উপন্যাস “নরক”
পর্ব-১৮
নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে মজনু ও মতিন সড়ক ধরে বাড়ি ফিরছে। মাঝ পথে এসে মতিন হঠাৎ বলল, ভাইজান একটা কথা বলব ?
মজনু বলল, বল।
একেবারে খালি হাতে ভোট চাইতে ভালো লাগে না।
খালি হাতেই চাইতে হবে।
হতাশার স্বরে মতিন জিজ্ঞস করল, কেন ভাইজান ?
মজনু বলল, ভাইজান কী বলেছে শোনিস নি ? ভাইজান বলেছে, সে একজন ভালো মানুষ। নির্বাচনে জিততে পারলে অন্যান্যদের মত সরকারি মাল লুটে খাবে না। যারা সরকারি মালামাল লুটে খাবার জন্য প্রতিনিধি হতে চায়, নির্বাচনে দাড়িয়ে তারাই বস্তা বস্তা টাকা খরচ করে, ভোট কিনে।
আরো দুই কদম এগিয়ে চিন্তিত স্বরে মতিন বলল, পাবলিক ভোট দিবে তো ?
মজনু জোর গলায় বলল, অবশ্যই দিবে। ভাইজানের মতন ভালো মানুষ এরা কোথায় পাবে শোনি…
মজনুর কথা শেষ না হতেই বিপরীত দিক থেকে হাসমতের আগমন ঘটল। হাসমতকে দেখে মজনু চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। হাসমতের দিকে তাকিয়ে মতিন উচ্ছ্বাসিত স্বরে বলল, কী খবর হাসমত ভাই ? ডাক্তার সাহেবকে ভোট দিতে হবে কিন‘।
হাসমত সঙ্গে সঙ্গে বলল, অবশ্যই দেবো। ডাক্তার সাহেবকে ভোট দেবো না তো কাকে দেবো ?
তারপর মতিনের কাছে এসে বলল, দে, একটা সিগারেট দে। বিড়ি খেতে খেতে কাশি হয়ে গেছে।
মতিনের ভ্রু কুঞ্চিত হল। মুখে কিছু না বলে মতিন মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে।
মজনু উচু স্বরে বলল, কিসের সিগারেট ?
হাসমত বলল, ভোট চাইতে আসছেন, সিগারেট নিয়ে আসেন নাই ? খালি হাতে ভোট চাইলে পাবলিক ভোট দিবে ?
মজনু অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, যে দেবার সে দিবে।
হাসমত ফের বলল, হামিদ খাঁর লোকেরা বাজারে স্টল খুলেছে। বাজারে গেলেই চা পান সব ফ্রি। আর আপনারা ভোট চাচ্ছেন খালি হাতে। পাবলিক তো ভোট দিবে না ভাইসাহেব।
মজনু রুক্ষ স্বরে বলল, তুই এখান থেকে যাবি, না থাপ্পর খাবি ?
হাসমত দুই কদম সরে গিয়ে বলল, এইভাবে থাপরাথাপরি করলে, পাবলিক তো ভোট দিবেই না, উল্টা উস্টা দিবে।
হাসমতের এই কথা শোনার পর আক্রুশে মজনুর শরীর ফেঁটে যেতে চাচ্ছে। মতিন বুঝতে পেয়ে মজনুকে টেনে নিয়ে বাড়ির দিকে চলে গেল।
হাসমত দাড়িয়ে দাঁত ফুলিয়ে মিটমিট করে হাসছে। মনে হচ্ছে মজনুকে রাগাতে পেরে সে খুব আনন্দ পেয়েছে।
তালুকদার বাড়ি। পশ্চিম আকাশ ঘেষে সূর্য নেমে পড়েছে নাড়িকেল গাছের নিচে। সবুজ বারান্দায় বসে পত্রিকা পড়ছে। সকালে বৃষ্টি হওয়ায় আজ পত্রিকা আসতে দেরি হয়েছে বলে অপরাহ্নের গোধূলি মাখা রোদের ঝলকে সবুজ পত্রিকার পাতায় চোখ ঘুরাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর চা নিয়ে এসে বর্ষা বলল, নিন চেয়ারম্যান সাহেব।
পত্রিকার পাতায় দৃষ্টি অব্যাহত রেখেই সবুজ চিকন সুরে বলল, নির্বাচন কি শেষ হয়ে গেছে ?
সবুজের প্রশ্নের কোনো মানে খোঁজে না পেয়ে বর্ষা অপ্রস্তুত স্বরে বলল, মানে ?
সবুজ তার নিজ ভঙ্গিমায় বলল, নির্বাচন শেষ না হতেই আমি চেয়ারম্যান হলাম কীভাবে ?
বর্ষা সামনে চেয়ার বসতে বসতে আহ্লাদের সুরে বলল, বা রে, নির্বাচন শেষ না হলেই কি ? নির্বাচনের পর তুমিই যেহেতু চেয়ারম্যান হবে, সেজন্য আগে থেকে চেয়ারম্যান ডেকে মুখের জড়তা কাটাচ্ছি।
এতটা নিশ্চিত কীভাবে হচ্ছ যে আমিই চেয়ারম্যান হব ?
বর্ষা সঙ্গে সঙ্গে বলল, তুমি হবে না তো, কে হবে ? তোমার মতন ভালো লোক এই এলাকার মানুষ আরেকটা কোথায় পাবে শোনি ?
বর্ষার দিকে না তাকিয়েই সবুজ বলল, আজ মনে হয় বেশ মোডে আছ।
বর্ষা অন্যদিকে ঘুরে কিঞ্চিৎ অভিমানি সুরে বলল, আমি মোডে থাকলেই কি, আর না থাকলেই কি ? আমার দিকে তাকানোর মত সময় আছে কারো হাতে?
বর্ষার এমন বাঁকা কথা সবুজের নিচু শির উচু করতে বাধ্য করল। পত্রিকার উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বর্ষার দিকে তাকাতেই তার দৃষ্টি থেমে গেল।
সবুজ মনোমুগ্ধকর দৃষ্টিতে বর্ষার দিকে তাকিয়ে আছে। বর্ষা আজ পরেছে আকাশি রঙের তাঁতের শাড়ী। মাথায় সিঁথি করে নি। দুই ভ্রুর মাঝখানে টিপ পরেছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, সদ্য আকাশ থেকে নেমে আসা যেন কোনো নীল পরী আউলা কেঁশে সামনের আসন জোড়ে বসেছে।
বর্ষা অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলেও সে বুঝতে পারছে, অপলক দৃষ্টিতে সবুজ তার দিকে তাকিয়ে আছে। খানিকক্ষণ পর সবুজের দিকে ঝোঁকে এসে মিষ্টি করে বলল, কী দেখছ ?
তীক্ষ্ন দৃষ্টি অব্যাহত রেখেই সবুজ আনমনে জবাব করল, তোমাকে।
বর্ষা প্রতিভ হয়ে বলল, আমাকে ?
সবুজ মুখে কিছু না বলে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।
বর্ষা সোজা হয়ে বসতে বসতে বলল, দ্যাংকস গড। চার বছর পর তুমি আমার দিকে তাকালে।
সবুজ কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল মজনুর গলা খাঁকাড়ি শোনে।
মজনু সামান্য দূরে দাড়িয়ে বলল, ভাইজান আসব ?
সবুজ হ্যা না কিছু একটা বলার আগেই মজনু একদম কাছে চলে আসল। মজনু কাছে আসতেই বর্ষা বলল, কী দাদা মিয়া। ইলেকশনের খবর কি ?
মাথা নুয়িয়ে ঠোঁট ভরে মুচকি হেসে মজনু বলল, ভালো।
তারপর সবুজকে বলল, আমার কিছু টাকা লাগবে ভাইজান।
সবুজ জিজ্ঞাস করল, টাকা দিয়ে কী করবি ?
জবাবে মজনু যখন বলল কাজ আছে। সবুজ আর কোনো প্রশ্ন করল না। সবুজ এমনিতেই পরচর্চা ভালোবাসে না। তার উপরে যার টাকা সে নিতে চাচ্ছে, এখানে এত ঘ্যানর ঘ্যানর করার কী আছে।
বর্ষা ঘর থেকে টাকা এনে সবুজের হাতে দিলো। পুরো বাইশ হবজার টাকা। হাতের টাকা পকেটে রেখে বাজারের পথে মজনু লম্বা লম্বা পা ফেলছে।
নির্বাচনের আর মাত্র তিন দিন বাকী। মজনু ও মতিন এখন আর খালি হাতে কারো কাছে ভোট চায় না। মজনু সিদ্ধান্ত নিয়েছে কয়েক দিনের জন্য কিছু কিছু নীতি বাক্য ভুলে থাকবে। তার এখন একটাই লক্ষ্য,যেভাবেই হোক নির্বাচনে জিততে হবে। তাইতো বিড়ি সিগারেটের পাশাপাশি স্থান বুঝে সে টাকায় ছড়াচ্ছে।
মজনুর হঠাৎ কেন এই পরিবর্তন ঠিক বুঝা গেল না। তবে তার টাকা ছড়ানোর ধরনটা একেবারেই ভিন্ন। টাকা ছড়ানোর কাজটি অন্যান্য প্রার্থীর লোকেরা রাতের আধরে করলেও, মজনু সেই কাজ করছে প্রকাশ্য দিবালোকে। মতিনের হাতে রেজিষ্টার্ড খাতা আর কলম। যাকেই টাকা দিচ্ছে, খাতায় তারই নাম লিখে রাখছে। টাকা দেবার পর মজনু সবাইকে একই কথা বলছে, ভাইজান যদি ফেল করে তাইলে খবর আছে। শুধু খবরই না টাকাও ফেরত দিতে হবে।
টাকা নেবার সময় সবাই ভোট দিবে বলে প্রতিজ্ঞা করছে।
দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিম দিকে। আর কয়েকটা বাড়ি বাকী আছে। এই ক’টা বাড়িতে ভোট চাওয়া হলেই আজকের মত প্রচারণা কাজের সমাপ্তি।
মজনু ও মতিন দাড়িয়ে আছ ফালু মোড়লের বাড়ির পেছনে। ফালু বংশগত ভাবে মোড়ল হলেও, বর্তমানে মোড়লগীরি তো নেই-ই, উল্টো বৃদ্ধ কালে এসেও পরের বাড়িতে একদিন কাজ না করলে পেটে ভাত পড়ে না।
কিছুক্ষণ পর ফালু বেরিয়ে এল। বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে। শরীরের চামড়ায় ভাজ পড়ে যাচ্ছে। মুখের অধিকাংশ দাড়ি পেকে সাদা হয়ে গেছে। দাঁত বোধ হয় ঝরে পড়েছে বেশ ক’টা। তাইতো দুই গালের অনেকটা অংশ মুখের ভিতরে ঢুকে গর্তের মত সৃষ্টি হয়েছে।
ফালু কাছে আসতেই চিনি ঝরা হাসিতে মজনু জিজ্ঞাস করল, কেমন আছেন মুরব্বি ?
জবাবে ফালু বলল, জে ভালো।
মজনু ফের বলল, আমাদেরকে চিনতে পেরেছেন তো ?
ফালু বলল, জে, আপনারা ডাক্তার সাহেবের লোক।
মতিনকে উদ্দেশ্য করে ধমকের সুরে মজনু বলল, হাভার মত দাড়িয়ে আছিস কেন ? চাচাকে সিগারেট দে।
মতিন তড়িঘড়ি করে একটি সিগারেট ফালুর হাতে দিলো। ফালু সিগারেট জ্বালিয়ে টান দেবার পর মজনু ফের বলল, চাচার বাড়িতে ভোটার কয়জন ?
ফালু বলল, আমি, পরিবার, পুলা আর পুলার বউ, চারজন।
মজনু পকেট থেকে চারখানা একশত টাকার নোট বের করে ফালুর হাতে দিয়ে বলল, ভাইজানকে ভোট দিবেন কিন্তু।
ফালু ঘাড় কাঁৎ করে সম্মতি জানাল। মতিন খাতা খুলে ফালুর নাম লিখে তার বাবার নাম জিজ্ঞাস করার পর ফালু বলল, নাম লেখেন ক্যান ?
মজনু বলল, টাকা নিয়ে যদি ভোট না দেন, সেইজন্য।
ফালু সঙ্গে সঙ্গে বলল, ভোট দিমু না ক্যান ?
মজনু অন্যদিকে মুখ করে বলল, বলা তো যায় না, বৈইমানে দেশ ভরে গেছে !
ফালু আর কোনো কথা বলল না। ফালুকে ভোটের ব্যাপারে বলে কয়ে মজনু ও মতিন সেখান থেকে রওনা হল।
মজনু ও মতিন চোখের আড়াল হবার পর বাড়ির দিকে পা বাড়িয়ে ফালু একাকী বলছে, লোকটা পাগল নাকি ?