ধারাবাহিক উপন্যাস “নরক”
আজ রবিবার। এই এলাকার হাটবার। পৌসের অবেলায় বৃষ্টি হয়েছে । বৃষ্টির পানি পেয়ে কাঁচা রাস্তা গলে কাঁদায় ভরে গেছে। সেই কাঁদামাখা রাস্তা ধরে বাজার শেষে দুই একজন করে বাড়ি ফিরছে।
রাস্তার পাশে চেয়ার টেবিল ফেলে বসে আছে মজনু। টেবিলের উপরে মতিনের ধারাল রাম দা। মতিন ও আরেকটি ছেলে টেবিলের দুই পাশে সিপাহীর মতন দাড়িয়ে আছে।
রাস্তার দিকে তাকিয়ে মতিন বলল, দেখছেন ভাইজান, রাস্তায় কেমন কাঁদা ?
মজনু উত্তেজিত স্বরে বলল, এই এলাকার মানুষ ভোট বিক্রি করে। এখানকার রাস্তায় কাঁদা থাকবে না, সোনা দিয়ে বাঁধানো থাকবে ?
ইতোমধ্যেই বাজার করে একজন রাস্তা দিয়ে ফিরছিল। মজনু সেই লোককে কাছে ডেকে আনার পর মতিন খাতা দেখে জানাল খাতায় এই লোকের নাম লেখা নেই।
মজনু সঙ্গে সঙ্গে বলল, ভালো করে দেখেছিস ?
মতিন বলল, জ্বী ভাইজান।
মজনু লোকটিকে চলে যাবার পর লোকটি আগমাথা কিছু বুঝতে না পেয়ে উদাস পায়ে সড়ক ধরে আবার হাটতে শুরু করেছে।
কিছুক্ষণ পর ফালু মোড়ল বাজার করে সড়ক দিয়ে যাচ্ছিল। মজনু ফালুকে কাছে ডেকে আনার সাথে সাথে মতিন খাতা দেখে জানাল নির্বাচনের সময় সে চারশত টাকা নিয়েছিল।
মজনু ফালুর দিকে তাকিয়ে বড় বড় চোখ করে বলল, টাকা ফেরত দেন মুরব্বি।
ফালু কিছু বুঝতে না পেয়ে বলল, কিসের টাকা ?
ভোটের আগে যে টাকা নিয়েছিলেন, সেই টাকা। খড়খড়ে গলায় বলল মজনু।
টাকা ফেরত দিমু ক্যান, ভোট দিছি না ?
মজনু সঙ্গে সঙ্গে বলল, ভোট দিলে ভাইজান ফেল করল কেন ?
আমি কিভাবে বলব, ক্যান ফেল করছে ?
মজনু অত্যান্ত রুক্ষতার সহিত বলল, দেখেন মুরব্বি, ভংচং করবেন না। মেজাজ অত্যাধিক খারাপ কিন্তু ।
ফালু আর কিছু বলল না। অসহায়ের মত একবার তাকাল দা-র দিকে, আবার তাকাল মজনুর দিকে।
তারপর নরম সুরে বলল, টাকা তো খরচ করে ফেলেছি বাবাজি।
মজনু বলল, কোনো অসুবিধা নেই। যারা টাকা দিতে পারবে না তাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা আছে।
ফালু ঢোক গিলতে গিলতে বলল, কী ব্যবস্থা বাবাজি ?
মজনু অন্যদিকে মুখ করে বলল, যারা টাকা ফেরত দিতে পারবে না, তারা প্রতি একশ টাকার জন্য দশবার কান ধরে ওঠবস করবে আর বলবে, জীবনে আর কখনো ভোট বিক্রি করব না, যদি করি গু খাই। ওঠবস শেষে পাছায় লাথি মেরে বিদায় করা হবে।
তারপর ফালুর দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি মুরব্বি মানুষ, পাছায় লাথি মাফ। যান কান ধরে ওঠবস করুন ।আর বলুন, জীবনে আর কখনো ভোট বিক্রি করব না, যদি করি গু খাই। যান শুরু করুন।
ফালু কান ধরে ওঠবস করছে আর বলছে, জীবনে আর কখনো ভোট বিক্রি করব না, যদি করি গু খাই।
পয়ত্রিশ বার করেছে এমন সময় হাসমত এসে পৌছল। হাসমত কাছে এসে ফালুকে জিজ্ঞাস করল, চাচা কী করছেন ?
ফালু কান ধরে দাড়িয়ে বলল, প্রায়চিত্ত করছি বাবা।
হাসমত ফের জিজ্ঞাস করল, কিসের প্রায়চিত্ত ?
ফালুর এবার কোনো জবাব করল না। সে আবার কান ধরে ওঠবস করতে শুরু করেছে। ছত্রিশ, সাইত্রিশ..
মতিন খাতা দেখে জানাল নির্বাচনের সময় হাসমত দুইশত টাকা নিয়েছিল। হাসমতকে উদ্দেশ্য করে মজনু বলল, এই টাকা দে।
হাসমত বলল, কিসের টাকা ?
মজনু অত্যান্ত চড়া স্বরে বলল, নির্বাচনের সময় যে টাকা নিয়েছিলি, সেই টাকা।
হাসমতও স্বরে স্বর মিলিয়ে উচু গলায় বলল, যদি নাই দেই, কী করবেন ?
মজনু দা হাতে নিয়ে বলল, এক কোপ দিয়ে ধর থেকে কল্লা আলাদা করে ফেলব।
হাসমতও অসহায়ের মত কান ধরে ওঠবস করছে আর বলছে, জীবনে আর কখনো ভোট বিক্রি করব না, যদি করি গু খাই।
ওঠবস শেষে ফালু যেতে যেতে বলল, এইবার বুঝছ বাবা, কিসের প্রায়চিত্ত ?
কান ধরে ওঠবস করা শেষে হাসমতকে পাছায় লাথি মেরে বিদায় করা হল। দশ পনের মিনিট পর একজন হাবিলদার আর দুইজন কনস্টেবল ভ্যানগাড়ী করে সড়ক দিয়ে যাচ্ছিল। মজনুর হাতে দা দেখে হাবিলদার এগিয়ে এসে জিজ্ঞাস করল, এই দা দিয়ে কী করিস ?
পুলিশকে কাছে আসতে দেখে মতিন ও অন্যলোকটি দৌড়ে লাপাত্তা হল। মজনু দা হাতে নিয়ে নিরবে দাড়িয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে না হাবিলদারের প্রশ্নের কী উত্তর দিবে ? দা দিয়ে সে যা করছিল তা বলা সমুচিন হবে না। কিন্তু কী বলবে ? কারণ সে মিথ্যা বলতে পারে না।
পুলিশের প্রশ্নের কোনো সদোত্তর না দিতে পারায় পুলিশ মজনুকে বেঁধে নিয়ে গেল।
হাসমত সড়ক দিয়ে হাটতে হাটতে মজনুক গালাগালি করছে আর বলছে, ভোটের ভোট দিলাম আবার কান ধরে ওঠবস করলাম। কান ধরে ওঠবস করার পরও রক্ষা নাই। তেন্দরটা কি জোরেই না পাছায় লাথি মেরেছে। অপমান রাখার জায়গা নাই। ডাক্তার সাহেব কত ভালো মানুষ আর তার ভাইটা কেমন তেন্দর ? তাও আবার আসল ভাই না, চৌদ্দটা জোড়া তালি দিয়ে ভাই। দাড়াও চান্দু, সুযোগ পাইয়া লই, তোমার পাছায় যদি দশটা লাথি না মারি আমার নাম হাসমত না ।
কিছুক্ষণ পর হাসমত যখন দেখল পুলিশ মজনুকে ধরে নিয়ে তার সামনে দিয়ে যাচ্ছে। দৌড়ে ভ্যানগাড়ীর কাছে গিয়ে মজনুকে বলল, কি মাস্তান সাহেব, এখন কেমন লাগছে ?
মজনু কিছু না বলে ভ্রু কুঁচকে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। ভ্যান গাড়ীর গতির সাথে তাল মিলিয়ে হাসমত দ্রুত হেটে চলছে।
হাবিলদারের কাছে গিয়ে বলল, পুলিশ স্যার, এই লোকটা বেজায় তেন্দর। এরে এমন সাজা দিবেন যাতে আর কখনই জেল থেকে বের না হতে পারে।
হাবিলদার হাসমতের দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু তুমি কে ?
হাসমত মুচকি হেসে বলল, ভালো মানুষ, হাসমত।
হাবিলদার দৃষ্টি সরিয়ে নেবার পর মজনুর দিকে তাকিয়ে ফের বলল, এইবার বুঝবে মঝা, কথায় কথায় দা দেখাও ?
মজনু ক্রোধান্বিত স্বরে বলল, আমি যেদিন ফিরে আসব, সেদিন তোর লাশ না ফেলে এক গ্লাস পানিও খাব না।
হাসমতও গলায় এক কলসি জোর ঢেলে বলল, আমিও দা ধার করে রাখব, তুই এলেই তোর কল্লা কাটব।
হাবিলদার সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাস করল, কী ! তুমি মানুষ হত্যা করবে ?
হাসমত কোনো জবাব না দিয়ে আমতা আমতা করছে।
ভ্যানগাড়ী থামল। যে রশি দিয়ে মজনুর হাতকড়া বাঁধা আছে সেই রশির অন্য প্রান্ত দিয়ে হাসমতকে বেঁধে ভ্যানগাড়ীতে বসানো হল।
ভ্যানগাড়ী ফের চলতে শুরু করেছে। হাসমত একেবারে ক্যাঁচুমাচু হয়ে বসে বসে ভাবছে, দূর ছ্যাতা, কী বলতে কী বললাম ? এখন পুলিশ আমাকেও ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ঐদিকে মজনু পাগলা যেভাবে ক্ষেপে আছে, জেলখানায় যদি এক সাথে থাকতে দেয় তাইলে আমার খবর আছে।
ভ্যানগাড়ী প্রায় এক দেড় কিলোমিটার চলার পর হাসমত বিড়বিড় করে মজনুকে ডাকল, ভাইসাহেব, ভাইসাহেব।
তিন চার ডাক দেবার পর মজনু ধমকের সুরে জবাব দিলো, কী হয়েছে ?
হাসমত কানের কাছে মুখ এনে বলল, আমি আপনাকে অত্যাধিক ভালোবাসি। যখন দেখলাম পুলিশ আপনাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, ইচ্ছা করেই আজে বাজে কথা বলে পুলিশের কাছে ধরা দিলাম। ভালো লোক থাকবে হাজতে আর মত খারাপ লোক বাইরে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াবে, তা কী করে হয় ?
মজনু রুক্ষ স্বরে বলল, এক্কেবারে ভালোবাসার সাগর। না, সাগর না, মহাসাগর।
হাসমত কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলতেই হাবিলদার ধমক দিয়ে বলল, এই চোপ কর। আরেকটা কথা বললে..
হাসমত নিচু স্বরে বলল, কথা বললে কী করবেন ? রাস্তার মধ্যেই জেল দিয়ে দিবেন ? দেন। কথায় কথায় ধমক ভালো লাগে না ছ্যাঁতা।
পরের দিন আসাদ থানায় গিয়ে মজনু ও হাসমতকে জামিনে ছাড়িয়ে আনল।