ধারাবাহিক উপন্যাস “নরক” পর্ব-১৯
হসমতের বাড়ির পেছনে দাড়িয়ে মতিন হাসমতকে ডাকছে। কিছুক্ষণ পর হাসমত বেরিয়ে এল। হাসমত কাছে আসা মাত্রই মতিন তার হাতে একটি সিগারেট দিয়েছে। সেই সিগারেট জ্বালিয়ে হাসমত লম্বা লম্বা টান দিচ্ছে। ভাব দেখে মনে হচ্ছে কয়েক টানেই সিগারেট শেষ করে ফেলবে। মজনু একবার হাসমতের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কঁচকে অন্যদিকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। হাসমত কয়েক টান দিয়ে সিগারেট শেষ করে মতিনের কাছে ফের সিগারেট চাইল। মতিন অসহায়ের মতন আরেকটি সিগারেট বের করে দিলো।
সেই সিগারেটে কয়েক টান দেবার পর মজনু হাসমতের দিকে তাকিয়ে চড়া স্বরে বলল, এই তোর বাড়িতে লোক কয়জন ?
হাসমত তুরী বাজিয়ে সিগারেটের ছাই ফেলে বলল, দেখেন ভাইসাহেব, তুই তোকারি করবেন না। ভোট চাইতে এসেছেন, ভদ্রভাবে কথা বলেন। মানুষ গরীব হলেও সমাজে আমার ইজ্জত আছে।
মজনু অন্যদিকে ঘুরে বিড়বিড় করে বলল, চোরের আবার ইজ্জত !
সিগারেটে টান দিয়ে নাক মুখ দিয়ে ধোয়া বের করতে করতে হাসমত বলল, চুরি বিদ্যা মেলা দিন আগেই ছেড়ে দিয়েছি। এখন আর কেউ আমাকে চোর বলতে পারবে না।
মজনু ফের বলল, বাড়িতে লোক কয়জন সেটা বল।
দুইজন, আমি আর আমার পরিবার সকিনা বেগম। গম্ভীর স্বরে বলল হাসমত ।
মজনু পকেট থেকে দুটো একশত টাকার নোট বের করে হাসমতের হাতে দিয়ে বলল, এই নে দুইশ টাকা। ভোট কিন্তু ভাইজানকে দিবি।
হাসমত হারমার করে টাকা পকেটে রেখে বলল, অবশ্যই দেবো। ডাক্তার সাহেবকে ভোট দেবো না তো গমচোর হামিদ খাঁকে ভোট দেবো ?
মতিন খাতা খুলে নাম লিখতে শুরু করেছে। হাসমতের নাম লেখার পর তার বাবার নাম জিজ্ঞাস করার সঙ্গে সঙ্গে হাসমত মুচকি হেসে তার বাবার নাম বলল। মতিন খাতায় হাসমতের বাবার নাম লিখছে।
হঠাৎ কি যেন ভেবে হাসমত মজনুকে জিজ্ঞাস করল, ভাইসাহেব, নাম লেখেন ক্যান ?
মজনু রুক্ষ স্বরে বলল, ভাইজান ফেল করলে টাকা ফেরত নিতে হবে না, সেজন্য ।
এই কথা শোনার পর হাসমত কেমন যেন তব্দা লেগে গেল। মজনু ও মতিন অন্য বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়েছে। কিছুদূর এগুনোর পর হাসমত পেছন ডেকে মজনু ও মতিনকে থামিয়ে দ্রুত পায়ে কাছে গিয়ে বলল, ভাইসাহেব, আরেকশ টাকা দেয়া যায় না ?
মজনু বলল, না। বাড়িতে ভোটার দুইজন, টাকা দুইশ। প্রত্যেক ভোটার প্রতি একশ টাকা বাজেট।
হাসমত নরম সুরে বলল, বাজেট কিছু বাড়ানো যায় না ?
মজনু গলা টান করে বলল, না।
খানিক চুপ থেকে হাসমত ফের বলল, ভাইসাহেব, আমার একটা শালি আছে। আমার পরিবার সকিনা বেগমের সহোদর বোন রোজিনা বেগম। তাকে দিয়ে যদি একটি ভোট দেই, তাহলে আরেকশ টাকা দিবেন না ?
মজনু সঙ্গে সঙ্গে বলল, না।
না ক্যান ? একটু আগেই তো বললেন, ভোটার প্রতি একশ টাকা।
মজনু কিঞ্চিৎ চটে গিয়ে বলল, তোর শালি কি এই এলাকার ভোটার, সে কীভাবে ভোট দিবে ?
হাসমত বলল, এইটা কোনো সমস্যাই না। বোরকা পরে ভোট দিবে। মেয়ে লোক বোরকা পরার পর সামনে থাকলেও জগতের আড়ালে।
মজনু আর কোনো কথা বলল না। বড় বড় চোখ করে একবার শুধু হাসমতের দিকে তাকিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে ঐ স্থান ত্যাগ করল। মতিনও মজনুর পেছনে পেছনে ছুটছে। হাসমত দাড়িয়ে ওদের চলে যাওয়া দেখছে আর বলছে, যা বেটা পাগল। বলে কিনা ফেল করলে টাকা ফেরত নিবে। আরে বেটা টাকাপয়সা যখন যার পকেটে, তখন তার। সেখান থেকে বের করা এত সহজ না।
হামিদ খাঁর বাড়ি। দিন পেরিয়ে প্রকৃতির ঘাড়ে রাত্রি বেধেছে বাসা । কাচারি ঘরে বসে চোখ বুজে হামিদ খাঁ হুক্কা টানছে আর কী যেন ভাবছেন। তার পাশেই দাড়িয়ে আছে কুদ্দুস। অনেকক্ষণ ধরে কুদ্দুস কিছু একটা বলতে চাচ্ছে কিন্তু হামিদ খাঁ চোখ বন্ধ করে ঝিম ধরা অবস্থায় বসে থাকায় শুরু করতে পারছে না। কয়েকবার হামিদ খাঁর দিকে ঝোঁকে গিয়ে ফেরত এসেছে।
বেশ কিছুক্ষণ পর হামিদ খাঁ চোখ খুলে হুক্কার পাইপ হাতে নিতে নিতে বললেন, কুদ্দুস ।
কুদ্দুস একেবারে ঝোঁকে এসে বলল, জ্বী হুজুর।
নির্বাচনের খবর কি ?
কুদ্দুস মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে হাসি মাখা ঠোঁটে বলল, জ্বী ভালো।
খানিক চুপ থেকে কাধের গামছা দিয়ে হুক্কায় বাতাস, দিতে দিতে কুদ্দুস ফের বলল, তবে সামান্য সমস্যা হয়েছে হুজুর। ডাক্তারের ভাই মজনু বাড়ি বাড়ি গিয়ে লোকজনকে টাকা দিয়ে বেড়াচ্ছে।
কুদ্দুসের দিকে না তাকিয়েই হামিদ খাঁ বললেন, কত করে দিচ্ছে ?
মুচকি হাসির ভান করে কুদ্দুস বলল, ভোটার প্রতি একশ টাকা।
তোমরা দেড়শ করে দাও। সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন হামিদ খাঁ ।
কুদ্দুস কিঞ্চিৎ বিস্ময়ের সুরে বলল, তাহলে তো অনেক টাকার প্রয়োজন !
হুক্কার পাইপ নামিয়ে রাখতে রাখতে হামিদ খাঁ বললেন, হ্যা অনেক টাকা তো বটেই।
কুদ্দুস বলল, বেহুদা এতগুলো টাকা খরচ করার কোনো দরকার আছে হুজুর ?
কুদ্দুসের দিকে ঘুরে হামিদ খাঁ শান্ত গলায় বললেন, নির্বাচনে বেহুদা খরচ বলে কিছু নেই। নির্বাচনের সময় তুমি যা খরচ করবে সবি হল বিনিয়োগ। নির্বাচনের আগে খরচ করবে এক হাতে, আর নির্বাচিত হয়ে উপার্জন করবে দুই হাতে হা হা হা ।
হামিদ খাঁর কানের কাছে গিয়ে কুদ্দুস ফিসফিস করে বলল, ডাক্তার সাহেব ভালো মানুষ, টাকা দিলেই যে পাবলিক আপনাকে ভোট দিবে তার কী গ্যারান্টি ?
হামিদ খাঁ হাসি থামিয়ে বলল, পাকিস্তানিরা কী বলত জানো ?
কুদ্দুস মাথা ঝাঁকিয়ে না করার পর হামিদ খাঁ ফের বললেন, পাকিস্তানিরা বলত, এ গাদ্দারো কা মুল্লুক হ্যে।
কুদ্দুস সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাস করল, মানে কী হুজুর ?
মানে হল, এদেশের সবাই বেইমান। প্রতি পাঁচ জনের তিন জনই বেইমান।
কুদ্দুস মুখ কালো করে বলল, তারা কি ঠিক বলত হুজুর ?
হামিদ খাঁ উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বললেন, অবশ্যই ঠিক। তারা পরহেজগার বান্দা, পরহেজগাররা কখনোই মিথ্যা বলে না।
কুদ্দুস সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, তারা যদি এতই পরহেজগার, তাহলে সংগ্রামের সময় হাজার হাজার নারীর সম্ভ্রম কে লুটে ছিল হুজুর ?
এই কথা শোনার সাথে সাথে হামিদ খাঁর পূর্ণিমা গড়ন মুখমন্ডলে অমাবস্যার আধার নেমে এল। উচ্ছ্বাসিত চক্ষু রক্ত বর্ণ ধারণ করল। কুদ্দুসের দিকে একবার তাকাতেই কুদ্দুস ঘন ঘন ঢোক গিলতে শুরু করেছে।
তারপর উত্তেজিত স্বরে হামিদ খাঁ বললেন, বাজে বকবে না মিয়া, বাজে কথা আমার একদম পছন্দ না।
কুদ্দুস ভয়ে জবুথবু হয়ে দাড়িয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে হামিদ খাঁ প্রচন্ড রেগে গিয়েছে। খানিকক্ষণ চুপচাপ দাড়িয়ে থাকার পর মনিবের রাগ ভাঙ্গানোর জন্য দুই কদম এগিয়ে এসে ভোতা মুখে হাসির ভান করে বলল, এক কাজ করলে কেমন হয় হুজুর ?
হামিদ খাঁ কিছু একটা বলার আগেই কুদ্দুস ফের বলল, ওসমানকে দিয়ে সবুজকে সরিয়ে দিলে কেমন হয় ? প্রতিযোগিও রইল না, নির্বাচনে টাকাও খরচ হল না।
এ পর্যন্ত বলেই কুদ্দুস হে হে হে করে হাসছে। সেই হাসি থামল হামিদ খাঁর ধমক শোনে।
হামিদ খাঁ ধমকের সুরে বলল, মূর্খের মত কথা বলো না। এলাকায় নির্বাচন চলছে, আর ডাক্তার আমার প্রতিযোগি। এই মূহুর্তে ডাক্তারের কিছু হলে পাবলিক ও প্রশাসন কারো হাত থেকেই রেহাই পাব না।
তারপর হুক্কার পাইপ হাতে নিয়ে পর পর কয়েক টান দেবার পর ফের বললেন, নির্বাচনে জিতে নিই, পরে দেখা যাবে। এই দেশে ভালো কিংবা মন্দ, বড় কোনো কাজই ক্ষমতার বাহিরে থেকে করা ঠিক না।
কুদ্দুস সঙ্গে সঙ্গে বলল, খাঁটি কথা হুজুর, জব্বর খাঁটি কথা।