কথা জানিয়ে, কামালকে লেখাপড়া করানোর চেষ্টা করতে বলেন। সকালে মসজিদের মক্তবে পাঠাতেও বলেন। কিন্তু সানিয়ার সম্পদ এবং সঞ্চয়ের প্রতি আকর্ষণ থাকলেও, লেখাপড়ার প্রতি তেমন কোনো আকর্ষণ ছিলো না। প্রাইমারি স্কুলের সেই টোনা-টুনি মার্কা কিছু লেখাপড়াই তাঁর শুরু এবং শেষ। এখন নিজেই তিনি লেখাপড়া তেমন করেন না। তাছাড়া কোলের শিশুকে নিয়েই তাঁকে বেশি ব্যস্ত থাকতে হয়। আর কামালকে তো তিনি সতীনের ছেলের মতো ফালতু ঝামেলাই মনে করেন। তাকে লেখাপড়া করাবেন তো দূরের কথা ; তার খাওয়া-ঘুম-গোসলের ব্যাপারেই তেমন আগ্রহ বোধ করেন না।
খালেক মাতবরের বিরাট বড় গৃহস্থ বাড়িতে লেখাপড়ার পরিবেশ না থাকলেও ; কাজের ছিলো না কোনো সীমা-পরিসীমা। সে পরিবেশে কামালকে লেখাপড়া করানোর বা আদর-সোহাগ দেয়ার কেউ না থাকলেও ; তাকে দিয়ে ছোটো-খাটো কাজ করানোর ছিলো অনেকেই। দিন-রাতই এটাসেটা করাতো তার নানা-নানীসহ বাড়ির প্রায় সবাই। তারপরও কামালের ছিলো লেখাপড়ার প্রচণ্ড আগ্রহ। সে ফাঁক পেলে নিজে নিজেই বই স্লেট নিয়ে বসতো। বইয়ের ছবি দেখতো। পড়ার চেষ্টা করতো। চক-স্লেট নিয়ে আঁকি-বুকি করতো। তার মা দেখতে পেলে একটা কাজের কথা বলে উঠিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতেন। কখনো বা ধমকাতেন এই বলে যে, লেখতে শিখে নাই তারপরও হুদাহুদি আকাআকি কইরা চক নষ্ট করে। তখন কামালের মন চায় ওর মাকে বলতে যে, মা তুমি শিখাইয়া দিলেইতো আমি শিখতে পারতাম। কিন্তু ভয়ে সে মাকে তা বলে না। কারণ সে দেখে, তার বাবার সাথেই তার মা মাঝে-মধ্যে রাগারাগি করেন। তখন তার বাবা প্রায়ই চুপ করে থাকেন। এমন মাকে সে কি করে এ কথাটি বলবে। তাই সে তখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার মা’র ভয়ে বই-স্লেট উঠিয়ে রেখে দেয়। মাঝে-মধ্যে সকালে মক্তবে যায়।