ধারাবাহিক উপন্যাস ”নরক” পর্ব ২০
রাত আনুমানিক দশটা। ঘন্টা খানেক আগে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষনা হয়েছে। সবুজ পেয়েছে এগারশত চল্লিশ ভোট। আর ছয় হাজার সাতশত কুড়ি ভোট পেয়ে হামিদ খাঁ নির্বাচিত হয়েছেন। অল্প কিছুক্ষণ আগে সবুজদের বাড়ির পেছন দিয়ে হামিদ খাঁর বিজয় মিছিল চলে গেল সড়ক বেয়ে ।
তালুকদার বাড়ির বসার ঘরে পাশাপাশি চেয়ারে সবুজ ও আসাদ বসে আছে। সবুজকে শান্ত দেখালেও আসাদকে বেশ বিচলিত মনে হচ্ছে। একই ঘরের দেওয়াল ঘেষে বিরস মুখে দাড়িয়ে আছে মজনু। পাশের রুমে আছে বর্ষা। সবাই চুপচাপ, কেউ কিছু বলছে না।
বাহিরে বাঁশ বাগান থেকে নীড়হারা পাখিদের কিঁচিরমিচির কান্নার শব্দ ভেসে আসছে বাধাহীন। এরই এক ফাঁকে আসাদকে উদ্দেশ্য করে সবুজ বলল, চা খাবি ?
আসাদ মুখে কিছু না বলে মাথা নাড়িয়ে না করার পর মজনু চেঁচিয়ে বলল, টাকা ছাড়া আর একটা লোককেও চিকিৎসা করবেন না ভাইজান।
সবুজ সামান্য উচু স্বরে বলল, যা বুঝিস না, তা নিয়ে কথা বলিস না তো।
মজনু আর কিছু বলল না।
এতক্ষণে বর্ষা এসে দরজায় দাড়িয়েছে। খানিক পর ঠান্ডা মেজাজে আসাদ বলল, যুদ্ধের সময় আমার বয়স ছয় বছর। তোরও বোধ হয় তাই হবে, মা বলেন আমি আর তুই নাকি এক দেড় মাসের ছোট বড়। তাই যুদ্ধের কথা আমরা কেউ ঠিকমত বলতে পারব না। মায়ের কাছে শোনেছি, তোর বাবা, উত্তর পাড়ার মুনিম চাচা, ফজু মেম্বার, তারা যে রাতে ট্রেনিং নেওয়ার জন্য ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে ছিলেন। তার আগের রাতে নাকি আমাদের বাড়িতে গোপন মিটিং হয়েছিল। এই এলাকা থেকে যারা যারা মুক্তি যদ্ধে যাবে সেই মিটিং-এ তাদেরকে দুই ভাগে ভাগ করা হল। একদল তোর বাবার নেতৃত্বে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। ঐ দল আগরতলা গিয়ে পৌছার পর এখান থেকে দ্বিতীয় দল যাবে। দ্বিতীয় দলটি যাবার কথা ছিল বাবার নেতৃত্বে। বাবা আর যেতে পারলেন না। যে রাতে এখান থেকে রওনা হবার কথা ছিল, সেইদিন বিকালে পাকিস্তানি আর্মিদেরকে সাথে নিয়ে হামিদ খাঁ বাবাকে ধরে নিয়ে গেল। তার পরের দিন তাকে বটতলায় জবাই করা হল !
এই পর্যন্ত বলে আসাদ থেমে গেল। তার চোখ ভিজে গেছে, কন্ঠ চিড়ে কান্না বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে।
আসাদ কোনো রকমে নিজেকে সামলে ফের বলল, আজ যদি তোর বাবা বেঁচে থাকতেন তাহলে তাকে জিজ্ঞাস করতাম, তারা কাদের জন্য যুদ্ধ করে এই দেশ স্বাধীন করে ছিলেন ? এদের জন্য, যারা তোর মতন একজন ভালো লোককে ভোট না দিয়ে হামিদ খাঁর মত কুখ্যাত রাজাকার, বর্বর খুনি আর অত্যাচারী পিসাসদেরকে ভোট দিয়ে নিজেদের প্রতিনিধি বানায়। তাদের জন্য, যারা জেনে শোনে হামিদ খাঁদের মত লুটেরাদের হাতে সমাজ তথা দেশের নেতৃত্ব তুলে দেয়?
এই পর্যন্ত বলার পর আসাদ আর চোখের জল আটকাতে পারল না। তার প্রতিবাদী সুর কান্নায় পরিনিত হল। আসাদ মাথা নিচু করে চোখ মুছছে। আসাদের কান্না দেখে বর্ষার চোখেও জল এসে গেল। সে মাথা নিচু করে দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
মজনু অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছে। তার চোখে মুখে আক্রুশের লাভা। পৌসের কনকনে শীতের রাতেও তার কপোল থেকে ঘাম ঝরছে।
চেয়ারে আড়ষ্ট হয়ে বসে সবুজ বলল, সাধারণ মানুষকে দোষারোপ করে কী লাভ ? যারা জীবিত মুক্তিযুদ্ধা, রাষ্ট্র অথবা আমরা যারা সচেতন নাগরিক, তারাই কি পেরেছি সাধারণ মানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে ? দেশের বয়স প্রায় চব্বিশ বছর। এই চব্বিশ বছরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে চার চারবার পরিবর্তন করে লেখা হয়েছে। একাত্তর থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত ইতিহাস একরকম। প্লট পরিবর্তনের পর সবকিছু বদলে গেল। এমন কি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও। জিয়ার মৃত্ত্যুর পর ফের নতুন করে লেখার চেষ্টা। এরশাদের পতনের পর দেশে অনেক দিন পর গণতান্ত্রিক সরকার এল। দেশের মানুষ নতুন আশায় বুক বাঁধল। কিন্তু এই সরকারও তো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বুকে ছুরি চালাতে দ্বিধাবোধ করে নি। মোট কথা সবাই চেয়েছে ইতিহাসকে নিজেদের মত করে লেখতে। নিজেদের পক্ষে নেবার টানাহেচড়ায় পড়ে ইতিহাস আজ ক্ষত বিক্ষত। তাহলে বল কে কম দোষি, জনগণ, সরকার, না আমরা সচেতন নাগরিকরা ? যে জাতি স্বাধীনতার জন্য অকাতরে লাখ লাখ তাজা প্রাণ বিলিয়ে দিতে পারে। যুদ্ধ করে রক্ত গঙ্গা বইয়ে দিয়ে স্বাধীনতার নতুন সূর্য ছিনিয়ে আনতে পারে। সেই জাতি তার জন্মের ইতিহাস, স্বাধীনতার ইতিহাস, তথা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বেলায় ঐক্যমত পোষণ করতে পারে না ! কেন ? শুধু মাত্র স্বার্থের জন্য। ছিঃ- ভাবতেও ঘৃণা লাগে ।
এই পর্যন্ত বলার পর ঘরে সামান্য নিরবতা নেমে এল। আসাদ খামোশ। মজনু বিমর্ষ অবস্থায় দাড়িয়ে আছে।
কিছুক্ষণ পর নিরবতা ভেঙ্গে সবুজ ফের বলল, দেশ স্বাধীন হবার এতদিন পরও আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার বেহাল দশা কেন ? এখনো দেশের অনেক লোক অনাহার অর্ধাহারে দিনাতিপাত করে। মানুষের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে তার পেট। পেটের ক্ষুধা নিবারণ করার জন্য মানুষ বাধ্য হয়ে রক্ত বিক্রি করে, কিডনি বিক্রি করে। এরা তো সামান্য ভোট বিক্রি করেছে। রাজনীতি কাকে বলে ক্ষুধার্ত জনগোষ্ঠি তা জানে না। কাকে ভোট দিলে পাহাড় গড়বে, আর কে নদী খনন করবে ? এসব হিসেবের ধার তারা ধারে না। তারা শুধু জানে একবার নির্বাচনে জিততে পারলে আগামী পাঁচ বছর সেই নেতা বা সেই প্রতিনিধির আর দেখা পাওয়া যাবে না। পাঁচ বছর পর যখন একবার হাতের নাগালে পাওয়া পায় তখন সুযোগ নষ্ট করে লাভ কি ? যা পায় তাই হাতিয়ে নেয় ..
সবুজকে শেষ করতে না দিয়ে আসাদ বলল, দারিদ্রতা গুছানোর দায়িত্ব নিশ্চয় সরকারের ?
সবুজ কিঞ্চিৎ বিস্ময়ের সুরে বলল, সরকার ! সরকারই বা কয়দিন টিকল ? একাত্তর থেকে পঁচাত্তর, যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশের সবকিছু গুছিয়ে উঠার জন্য নিশ্চয় যথেষ্ট সময় নয়। তাও আবার সেই সরকারে ঢুকে গেল সাত্তারদের মত কালপিটরা। ক্ষমতা দখল করার জন্য রাষ্ট্র প্রধান তথা বঙ্গপিতার প্রতি জনমনে বিরুপ ধারনা সৃষ্টি করতে শুরু হল প্রতি পদে পদে চক্রান্ত । দুর্নীতি, লুন্ঠন, যত ধরনের অপকৃত্তি করা যায়। অবশেষে অপশক্তিই জিতে গেল। তারপর, তারপর পনের বছর চলেছে শুধু ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতা।
সবুজের কথা আসাদ উন্মোখ হয়ে শোনলেও মনকে কিছুতেই বুঝাতে পারছে না।
বর্ষা চা নিয়ে ঢুকল। আবেগ তাড়িত বাক বিতর্কে খানিক শীতলতা নিয়ে এল গরম চা । চা খাওয়ার পর সবুজ বলল, মনটা কেন যেন আনচান করছে ? ভাবছি কয়েকদিনের জন্য বুবুদের ওখান থেকে বেড়িয়ে আসব।
আসাদ সঙ্গে সঙ্গে বলল, বেশ তো, বর্ষাকেও সাথে করে নিয়ে যা, দেখবি ভালো লাগবে।
লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে সবুজ বলল, ভাবছি একাই যাব। কিছু সময় একা থাকতে চাই।
আসাদ আর কোনো কথা বাড়াল না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে পড়ল।
ইতোমধ্যেই মজনু তার রুমে গিয়ে শুয়ে পড়েছে । তার রাগ কিছুতেই কমছে না। ভেতরে ভেতরে ক্রোধে ফুঁলে যাচ্ছে সরীসৃপ গোকরের ন্যায় । বিছানায় শুয়ে রাগে ছটফট করছে আর ভাবছে, যে এলাকার মানুষের জন্য তার খালু আফাজ তালুকদার এত কিছু করে গেছেন। খালা’ত সবুজ এখনো করছে। সেই এলাকার লোকজন তাদের সাথে কিভাবে বেইমানি করল ! ভাইজানকে ভোট না দিয়ে শয়তান হামিদ খাঁকে নির্বাচনে জিতিয়ে দিলো ! ইচ্ছা করছে মির্জাফরের দলের একেকটাকে কেটে টোকরা টোকরা করে গাঙ্গের জলে ভাসিয়ে দেই। কিন্তু সেটা সম্ভব না। তবু একটা কিছু করতে হবে। এই বিশ্বাসঘাতকদেরকে উচিৎ শিক্ষা দিতে হবে। ভাইজান ভালো মানুষ। সে ক্ষমা করলেও আমি ক্ষমা করব না। আমি খারাপ, এক্কেবারে যম খারাপ। ক্ষমা করে আমি মহৎ হতে চাই না। সাজা দিয়ে কুৎসিত হতেও আমার কোনো আপত্তি নেই।