Today 11 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

ধারাবাহিক উপন্যাস “নরক”–শেষ পর্ব

: | : ১৮/০৮/২০১৩

416991_499930286705069_343756856_nএখনো সন্ধ্যা হয় নি। ঘরের দেওয়াল ঘেঁষে সর্বহারার মত বসে আছে মজনু । তার চোখ দিয়ে এখন আর অশ্রু ঝরছে না। শোকে হয়ত পাথর হয়ে গেছে। মজনু বসে বসে সবুজের সাথে তার বিভিন্ন স্মৃতির মাঠ চষে বেড়াচ্ছে আর ভাবছে, এ রকম একজন ভালো মানুষকে আরেকজন মানুষ কীভাবে হত্যা করতে পারে ?

এই এলাকার মানুষের কথা চিন্তা করে যে মানুষটি নিজের জীবনের সমস্ত সুখ শান্তি বিসর্জন দিয়েছিল, সেই এলাকার লোকের হাতেই খুন হল ভাইজান ! যেই বুকে স্বপ্ন ছিল সবাইকে নিয়ে গিয়ে যাবার, কেউ কেউ মৃত্ত্যুদূত হয়ে সেই বুকে বসেই চেপে ধরেছে গলা ! মানুষ এত নিষ্ঠুর হয় কীভাবে ? কোন পাষাণ আমার ভাইয়ের গলা টিপে ধরে ছিল ?
কিছুক্ষণ পর দা হাতে মতিন হাজির হল। কাছে এসে মজনুর দিকে দা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, চলেন ভাইজান, হামিদ খাঁকে কেটে টোকরা টোকরা করে খালের জলে ভাসিয়ে দেই।
ক্রোব্ধ নয়নে মজনু খানিক তাকিয়ে রইলো মতিনের দিকে । তারপর দা হাতে নিয়ে দা-এর দিকে তাকাতেই মজনুর পাথরে শরীর তুলার মত পাতলা হয়ে গেল। অলস বাহুতে এক পৃথিবী জোর এল। রক্ত কণিকায় ফিনকি দিয়ে উঠল ক্রোধ। শোকাহত চোখের মনি দুটো ধীরে ধীরে রক্তাব হয়ে উঠছে। সেই চোখে একবার শুধু তাকাল মতিনের দিকে।
মতিন মূক হয়ে দাড়িয়ে আছে। তার চোখে মুখেও প্রতিশোধের অগ্নি দৃশ্যমান। মজনু দা হাতে উল্কার বেগে ছুটে চলল হামিদ খাঁর বাড়ির দিকে । মতিনও তার পেছনে পেছনে দৌড়াচ্ছে।
সবার চোখে উপচে পড়া ক্ষোভ, মুখে প্রতিবাদের সুর। বহু দিন পর যেন জেগে উঠেছে ঘুমন্ত প্রান্তর। ভীতির আলখেল্লা ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে কিছু অর্বাচীন নতুবা লাশেরা ফিরে পেয়েছে প্রাণ। সবাই ছুটে চলছে শয়তানের কেল্লা মুখে, শকুনের বিষ দাঁত ভেঙ্গে দেবার দৃঢ় প্রত্যয়ে। প্রতিবাদের এই মিছিলে হাসমত হয়েছে অগ্রগামী। তার মুখ থেকে কথা নয়, বাণী নয়, ঝরে পড়ছে অগ্নি । অসংখ্য মানুষ ভিড় জমিয়েছে হামিদ খাঁর বাড়ির বাহির আঙ্গিনায়। হামিদ খাঁ বারান্দায় দাড়িয়ে আছে, তার পেছনে আছে কুদ্দুস চৌকিদার দফাদারসহ অনেক সাঙ্গো পাঙ্গো।
হামিদ খাঁ চিৎকার করে জনতার উদ্দেশ্যে বললেন, কী চাও তোমরা ?
চিৎকারের জবাব চিৎকার দিয়েই দিলো হাসমত, ডাক্তার সাহেবকে কে খুন করেছে ?
হামিদ খাঁর উর্ধ্ব স্বরের জোয়ারে কিঞ্চিৎ ভাটা পড়ল। তাই তো খানিক আমতা আমতা করে বললেন, ডাক্তারকে কে খুন করেছে, আমি কীভাবে বলব ?
হাসমত ফের চেঁচিয়ে বলল, লোকজন দিয়ে আপনিই ডাক্তার সাহেবকে খুন করিয়েছেন। কোথায় ওসমান ? ডাকুন তাকে।
হামিদ খাঁ এদিক ওদিক তাকিয়ে ঠোঁটে বাজিয়ে বললেন, ভূতের মুখে রাম রাম ! চুরি বাদ দিয়ে রাজনীতি শুরু করেছিস নাকি হাসমত ?
হাসমত যেন আজ সকল ভয়ের উর্ধ্বে। মুখে নেই কোনো জড়তা, বুকে নেই কম্পন।
হাসমত শনশনে গলায় ফের জবাব দিলো, চুরি করি, আর যাই করি । আপনার মত মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলি না। আপনি মানুষ না, ধয্যাল। মানুষের রক্ত দিয়ে খেলা করেন। স্বার্থের জন্য হেন কোনো কাজ নেই যা আপনি করতে পারেন না।
হামিদ খাঁ হা করে হাসমতের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। সে বুঝতে পারছে না এসব কি হাসমত বলছে, না অন্য কেউ ? মুর্খ হাসমতের মুখে এমন প্রতিবাদের ভাষা এল কোথায় থেকে ? এসব ভেবে হামিদ খাঁর শরীর ঘেমে যাচ্ছে, ভেতরে ভেতরে ভীতির কম্পন শুরু হয়ে গেছে।
হাসমতের কণ্ঠের সাথে উপস্থিত জনতাও সুর মিলাচ্ছে। হামিদ খাঁ জনতার দিকে তাকিয়ে ঘন ঘন ঢোক গিলছে। এরই একফাঁকে মজনু ভিড় ফুঁড়ে ভেতরে ঢুকে মুখে কিছু না বলে দা ঝেড়ে কোপ বসাল হামিদ খাঁর শরীরে । সেই কোপ গিয়ে লাগল হামিদ খাঁর কাধে। গায়ের পাঞ্জাবি ভিজে রক্ত পড়ছে মাটিতে। হামিদ খাঁকে কোপ দিতে দেখে আতংকে উপস্থিত লোকজন দিক বেদিক ছুটতে শুরু করেছে। দফাদার চৌকিদার মিলে মজনুকে বারান্দার খুটির সাথে বেঁধে ফেলল। পেছন দরজা দিয়ে মটরসাইকেল করে হামিদ খাঁকে কোথায় যেন নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
থানায় দুইটি মামলা হয়েছে। হামিদ খাঁকে হুকুমের আসামী করে একটি মামলা করেছে বর্ষা। ইউ পি চেয়ারম্য্যানের প্রাণ নাশের জন্য স্বশস্ত্র হামলার অভিযোগে আরেকটি মামলা করেছে পুলিশ। সেই মামলায় মজনুকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
আমাদের ময়মনসিংহ এলাকার বিখ্যাত একটি প্রবচন হল, “পইসার পুতের মউত নাই, যদি না নেয় যমে” হামিদ খাঁর পয়সা ও পাওয়ার দুটোই আছে। তার কিছু হবে বলে মনে হয় না। ক্ষমতাবানদের অপকর্মের জন্য সাজা ভোগ করতে হয়েছে, এমন নজির এই দেশে কম !
হামিদ খাঁ বর্তমানে মাদ্রাজের একটি উন্নত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। তার অবস্থা মোটামোটি ভালো বলে জানা গেছে। ভালো হয়ে ফিরে এসে সবুজদের রক্ত ভেজা মাটির উপর দিয়ে হয়ত আবার বহাল তবিয়তে চলাফেরা করবে !
কিন্তু সবুজদের কী হবে ? এই দেশে সবুজরা কি সব সময় উপেক্ষিতই থাকবে ? লাঞ্ছনা বঞ্চনা সহ্য করার জন্যই কি সবুজরা এ দেশে বার বার জন্ম গ্রহণ করে ? সবুজরা কি বার বার হেরে যাবে অপশক্তির কাছে ? অপমৃত্ত্যুর কালো থাবায় আমরা আর কত সবুজকে হারাবো ? ..? …? .. .. .. ..
দুই মাস পর। ময়মনসিংহ জেলখানা। মজনু এখন সদর জেলে আছে। ইতোমধ্যে তাকে একাধিক বার আদালতে হাজির করা হয়েছে। হামিদ লোকেরা নিয়মিত আদালতে এসে সাক্ষী দিচ্ছে। হয়ত তার সাজা হয়ে যাবে! সে নিয়ে মজনুর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
অন্যদিকে সবুজ হত্যা মামলা চলছে ঢিলেঢিলা ভাবে। এখনো এফ আই আর (ফ্রাষ্ট ইনভেষ্টিগেশন রিপোর্ট) দাখিল করা হয় নি। হামিদ খাঁ শহরের নাম করা উকিল রেখেছেন। এ ব্যাপারে তাকে একদিনও আদালতে আসতে হয় নি ! সাক্ষী প্রমানের অভাবে সবুজ হত্যা মামলা হয়ত বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ঝুলতে থাকবে ! হামিদ খাঁ হয়ত খালাসও পেয়ে যাবে !!
জেলখানায় মজনুকে দেখতে এসেছে মতিন। বর্ষা ও মতিন মাঝে মাঝেই মজনুকে দেখতে আসে। আজ বর্ষা আসতে পারে নি কারণ সে শারীরিক ভাবে অসুস্থ । তাইতো মতিন একাই এসেছে।
মজনুর সঙ্গে কথাবার্তার এক ফাঁকে মতিন জানাল বর্ষা অন্তঃসত্ত্বা। এই কথা শোনার সাথে সাথে মজনু দুই হাত তুলে পরোয়ারের দরবারে শুকরিয়া আদায় করল।
তারপর উচ্ছ্বাসিত স্বরে মতিনকে বলল, দেখিস, ছেলে হবে।
খানিক চুপ থেকে কান্না সিক্ত কন্ঠে উর্ধ্ব স্বরে ফের বলল, ভাইজান ফিরে আসছে। নরকখানার হামিদ খাঁরা শোনো, কোনো বর্বতা দিয়েই সবুজদেরকে নিশ্চিহ্ন করা যাবে না। সবুজরা বার বার এই মাটিতে ফিরে আসবে। সবুজরা অমর। চিরন্তন।
……………………………………………………

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top