Today 11 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

মনাডাকাত ও একটি ছায়ারহস্য

: | : ১৩/০৮/২০১৩

মা-বাবা আদর করে ছেলের নাম রেখেছিলেন ’মনা’। সেই মনা এখন বড় হয়েছে; তার সাথে পাল্লা দিয়ে বড় হয়েছে তার নামটিও। ’মনা’ হয়ে গেছে ’মনাডাকাত’। এখন ’মনা’ নামে তাকে কেউ চেনে না, ’মনাডাকাত’ নামে তার বিস্তর পরিচিতি। নামের সাথে কাজের এত মিল পাওয়া কঠিন।

মনাডাকাতের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। তাতে কী! তার যেমন গায়ের শক্তি তেমনি দুঃসাহস। শরীর তার একটুও ভাঙ্গেনি, হিংস্রতাও কমেনি, চোখদুটি জবা ফুলের মত লাল। তাকে দেখলে মনে এক ধরনের ভয় জেগে উঠে।

নিজের এলাকায় বা গ্রামে ডাকাতি করার বদনাম মনাডাকাতের নেই। তার এলাকায় চুরি ডাকাতি হয় না। লোকের ধারনা মনাডাকাতের ভয়ে এই এলাকায় চোর-ডাকাত ঢুকতে পারে না। এদিক থেকে এলাকার লোকজন খুব নিরাপদে আছে। লোকেরা বলাবলি করে, মনা অভাবের তাড়নায় ডাকাতি করে না-স্বভাবদোষে করে। মনাডাকাতকে অনেকেই ভয় পায় ও সমীহ করে।

একরাতে ডাকাতি করে বাড়ি ফিরছিল মনাডাকাত। নীরব-নিস্তব্দ গভীর রাত। পথের দু‘পাশে ছোট বড় নানা জাতের গাছ, মাঝেমধ্যে লতাপাতার কুন্ডলী। তার কাঁধে একটা ঝোলা। কোমরে গামছা বাধা। মুখে বিড়ি। ধুমছে ধুয়া ছেড়ে ভয়হীন মনাডাকাত হেঁটে চলেছে।
মনাডাকাতের মনে হল, কিছু একটা তার পিছু নিয়েছে, তার পায়ে পায়ে হাঁটছে। কিন্তু ভয় পেল না সে।

কে? আমার পায়ে পায়ে হাঁটছিস যে! কী চাস? কী, কিছুই বলছিস না যে! এই বেটা কথা কস না কে? তুই বোবা না কালা? হেহ্? কোন সাড়া-শব্দ না পেয়ে রাগের চোটে পেছনে ঘাড় ফিরিয়েই থ হয়ে গেল দুর্ধর্ষ মনাডাকাত।

একটি ছায়া! অবিকল তার আকৃতির ছায়াটি তার সামনে দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে। ছায়া তো হয় কালো কিন্তু তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ধবধবে সাদা একটা ছায়া। মনাডাকাত যা বলছে, যা করছে, সাদা ছায়াটিও তাই বলছে-করছে। মনার চক্ষু ছানাবড়া।

মনাডাকাত কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার হাঁটতে লাগল। পেছনে তাকাল না, আড়চোখে দেখল ছায়াটি আগের মতই তাকে অনুসরণ করছে। এই নির্জন রাতে একজন মানুষ আর একটি সাদাছায়া লাগালাগি করে হাঁটছে। রা-শব্দ নেই। শুধু হনহনিয়ে হাঁটা। কী মুশকিল!

হঠাৎ থমকে দাঁড়াল অসম্ভব রাগী মনাডাকাত। রাগে গজগজ করছে সে। গভীর রাতে চলাফেরা করে তার অভ্যেস। রাতে-বিরাতে চলতে গিয়ে মাঝে-মধ্যে ভূত-পেরেতের সাাক্ষাৎ পেলেও থোরাই কেয়ার করে সে। কিন্তু এমন ছায়ারহস্যের মধ্যে পড়েনি কোনোদিন। সে আজ একটু বেকায়দায়ই পড়ে গেল। কিন্তু মনাডাকাত তো সহজে ভয় পাওয়ার লোক নয়। মনা পেছনে না ফিরেই ভারী গলায় বলল,
‘তুই কে রে! কী চাস তুই? আমার গায়ে গায়ে হাঁটবি না বলে দিলাম, আমাকে চিনস না। বাড়াবাড়ি করলে তোর চ্যাপ্টা ভুড়িখান ফাটিয়ে দেব।‘
ছায়াটি কোনো জবাব দিল না, চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। মনা আবারও হাঁটতে লাগল। দ্রুত। ছায়াটিও হাঁটছে তার সাথে। ভারী ঝামেলা তো! রাগে আগুন জ্বলছে তার গায়ে। যাকে দেখলে সবাই ভয় পায়, সমীহ করে রাস্তা ছেড়ে দেয়, এলাকাতে যার দুঃসাহসিক অনেক ঘটনা-রটনা আছে, তার সাথে এ রকম নির্জলা মস্করা! কিছুতেই মানতে পারছে না মনাডাকাত। সটান দাঁড়িয়ে গেল সে। দাঁড়িয়ে গেল ছায়াটিও। এবার দু’জন মুখোমুখি হলো।
-কে তুই. কি চাস? ক।
-আমি আপনার বিবেক। আমি এইমাত্র আপনার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছি। আপনার ভেতরে আর থাকতে পারছি না আমি।
-তুই আমার বিবেক? তুই এখানে কী করস? তুই থাকবি গিয়া আমার গতরের ভিতরে। বাইরে কী করস তুই? বিবেক ছাড়া মানুষ চলে কীভাবে?
-`না, আপনি বিবেক ছাড়া মানুষ নন। আপনার ভেতরে রয়েছে আরেকটা বিবেক। অতি দুষ্ট ও বদ বিবেক। আমি তার অসভ্য কর্মকান্ডে ত্যক্ত-বিরক্ত। সে আপনাকে বশ মানিয়ে আপনার ভেতরে অর্জন করেছে প্রবল শক্তি-সামর্থ। আপনাকে সে ভুলপথে পরিচালিত করছে প্রতিনিয়ত। তার কথায় আপনি চলছেন-বলছেন আর ভয়ঙ্কর সব অপকর্ম করে যাচ্ছেন। আমার কোনো কথাই শুনছেন না আপনি। তাই আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। আমি আপনাকে ভালো পথে ফিরিয়ে আনতে চাই। হয় আপনি আমার কথামত চলবেন, নয় আমি আপনাকে চিরতরে ত্যাগ করে চলে যাব?’

মনাডাকাত চিন্তিত হয়ে পড়ল। সে বিস্ময়ে সরলভাবে তাকিয়ে রইল তার সামনে দন্ডায়মান বিবেকের দিকে। কী বলবে সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। কাঁধের গাটরিটা নামিয়ে রাস্তার ধারে একটা পুরনো গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়াল সে। ছায়াটিও তার সাথে গিয়ে সামনা সামনি দাঁড়াল।

মনাডাকাতের পেশা ডাকাতি। সে এইমাত্র ডাকাতি করে এসেছে। তার তিরিক্ষি মেজাজ আরো তিরিক্ষি হচেছ। মনাডাকাত একটা নেশার বোতল বের করে মুখে দিতেই ছায়াটি ছোঁ মেরে নিয়ে গেল বোতলটি। মনা মেজাজ খারাপ করে তাকাল ছায়াটির দিকে। কিছুই বলল না। তারপর সে কোঁচর থেকে বিড়ি বের করে মুখে দিল। দেশলাইয়ের একটা কাঠি বের করে বিড়িতে আগুন দিতেই ফুস করে উড়ে গেল বিড়িটা। মনা রেগে-মেগে ফায়ার। সে কোনো কথা না বলে কটি থেকে বের করল একটা ছুরি। অন্ধকারে ছুরিটি কেমন ঝিলিক দিয়ে উঠল। মনাডাকাত ছুরিটি নাড়াচাড়া করে ছায়াটিকে দেখিয়ে বলল,
এটা কি তুই চিনস?
চিনি, এটা একটা ছুরি, জবাব দিল ছায়াটি।
মনা বলল, এটা দিয়ে কী করি জানস?
আলবৎ জানি, ছায়াটি বলল।
যদি জানস তো কোন সাহসে আমার সামনে এখনও দাঁড়িয়ে আছিস। আমি এই ছুরি দিয়ে তোকে চাক চাক করে ফেলব। তুই ভাগ এখান থেকে।

ছায়াটি শরীর ঝাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বলল, আপনি এসব কাজে এতই ওস্তাদ যে, যদি সত্যি আমাকে চাক চাক করতে পারতেন, এতক্ষণে করে ফেলতেন-একটুও দেরি করতেন না। পারেন না, তাই করেন না।
এ কথা শুনে মনা অপমানবোধ করল। সে রাগে কাঁপতে লাগল। কোনো কথা না বলে আচমকা ছুরিটা ফস করে ঢুকিয়ে দিল ছায়াটির পেটে। কিন্তু ছায়াটি দিব্যি দাঁড়িয়ে রইল আগের মত। একটু নড়া-চড়াও করল না।
একি! মনা দু‘চোখ বন্ধ করে অন্ধভাবে কচুকাটা শুরু করে দিল। সে ভাবছে এতক্ষণে ছায়াটি কেটেকুটে চাকচাক হয়ে পড়ে আছে মাটিতে। মনা হাঁপাতে লাগল। সে চোখ খুলে দেখে ছায়াটি তার সামনে দাঁড়িয়ে আগের মতই হাসছে। মনা রাগে অস্থির হয়ে হাতে পায়ে কিল ঘুষি আর লাত্থি-গুঁতো মারা শুরু করে দিল ছায়াটিকে। ছায়াটি দাঁড়িয়ে আছে একদম স্বাভাবিকভাবে।

কান্ত-শ্রান্ত মনাডাকাত গাছের তলায় বসে হাঁপাতে হাঁপাতে ছায়াটিকে বলে, `মস্করা করস, নাহ্? গাছের ডালা ভেঙ্গে তোর পিঠে ভাঙ্গবো রে বিবেইক্কা। রাখ, একটু রেষ্ট নিয়া লই। আমার মাথায় চেলচেল করে রক্ত উঠতেছে। তোর দফা রফা করে ছাড়ব না আমি। তুই মনাকে চিনস, মাগার এখনও মনাডাকাতকে চিনস না। এবার বুঝবি।’

মনাডাকাত রাগে ফুঁসছে। কাপাহাতে কোচর থেকে বিড়ি নিল মুখে। আগুন দিল। লম্বা টানে ইটভাটার চিমনির মত নাকে মুখে ধুয়া বের করল। গাছে হেলান দিয়ে বিড়ি টানছে মনাডাকাত। তাকে খুব কান্ত-শ্রান্ত ও বিরক্ত দেখাচ্ছে।

সামনে দাঁড়িয়ে সাদাছায়াটি সরলভাবে বলে, `এ জীবনে আপনি কয়টি ভালো আর কয়টি খারাপ কাজ করেছেন, আপনার নির্মমতা কত মানুষের জীবনে কত দুঃখ-যন্ত্রণার কারণ হয়ে আছে, কত কান্না, কত হাহাকার কত অশ্রূ ঝরিয়েছেন আর কত মানুষের অভিশাপ বয়ে চলেছেন আপনি। একটু ভেবে দেখেন তো ওসব কী আপনার বেঁচে থাকার জন্য খুব প্রয়োজন ছিল? বেঁচে থাকার জন্য কি এরচেয়ে ভালো পথ নেই? তবে কেন মানুষ হয়ে পশুর মতো কাজ করে এভাবে মানুষের অভিশাপ নিয়ে চলেছেন আপনি? বলুন, জবাব দিন।’

মনাডাকাত ঝিম মেরে বসে রইল। তার দু‘চোখ বন্ধ হয়ে এলো। তার হাতে নির্মমভাবে আহত-নিহত হওয়া ও লুটপাটের সময় মানুষের আহাজারির করুন চিত্র বিচিত্রভাবে ভেসে উঠল। তার দু‘চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। তার সমস্ত শরীর ঘেমে সয়লাব।

প্রচন্ড বেগে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল মনা। মনে হলো তার শ্বাসের সাথে একটা দানব বেরিয়ে গেল। মনাডাকাত উঠে দাঁড়ালো এবং হঠাৎ করে ছায়াটিকে ঝাপটে ধরে আলিঙ্গন করতে লাগল। পরে সে সবকিছু ছুড়ে ফেলে দিয়ে সোজা বাড়ি চলে গেল।

তারপর মনাডাকাতকে আর রাতের অন্ধকারে ঘরের বাইরে কদম ফেলতে দেখা যায়নি।

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top