পাশের হার বনাম মেধার নিন্মমুখিতা এবং শিক্ষার সীমাবদ্ধতা
প্রতিবার ফলাফল প্রকাশ হবার পর পরই পত্র পত্রিকাতে অনেক লেখা চোখে পরে । সেগুলোর বেশীরভাগই মেধা সংক্রান্ত । এই প্রজন্মের মেধা বাড়ছে না ধীরে ধীরে মেধা শূন্য হচ্ছে তার আলোচনা করেন । আমার ঠিক এক জায়গাতেই প্রশ্ন । রাতারাতি সবাই লেখা পরায় মনযোগী হয়ে গেলো? সবাই আচমকা ভালো ছাত্র হয়ে গেলো । এটা একটু সন্দেহের সৃষ্টি করে না কি? কারণ আমরা এতদিনে বেশ ভালোভাবে অনুধাবন করতে পেরেছি যে পাশ করা বিদ্যা আর খাঁটি জ্ঞান অন্বেষণ এক বিষয় নয় । আজকালকার ছেলেমেয়েদের যে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে বই পড়ার প্রতি আগ্রহ একেবারেই কম সে তো আমরা সবাই জানি। তারচেয়ে বরং হাতের মোবাইলে ফেসবুকে চ্যাট ঢের ভালো ওদের কাছে । ফলে ঐ যে জ্ঞান অর্জনের বিষয়টি মুখ্য না হয়ে গৌণ হয়ে যাচ্ছে । ভালো ফলাফল করা আসলেই কঠিন এ আমি স্বীকার করি । কিন্তু শুধু পাস করা আজ কি আর কঠিন ব্যাপার আছে? পড়ুয়া ছাত্ররা সারের নোটস আর নিয়ম মেনে বাবা মার বকুনি খেয়ে বইয়ে মুখ গুঁজে থাকছে এবং সময়মত পরীক্ষার হলে সেগুলো খাতায় লিখে দিতে পারলেই ব্যাস । ভালো ফলাফল নিশ্চিত । তবে তার জ্ঞানের দুয়ার প্রসারিত হচ্ছে কি? এই বিষয়টা সবার নজরে পরে চাকরির পরীক্ষার সময় । লক্ষ্য করার মতো বিষয় হলো আমি অনেক ছেলেকে দেখেছি ডাবল এ প্লাস নিয়ে শহরের ভালো কোন কলেজে ভর্তি হতে পারে না । এমনকি ওয়েটিং লিস্টেও নাম থাকে না । আর চাকরির ক্ষেত্রে তো আরেক ঘটনা । পরীক্ষা দিয়ে না টিকতে পারলেই উপরমহলের দিকে আঙুল তুলছে । তবে এটা যে হচ্ছে না তা না । কিন্তু প্রাথমিক পরীক্ষাতেই অনেকে টিকতে পারে না অথচ তার সার্টিফিকেটে দারুণ ফল । আসলে আমরা কেউ মেধার চর্চা করছি না। শুধু ছাত্র ছাত্রীদের বলি কেন? অনেক অভিভাবক আছেন যারা গল্পের বই হাতে নিলে বকাঝকা করেন । তাদের ধারণা এইসব বই পড়লে পাঠ্য বই পড়ায় বিঘ্ন ঘটে । কিন্তু আমরা তো জানি ঐ গল্পের বইটা ওর মনের খোঁড়াক । খেলাধুলা যেমন মানুষকে নিটোল বিনোদন দিতে পারে ঠিক একটা পাঠ্য পুস্তকের বাইরের বই সেইরকম বিনোদন দিতে পারে । এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে দারুণ জ্ঞান অর্জনের সুযোগ করে দিতে পারে । আমরা অবশ্য এখন তার ধারকাছ দিয়েও যাই না । ভালো ফলাফল করেই আমাদের দায়িত্ব শেষ করে ফেলছি । কিন্তু মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার যে শিক্ষা আমাদের নেওয়া দরকার তা নিতে পারছি কই?
শিক্ষার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে ‘ যা কিছু মানুষের স্থায়ী এবং প্রত্যাশিত পরিবর্তন ঘটায় তাই শিক্ষা “।এক সময় শিক্ষা শব্দটির দুটি উদ্দেশ্য ছিল বলে মনে হয় । শিক্ষার প্রথম এবং প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মানুষ হওয়া আর পরের উদ্দেশ্য ছিল পেটের জ্বালা জুড়ানো বা চাকরি খোঁজার সহায়ক উপকরণ সার্টিফিকেট অর্জন করা যা গৌণ বলে মনে হতো (অন্তত আমি তাই মনে করতাম) । কিন্তু আজ আমি যে কথা মনে করি তা হলো বর্তমান শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য একটা সার্টিফিকেট অর্জন করা এবং পরে মানুষ হওয়া । আপনারা আমার সাথে একমত হবেন এ আশা আমি করি না কিন্তু আমার যে মনের কথা লিখতেই হবে । খুব ছোট বেলায় আমার বাবা যেদিন আমাকে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি করে এলেন সেদিন তিনি আমার মাষ্টার মশাইকে বলে এসেছিলেন ‘ দেখবেন আমার ছেলেটা যেন মানুষ হয় ‘ একথা একটি বারের জন্য বলেন নি ওকে যে কোন ভাবে এক রোল বা প্রথম বানাতে হবে । তখন বুঝিনি ‘ মানুষ’ শব্দটার অর্থ কত বড় । মন দিয়ে লেখাপড়া করতে পারলে যে ভালো রেজাল্ট করা সম্ভব কিন্তু মনুষ্যত্ব অর্জন না করতে পারলে যে মানুষ হওয়া যায় না এই কথাটা আজ গভীর ভাবে অনুধাবন করতে পারি । আমি বিশ্বাস করি আমাদের দেশের শিক্ষার হার একদিন ১০০ ভাগ হবে কিন্তু আপনারা কি এই নিশ্চয়তা দিতে পারেন আমরা ১০০ ভাগ খাঁটি মানুষ পাবো ? আমি ভাবি একশত শিক্ষিত মানুষের চাইতে দশজন সত্যিকারের মানুষ এই সমাজে আজ আমাদের বড় দরকার । যখন মা বাবা আমাকে বলতো মানুষের মত মানুষ হ – আমি তখন বুঝিনি । এই হাত , পা , মুখ অর্থাৎ মানুষের সকল লক্ষণ থাকা সত্তেও আমার কিসের অভাব? আমি লেখাপড়া করছি , ভালো রেজাল্ট করছি আর কি হলে মানুষ হবো? সমাজের প্রতিটি আনাচে কানাচে আজ যে আমাদের বিবেক ধর্ষিত হচ্ছে তার দায় কোন সভ্যতার? সভ্য জাতির? না আমাদের মত হাতে গড়া কিছু লেবাস ধারী শিক্ষিত সমাজের মানুষের? মনটাকে খাবার না দিয়ে শুধু পেটের ক্ষুধা মিটিয়ে চলেছি অবিরত । ভালো রেজাল্ট মানে ভালো চাকরি । সন্তান বড় হয়ে বড় চাকরি করবে , বড় বাড়ীতে থাকবে , একটা এসি গাড়ী কিনবে এই আশা নিয়ে সার্টিফিকেট অর্জনের প্রতিযোগীতায় নামালে তার বিবেক , বোধ যে অচিরেই নিষ্ক্রিয় হয়ে পরবে সে আর আশ্চর্য কি? আমাদের শিক্ষিত হবার দরকার আছে এ কথা কোনোভাবেই অস্বীকার করছিনা কিন্তু সেই সাথে শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য যে মানবিক গুণাবলী অর্জন করা সে কথাও আমাদের বুঝতে হবে । শুধু কয়েকটা কাগজ সাফল্যর সাথে হাতে পেলেই জীবনে সব পেলাম একথা বলা যায় না বরং সমাজে ঐ শিক্ষার কতটা প্রয়োগ করছি এবং তা কি উপায়ে তা ভাবা দরকার বৈকি। যে শিক্ষা সৃষ্টিকর্তার জীবের কোন কাজে লাগে না সে শিক্ষা যে সমাজের বোঝা এবং সর্বোপরি শুধু নিজের রসনা তৃপ্তির কাজ করে এবং কাড়ি কাড়ি টাকা টিভি, ফ্রিজ , এসির যোগান দেয় সেই শিক্ষায় আর যাই থাক বিবেকের যে যথেষ্ট অভাব রয়েছে একথা আমি হলফ করে বলতে পারি।