দুঃসাহসী শাহীন (পর্ব-১৭)
॥ শাহীনের অপরাধ বোধ ॥
বন্দী জীবনের হাজারো দুর্ভাবনার মাঝেও শাহীনের দৃঢ় বিশ্বাস, সে একদিন মুক্ত হবেই। সেতো কোনো অপরাধ করেনি। তাহলে এ বয়সে কেনো সে অপমৃত্যুর শিকার হবে ; অথবা আজীবন বন্দী জীবন-যাপন করবে? আবার তার মনে উদয় হয়, অপরাধ তো সে করেছেই। সেদিন নামাযের জন্য যথাসময়ে তাকে জাগিয়ে দেয়ার পরও সে বিছানা ছেড়ে ওঠেনি। এরপর তার বাবা সামান্য ভর্ৎসনা করায় সে মসজিদে না গিয়ে অন্যত্র চলে আসার কারণেইতো এ ঘটনার সূচনা। আবার ভাবে, এক ওয়াক্ত নামায না পড়লেই বা কী তেমন মহা-অপরাধ হয়ে যায়? তাঁর বাবা বলেন, “নামায প্রত্যেক মুসলমানের অপরিহার্য কর্তব্য ; যা ইচ্ছা করলেই কেউ পরিহার করতে পারেন না।” কিন্তু কোথায় Ñ আমাাদের সমাজে ক’জন মুসলমান নামায পড়েন? নামায যদি পরিহার করার মতো না হয়, নামায যদি অপরিহার্য হয় ; তাহলে তাঁরা কি করে প্রকাশ্যে তা পরিহার করছেন? অথবা নামায পরিহার করার কারণে তাঁদেরকেতো কোনো অপরাধীও বলা হচ্ছে না। বা একারণে তারা কোনো অধিকার থেকেওতো বঞ্চিত হচ্ছেন না। এমনকি সমাজের বা দেশের কর্তৃত্ব যাঁরা করেন, তাঁরাওতো সবাই নামায পড়েন না। এইতো গত বছর প্রধানমন্ত্রীসহ কয়েকজন মন্ত্রী মহোদয় এলেন নরসিংদী স্টেডিয়াম মাঠে জনসভা করতে। জনসভার মাঝখানে দুই ওয়াক্ত নামায চলে গেলো। সামান্য কিছু সাধারণ লোক, অন্যত্র মসজিদে গিয়ে নামায আদায় করলেন। এছাড়া অন্যান্য বেশিরভাগ মানুষইতো সেদিন নামায পড়েন নি। তাহলে নামায কি শুধু সাধারণ লোকদের জন্যেই? যদি তাই হয়, তাহলে তার বাবা কেনো বলেন, “নামায কোনো মুসলমানই পরিহার করতে পারেন না?” তাহলে তার বাবা কি ভুল বা অতিরঞ্জিত বলছেন না?
আবার তার মনই স্যা দেয়, তার বাবা তো আজকের সমাজের তুলনায় একজন ন্যায়নিষ্ঠ ব্যতিক্রম মানুষ। আমাদের সমাজে আজকে যেখানে, শিতি-অশিতি নির্বিশেষে অধিকাংশ মানুষই নীতি-আদর্শ ভুলে গিয়ে, চোখ-কান বন্ধ করে পয়সার পেছনে দৌঁড়াচ্ছেন। অধিক উপার্জনের নেশায় জড়িয়ে যাচ্ছেন, বিভিন্ন ধান্ধাবাজিতে। সুযোগ পেলেই, অন্যায়ভাবে গ্রাস করছেন অন্যের ধন-সম্পদ। সেখানে তিনি, সহজ পথে অধিক উপার্জনের অনেক সুযোগ পাবার পরও বেছে নিয়েছেন, শিকতার মতো মানুষ গড়ার মহৎ পেশাকে। এ পেশার সীমিত আয় দিয়েই তিনি ধৈর্য এবং নিষ্ঠার সাথে লেখাপড়া করাচ্ছেন সন্তানদেদেরকে। তিনি নিজে যেমনি সৎ এবং কর্তব্যপরায়ণ ; তেমনি অন্যান্যদেরকেও সততা এবং কর্তব্যপরায়ণতার শিা দেয়ায় চেষ্টা করেন। অন্যের সম্পদে হাত দেয়া বা কারো কোনো তি করাতো দূরে ; সামান্য অকল্যাণ চিন্তাও করেন না তিনি কখনো। এমন একজন মানুষ কী কারণে নামায নিয়ে মিথ্যা, ভুল বা অতিরঞ্জিত কিছু বলতে যাবেন?
এসব স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শাহীনের মনে হয়, তার বাবার এবং একাডেমীর শিকগণের মুখে শোনা অনেক কথা। তাঁরা বলতেন, “আল্লাহর সৃষ্টি সুন্দর এ পৃথিবীতে বসবাস করে এবং তাঁর অফুরন্ত করুণা ভোগ করেও আল্লাহর প্রতি যারা কর্তব্যপরায়ণ না হন ; তারা মানুষ বা অন্যান্য সৃষ্টির প্রতিও কর্তব্যপরায়ণ হতে পারেন না। খোলাফায়ে রাশেদার খলীফাগণ আল্লাহর প্রতি কর্তব্যপরায়ণ ছিলেন বলেই মানুষের প্রতিও কর্তব্যপরায়ণ ছিলেন। এজন্য তাঁরা দিনভর রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যস্ত থাকার পরও রাতের আঁধারে বাড়ি-বাড়ি ঘুরে জনগণের খোঁজ-খবর নিতেন। নিজের মাথায় বয়ে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিতেন অনাহারী মানুষের ঘরে।” দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর ফারুক (রা.) নাকি বলতেন, “সুদূর ইরাকের ফোরাত নদীর তীর দিয়ে একটি কুকুরও যদি হাঁটতে গিয়ে, রাস্তা অসমান থাকার কারণে হোঁচট খেয়ে ‘ উহ্’ বলে ; তাহলে আমি ওমরকেই একদিন আল্লাহর আদালতে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জবাবদিহী করতে হবে, কেনো রাস্তাটি অসমান ছিল।” এসব কথার পাশাপাশি তার মনের পর্দায় ভেসে উঠে আজকের তার নিজের সমাজের কর্ণধারদের কর্তব্যপরায়ণতার চালচিত্র। তার সত্যসন্ধানী কিশোর মনে প্রশ্ন জাগে, আজকের কর্ণধারগণ আল্লাহর প্রতি কর্তব্যপরায়ণ নন বলেই কি, জনগণের প্রতিও কর্তব্যপরায়ণ নন? তাঁদের অনেকেইতো মতায় যাবার জন্যে, ভোটের প্রয়োজন ছাড়া কখনো জনগণের দোরগোড়ায় যাবার গরজই অনুভব করেন না। আর এজন্যেই কি আজকে আমাদের সমাজে মানুষরূপী নরপশুদের এতো দৌরাত্ম? তাই যদি সত্য হয়, তাহলেতো এ বন্দীশালা থেকে তাদের মুক্তি একমাত্র আল্লাহর করুণার ওপরই নির্ভর করে। সমাজের কর্ণধারগণ কোনো দিন হয়তো খবরও নিবেন না, এ বাড়িতে কেউ বন্দী অবস্থায় পচে মরছে। হ্যাঁ, আল্লাহর করুণার ওপর ভরসা করেই ওকে খুঁজে নিতে হবে মুক্তির কৌশল।
চলবে . . .