দুঃসাহসী শাহীন (পর্ব-১৪)
॥ কামালের শিক্ষা জীবন শুরু ॥
ছয় বছর বয়সে কামালকে তার বাবা আবদুল করিম পাশের গ্রামের সরকারি প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করে দেন। এতে কামাল খুব খুশি হয়। প্রথম দিন স্কুল থেকে নতুন বই পাওয়ার পর তার আর আনন্দ ধরে না। বাড়িতে এসেই সে বইগুলো নিয়ে বসে। প্রথম প্রথম অনেক রাত পর্যন্ত জেগে পড়ার চেষ্টা করে। বইগুলো সাথে নিয়েই বিছানায়ায় যায়। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবে, প্রতিদিন সে স্কুলে যেতে পারলে অবশ্যই অনেক লেখাপড়া করতে পারতো। কিন্তু কাজের কারণে প্রতিদিন স্কুলে যেতে পার না। তারপরও তার লেখাপড়া আটকে থাকে না। যে দিন সে স্কুলে যেতে পারে না, সেদিনের বাড়ির কাজ জেনে নেয়, পাশের বাড়ির একজন সহপাঠির কাছ থেকে। এমনি আগ্রহের সাথে লেখাপড়া করে প্রথম সাময়িক পরীক্ষায়ই কামাল ভালো ফলাফল করে। ক্লাসে দ্বিতীয় হয়। আগে সে নিয়মিত স্কুলে না যাওয়ায় শিক্ষকগণ তার দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেন নি। কিন্তু পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার পর শিক্ষকগণও তার দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেয়া শুরু করেন। এতে তার লেখাপড়ার সুযোগ এবং উৎসাহ বেড়ে যায়। দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় সে প্রথম স্থান অধিকার করে। বার্ষিক পরীক্ষায়ও প্রথম হয়েই দ্বিতীয় শ্রেণীতে উঠে।
দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় একদিন কি কাজের কারণে কামাল যথাসময়ে স্কুলে যেতে পারেনি। কাজ শেষ হলেই সে দৌড়ে স্কুলে যায়। স্কুলে গিয়ে স্যার ক্লাসে পড়াচ্ছেন দেখে ভিতরে ঢুকে না কামাল। বাইরে একটি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বই খুলে পড়া ধরতে থাকে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক কামালকে স্কুলের মাঠের উপর দিয়ে দৌড়ে যেতে দেখে লক্ষ্য করছিলেন তার দিকে। এরপর তিনি তাকে বাইরে দাঁড়িয়ে বই হাতে পড়া ধরতে দেখে এগিয়ে যান তার কাছে। শিক্ষকের অনুমতি নিয়ে তাকে ঢুকিয়ে দেন ক্লাসে। এরপর ক্লাস শেষে ঐ শিক্ষক অফিসে গেলে প্রধান শিক্ষক কামালের প্রসঙ্গটি উঠান। তখন ঐ শিক্ষক জানান, ছেলেটি ক্লাসের ফাস্টবয়। লেখাপড়ায় যেমনি আগ্রহ তার ; তেমনি স্কুলের নিয়ম-শৃঙ্খলার প্রতিও খুবই অনুগত সে। কিন্তু সে নিয়মিত যথাসময়ে স্কুলে আসতে পারে না। প্রধান শিক্ষক তথন কামালকে ডেকে জানতে চান, তার পরিচয় এবং কেনো সে নিয়মিত স্কুলে আসতে পারে না। কামালের সাথে কথা বলে প্রধান শিক্ষকও বুঝতে পারেন তার মেধা অত্যন্ত প্রখর এবং লেখাপড়ার আগ্রহও তার প্রচুর। কিন্তু বাড়ির পরিবেশের কারণে সে লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে না।
কামালদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক একদিন কামালের বাবাকে পথে পেয়ে বলেন, “জামাই মিয়া, আপনার ছেলে কামালতো বেশ মেধাবী। কথা-বার্তায়ও খুব ভালো। নিয়মিত লেখাপড়া করলে ভালো শিক্ষিত হতে পারতো। কিন্তু সে নিয়মিত স্কুলেই যেতে পারে না। আমি জিজ্ঞেস করে বুঝতে পারলাম তার লেখাপড়ার খুব আগ্রহ। কিন্তু বাড়িতে নাকি খুব কামকাজ থাকে। মাতবর সাহেবের এতো বড় বাড়ি Ñ কামকাজ তো থাকবেই। তারপরও আপনি চিন্তা করে দেখেন, ছেলেটাকে নিয়মিত স্কুলে পাঠানো যায় কি না।” প্রধান শিক্ষক কামালের প্রশংসা করায় আবদুল করিম খুব খুশি হন। কিন্তু তাকে নিয়মিত স্কুলে পাঠানোর কথা মনে করেই, পড়ে যান মহা-ভাবনায়। তিনি থাকেন পরের বাড়িতে। ওরা কামকাজ করালে কিছু বলতেও পারেন না। সানিয়া অবশ্য ইচ্ছা করলে কিছু করতে পারতো। কিন্তু সে তাকে পরের ছেলের মতোই মনে করে। আর পরের ছেলের জন্যে সে কিছু করবে এমন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। এমনি করে তিনি শুধু ভাবেন। কিন্তু এর কোনো সমাধান তাঁর মাথায় আসে না।
দেখতে দেখতে সানিয়ার কোলে আসে আরেকটি মেয়ে সন্তান। তখন তাঁদের সাংসারিক খরচ আরো বেড়ে যায়। এতে খেয়ে-পরে মাস শেষে সঞ্চয় বলতে কিছুই থাকে না। এমতাবস্থায় বাড়ি-ঘর করার কোনো পথই দেখতে পান না সানিয়া। এমনি ভাবনার মাঝেই সানিয়া দেখতে পান, তাঁর বাবা খালেক মাতবর দু’ ছেলেকে পৃথক বাড়ি করার জন্য জায়গা দিয়েছেন। সানিয়া ভেবেছিলেন তাঁকেউ হয়তো একটু জায়গা দিবেন স্থায়ীভাবে বাড়ি-ঘর করার জন্যে। কিন্তু সে আশা আশাই থেকে যায়। বিপদের সময় খুব একটা যোগ-বিয়োগ না করেই তিনি স্বামীকে উৎসাহিত করেছিলেন, তাঁর বাপের ভিটায় ওঠার জন্যে। তিনি ভেবেছিলেন, বিরাট বড় সে বাড়িতে তাঁদের মতো ছোট্ট একটি পরিবারের তেমন কোনো সমস্যাই হওয়ার কথা নয়। তিনি বরং মা-বাবার কাছাকাছি থেকে আনন্দই পাবেন। কিন্তু বাপের বাড়িতে বছরখানেক থাকার পরই তিনি বুঝতে পারছেন তাঁর সে হিসেব কতোটা ভুল। তাঁর ছেলে আবদুর রহিমের বয়সও দু’বছর হয়ে যায়। এতোদিন তিনি ছেলেকে নিজেই আগলে রাখতেন। এখন মেয়ে হওয়ার পর তা আর পারেন না। আবদুর রহিমও হাঁটা-চলা শিখে ফেলে। সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। নানা-নানীর কাছেও যায়। মামাতো ভাই-বোনদের সাথে খেলাধুলা করে। মামাতো ভাই-বোনদের অনেক রকম খেলনা এবং রং-বেরং এর কাপড়-চোপড় দেখে আবদুর রহিমও বায়না ধরে তাকে ওগুলো এনে দেয়ার জন্যে। সানিয়া তাঁর স্বামীর আয় এবং সংসারের ব্যয়ের দিকে তাকিয়ে পারেন না ছেলের বায়না পূরণের কথা স্বামীকে বলতে। একসময়ে তাঁর মনে হয়, তাঁর বাবা খালেক মাতবর ইচ্ছে করলে নাতির এ আবদার পূরণ করতে পারতেন। কিন্তু করছেন না। তাঁর মনে প্রশ্ন জাগে, কেনো করছেন না তিনি? তাঁর বাবা কি তাহলে ছেলে এবং মেয়েদের ঘরের নাতি-নাতনীদেরকে সমান চোখে দেখেন না? মনে এমন প্রশ্ন জাগার পর সানিয়া তাঁর বাবার সব আচার-আচরণ নিয়ে সুক্ষ্মভাবে ভাবতে থাকেন। এতে তিনি বুঝতে পারেন, তাঁর বাবা খালেক মাতবর ছেলেদের নামে জমি কিনতে, ছেলেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তাদেরকে ব্যবসার মোটা অঙ্কের পুঁজি দিতে, মোটা অঙ্কের টাকা খরচ করে বিদেশে পাঠাতে যে পরিমান আগ্রহী ; সে পরিমান আগ্রহী নন মেয়েদের শুধু খোঁজ-খবর নেয়ার ব্যাপারেও। তিনি ছেলেদের শ্বশুরবাড়ি থেকে পাওয়া আসবাব পত্র আনন্দের সাথে ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু মেয়েদেরকে কিছু দেয়ার প্রসঙ্গ উঠলে বলেন, “তিনি এসব মোটেও পছন্দ করেন না।” এসব লক্ষ্য করে সানিয়া তাঁর স্বামীর দিকে আরো বেশি মনোযোগী হন। স্বামীর আয়-রোজগারের দিকে নতুন করে দৃষ্টি দেন। স্বামীর আয়-রোজগার কিভাবে বাড়ানো যায় সে ভাবনা শুরু করেন।