Today 11 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

উপন্যাস “নরক”

: | : ২২/০৭/২০১৩

পর্ব-১৪

ইউনিয়ন পরিষদের জমিতে রোপন করা কাঁঠাল গাছের কাঁঠাল চুরি করে ধরা পড়েছে চেয়ারম্যানের ভাতিজা চুন্নু আর ভ্যানওয়ালা পরিমল। আজ তার শালিসি বিচার। ইউনিয়ন পরিষদে শালিস বসেছে। বিচার করবেন অত্র এলাকার চেয়ারম্যান হামিদ খাঁ। পরিষদের মেম্বার চেয়ারম্যানের পাশাপাশি সবুজ আসাদ কুদ্দুস মজনুসহ এলাকার অনেক গন্যমান্য ব্যাক্তিবর্গ পরিষদে উপস্থিত আছেন।
চেয়ারম্যান হামিদ খাঁ শালিস কার্য শুরু করেছেন। ভ্যানওয়ালা পরিমল ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে মাটিতে বসে আছে। তার পাশেই দাড়িয়ে আছে চুন্নু । তার চেহারায় ভীতির ছোঁয়াচ নেই তেমন একটা। অবশ্য না থাকারই কথা। চাচা যেখানে বিচারক, ভাতিজা সেখানে আসামি হলেও ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বিশেষ করে আমাদের দেশের অধিকাংশ ঘটনা এরকমই বলে।
হামিদ খাঁ তার নিজ ভঙ্গিমায় ডোব দিয়ে চুন্নুর দিকে তাকিয়ে চক্ষু লাল করে বললেন , কি রে শয়তান, আমার ভাতিজা হয়ে এমন একটা কাজ কীভাবে করলি তুই ?
চুন্নু কিছু একটা বলার আগেই হামিদ খাঁ ধমক দিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে ফের বললেন, মাফ চা শয়তান, মাফ চা।
চাচার কথা অনুযায়ি চুন্নু মুখখানা ভোতা করে পাক্কা চোরের মতন ক্ষমা চেয়ে বেরিয়ে গেল।
চুন্নু বেরিয়ে যাবার পর হামিদ খাঁ মুচকি হেসে সবার উদ্দেশ্যে রসালু স্বরে বললেন, বাচ্চা ছেলে, বুঝতে পারে নি।
আঠারো ঊনিশ বছরের পরিপূর্ণ যুবককে বাচ্চা বলে অত্যান্ত সুকৌশলে হামিদ খাঁ তার আপন ভাতিজার বিচার এড়িয়ে গেলেন। চুন্নু বেরিয়ে যাবার কিছুক্ষণ পরই হামিদ খাঁর খোশজ্জ্বল চক্ষু রক্ত বর্ণ ধারণ করল। মধুর কণ্ঠ রুক্ষ হয়ে উঠল সবার অজান্তেই। পরিমলের দিকে তাকিয়ে ধমকের সুরে জিজ্ঞাস করলেন, কি রে মালাউনের বাচ্চা, চুন্নু না হয় অবুঝ। তুই তো দুই বাচ্চার বাপ। তুই কীভাবে চুরির কাঁঠাল তোর ভ্যানে করে বাজারে নিয়ে গেলি ?
পরিমলের ভেতর শুকিয়ে গেছে । যেই পরিমল জীবনে একটি মিথ্যে কথাও বলে নি, সেই আজ চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত । পরিমল কাঁপা স্বরে বলল, বিশ্বাস করেন চেয়ারম্যান সাহেব, আমি জানতাম না যে ঐ কাঁঠাল চুরির ছিল।
হামিদ খাঁ আরো ধমকের জোর বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, চোপ কর শুয়ারের বাচ্চা। তোদের মত ছোটলোকদের চিনি না মনে করেছিস ?
হামিদ খাঁর ধমক খাওয়ার পর পরিমল একেবারে অপ্রসন্ন হয়ে গেল। ভয়ে তার শরীর কাঁপতে শুরু করেছে।
হামিদ খাঁ চৌকিদারকে নির্দেশ দিলেন, পরিমলকে বাঁধার জন্য। চেয়ারম্যান সাহেবের নির্দেশ পালনের জন্য চৌকিদার পরিমলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। পরিমল অসহায়ের মতন এদিক ওদিক তাকাচ্ছে আর ঘন ঘন ঢোক গিলছে। পেছনে দাড়িয়ে থাকা পরিমলের স্ত্রী চাপা কান্না শুরু করে দিয়েছে। মায়ের কান্না দেখে দুই সস্তানও চিৎকার করে কাঁদছে।
চৌকিদার পরিমলের কাছে যেতেই সবুজ দাড়িয়ে বলল, এটা কেমন বিচার ? আসল চোরকে ছেড়ে দিয়ে, পরিমলকে বাঁধতে বলছেন।
শালিস থমকে গেল। যে হামিদ খাঁর মুখের উপরে কথা বলার সাহস আজ পর্যন্ত কারো হয় নি। সবুজ সেই হামিদ খাঁর বিচারকে ভুল বিচার বলছে ! সবার কৌতূহলি চোখ একবার সবুজের দিকে, আবার তাকাচ্ছে হামিদ খাঁর দিকে। হামিদ খাঁর প্রতিত্তর কী হয় তাই শোনার জন্য সবাই উন্মোখ হয়ে অপেক্ষা করতে শুরু করেছে।
হামিদ খাঁ খানিক পর এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে, ফের সবুজের দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত স্বরে বললেন, তুমি শহরে বড় হয়েছ বাবাজি। গ্রাম এলাকার শালিস সম্বন্ধে তোমার ধারনা নেই।
আসাদ সঙ্গে সঙ্গে দাড়িয়ে বলল, অন্যায় অন্যায়ই, তার আবার গ্রাম শহর কি ? আপনি যা করছেন, সেটা অন্যায়।
আসাদ এই কথা বলার পর উপস্থিত জনতার মুখে সম্মতির ফিঁসফিঁসানি। হামিদ খাঁ জনতার দিকে চোখ ঘুরাতেই সবাই চুপসে গেল।
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর হামিদ খাঁ ফের বললেন, তাহলে তোমাদের মতে পরিমলের কী শাস্তি হওয়া উচিৎ ?
আসাদ বলল, আসল চোরকে ছেড়ে দিতে পারলে, পরিমলকে শাস্তি দিতে হবে কেন ?
হামিদ খাঁ কিছুক্ষণ চুপ থেকে অগত্যা পরিমলকে ছেড়ে দিতে বললেন। পরিমল স্বস্ত্রী আর বাচ্চাসহ বেরিয়ে যাবার পর হামিদ খাঁ শালিসি কার্য সমাপ্ত ঘোষনা করলেন। একে একে সবাই উঠে চলে যাচ্ছে।
হামিদ খাঁ কুদ্দুস ও পরিষদের কেরানি মূক হয়ে বসে আছেন। কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে কুদ্দুস বলল, দেখলেন হুজুর, ফুসকে ডাক্তারের কেমন সাহস ? আপানার মুখের উপর বলল আপনি ভুল বিচার করেছেন !
হামিদ খাঁ কোনো উত্তর করলেন না। একবার শুধু কুদ্দুসের মুখের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর কুদ্দুস আবার বলল, আমার তো ভয় লাগছে হুজুর।
হামিদ খাঁ বড় বড় চোখ করে বললেন, কিসের ভয় ?
মনিবের মুখ খুলতে দেখে কুদ্দুস একেবারে ঝোঁকে এসে বলল, সামনে নির্বাচন। সবুজ ডাক্তার যেভাবে সমাজ সেবা করছে, শেষে আবার ইলেকশন না করে বসে !
হামিদ খাঁ ধমকের সুরে বললেন, চোপ করো মিয়া।
কুদ্দুস মুখ ভোতা করে সোজা হয়ে দাড়াল। হামিদ খাঁ তারপর গলা টান করে বললেন, সমাজে ভালো কাজ করে মানুষের বাহবা পাওয়া যায়, প্রশংসা জোটে, কিন্তু ভোট পাওয়া যায় না। ভোট পেতে হলে রাজনীতি জানতে হয়।
কুদ্দুস তার ভোতা মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে বলল, খাটি কথা হুজুর, জব্বর খাটি কথা।
সময় বিকাল। আজ আসাদের ফার্মেসি উদ্ভোদন হবার কথা। সবুজ বাজারে যাবে বলে জামা কাপড় পরেছে। জুতার আলনায় অনেক খোঁজাখোঁজি করেও তার চামড়ার জুতা জোড়া খোঁজে পেল না। বারান্দায় পা ফেলার আগেই বেগম জুতা এনে পায়ের নিচে রাখল। সবুজের ডান পা ঠিক জুতার উপরে গিয়ে পড়েছে। সবুজ জুতার দিকে তাকাতেই অভিভূত হল। সবুজ ভেবে পাচ্ছে না, বেগম কিভাবে বুঝতে পারল সে জুতা খোঁজছে ? সবুজ তো তাকে ডেকে জুতার কথা জিজ্ঞাস করে নি।
জুতায় চকচকে রঙ করা। বেগম সবুজের পায়ের কাছে বসে জুতা পরিয়ে দিতে চাইল।
সবুজ মানা করে বলল, কে কালি করে এনেছে ?
বেগম বলল, আমি নিজেই করেছি।
সবুজ বেগমের মুখের দিকে তাকাল। বেগম তার মুখ অর্ধঘোমটায় ঢেকে রেখেছে। বিকালের গোধূলিমাখা রোদ্দুর বেগমের শ্যামামুখে পড়ে মোহনীয় রূপ ধারন করেছে।
সবুজ খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর জিজ্ঞাস করল, কালি কোথায় পেলে ?
বেগম মাথা নিচু করেই জবাব দিলো, মজনু ভাই গতকাল ফুলবাড়ীয়া গিয়েছিল। তাকে দিয়ে আনিয়েছি।
কালি আনিয়ে তুমি নিজে কালি করতে গেলে কেন ? মজনুর কাছে জুতা পাঠিয়ে দিলেই পারতে। ফের বলল সবুজ ।
সবুজের পায়ের কাছে বসে জুতা পরিয়ে দিতে দিতে বেগম বলল, যে পায়ের নিচে আমার বেহেশত। সেই পায়ের জুতায় শুধু কালি কেন, জিহবা দিয়ে চেটে পরিষ্কার করতেও আমার কোনো অসুবিধা নেই।
সবুজ কিছু একটা বলতে গিয়ে থমকে গেল। বেগমের এই একটি মাত্র বাক্য তাকে স্তব্দ করে দিলো। বিবর্ণ জীবনে শিল্পের আঁচড় হয়ে এল এই বাক্য।
সবুজ আমতা আমতা করে বলল, আমার জন্য যে এতসব করছ, বিনিময়ে আমি তোমাকে কী দিয়েছি?
বেগম বলল, সবকিছুর বিনিময় করতে হয় না। তাছাড়া আপনার সব দানই তো অপরিসীম। মাথার উপর ছায়া দিয়েছেন, থাকার জন্য আশ্রয় আর বাচার জন্য পরিচয়। আপনার মতন মানুষের কাছ থেকে এইটুকু পাওয়াই যে আমি নগন্যের সাত জীবন ধন্য করে।
জুতা পরানো শেষে বেগমের বাহু ধরে টেনে তুলে মুখোমুখি দাড় করিয়ে সবুজ বলল, স্বামীর কাছে প্রত্যেক স্ত্রীর কিছু পরম অধিকার থাকে, দাবি থাকে। আমি তো এখনো তা পূরণ করতে পারি নি।
বেগম চোখ বন্ধ করে চাপা স্বরে বলল, আমার কোনো দাবি নেই। আপনি যা দিবেন স্বেচ্চায়, তাই নেবো মাথা পেতে।
সবুজ একহাত দিয়ে বেগমের ঘোমটা তুলল। গোলাপ রাঙা ঠোঁটের দিকে অপলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর ফের কাপড় টেনে ঘোমটা পরিয়ে দিয়ে বাজারের উদ্দেশ্যে বারান্দায় পা ফেলল।

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top