Today 11 Oct 2025
Top today
Welcome to cholontika

নিয়োগ পত্র (প্রথম পর্ব)

: | : ১৯/০৮/২০১৩

(এক)
ইদানীং পত্রিকা বিক্রেতারা বড় হার কিপটে হয়ে গেছে। চালাক চতুরও বটে। নিউ মার্কেটের মোড়ে ফুটপাতে বসে দু’চার জন বিক্রেতা। পাঠকরা আসে। পছন্দ সই পত্রিকা হাতে নেয়। আবার রেখেও দেয়। এরকম পত্রিকা পড়ার অভ্যাস অনেকের আছে। নিতান্ত প্রয়োজনে কেউ বা কিনে নেয়। অনেকে চোখ বুলিয়েই পত্রিকার প্রয়োজন মিটিয়ে ফেলে।  কেনার প্রয়োজন হয় না। এতে নির্দিষ্ট একটা অংশের বড় উপকার হয়। বিশেষ করে যারা কর্মহীন। বেকার।
কদিন থেকে হকারদের ভাবভঙ্গি বড় নিষ্ঠুর হয়ে গেছে। পত্রিকার পাতাগুলো একসাথে পিন মেরে রাখে। পড়তে হলে কিনে পড়তে হবে। চার টাকা দিতে হবে। প্রথম পাতার হেডলাইনগুলো পড়া যায়। ভিতরের পাতা পড়তে হলে কিনতে হবে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি গুলো সব ভিতরের পাতায়। পিন তুলে পড়ার কোন উপায় নেই। তাহলে তো ব্যবসা চলবে না।
খুলে পড়তে গেলে বড় রাগ করে। করবে নাই বা কেন। জিজ্ঞেস করলে বলে-পিন না মাইরা উপায় আছে। অনেকে শুধু পাতা উল্টাইয়া চইল্যা যায়। যাদের হাতে সময় নাই তারা একটা পত্রিকা কিনে। বাসায় গিয়া হোক আর অফিসে হোক পড়ে। যাদের হাতে দেদার সময় আছে হেরা খালি এই পেপার ঐ পেপার উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখবো, তারপর চইল্যা যায়। কিছু কইবারও পারি না। অহন কি আর করূম। না বেচলে খমিু কি। আগে কত ভীড় থাকতো। অহন পিন মারনে ভীড় কিছুটা কমছে।
– এতে তোমার বিক্রি বেড়েছে।
– হ। অনেক বাড়ছে। আগে খালি দাড়াইয়া পড়তো। অহন হেরাও কিনা নিয়া য়ায়।
তিমির বরণ রায়।
বিনা পয়সায় দাড়িয়ে পত্রিকা পড়–য়াদের একজন। তিমির কথাগুলো মন দিয়ে শোনে। একেবারে মিথ্যা নয়। গলির মোড়ে হকারটার দরবারে প্রতিদিন কমপক্ষে একটা ঘন্টা সময় দেয়। সবক’টা পত্রিকায় চোখ বুলিয়ে নিত। মাঝে মধ্যে দু’একটা কিনে নেয়। পষ্ট বুঝতে পারছে-হকার হাশেম বিরক্ত হচ্ছে। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলত না।
হকার হাশেম এই দলটাকে চিনে। দুঃখটাও বোঝে। তাই তিমির, স্বপন, মফিজ, ঝন্টু, আব্দুল ওরা গেলে হাশেম হাসিমুখে বলে-ভাই এই পেপারটা দ্যাহেন। অনেকগুলো বিজ্ঞপ্তি আছে। তিমির হাত বাড়ায়। কই দেখি।
পকেটে টাকা থাকলে কিনে নেয়। নয়তো রেখে দেয়। তাতে পরিচিতদের সামনে হাশেম খুব একটা বিরক্তি প্রকাশ করে না। চোখ তুলে তাকায় মফিজ। তিমিরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে – তোর কিছু হলো?
–    হবে আবার কি? চাকরীতো করছি।
–    তার মানে। সেদিন যে ইন্টারভিউটা দিলি, তাতে জয়েন করেছিস্?
–    সে সৌভাগ্য আর হলো কোথায় ?
–    তবে যে বলছিস।
–    এই তো চাকরী। প্রতিদিন হাশেম মিয়াকে বিরক্ত করা, অফিসে অফিসে ধর্ণা দেওয়া, পোষ্ট অফিসে যাওয়া এইতো। এই হচ্ছে চাকরী। তবে কোন বেতন নেই। দুজনেই হাসল।
হাশেম বলল-কি যে বলেন ভাই, বিরক্ত হব ক্যান। সবাইকে তো আর হেই সুযোগ দিই না। তাছাড়া আপনাগো মতো আমিও অনেক ঘুরেছি। তখনও দেশ স্বাধীন হয় নাই। সবে মেট্রিক পাশ করেছি। যুদ্ধও করেছি নয়মাস। যুদ্ধ শেষ। বড় ভাইটা মারা গেল যুদ্ধে। অনেক ঘুরলাম একটা চাকরীর জন্য। বাবা ছিল না। মা, দুবোন আর ছোট ভাইটা নিয়ে ভীষণ খারাপ অবস্থা। অনেক ঘুরছি, অনেকের কাছে ধর্না দিয়েছি। কে কার খবর রাখে। কোথাও কিছু হয়নি। শেষ পর্যন্ত পত্রিকা বিক্রি শুরু কররাম। সেই থেকে শুরু। আজ পর্যন্ত থেমে থাকিনি। কি আর করুম। চাকরীর জন্য বইসা থাকলে তো পেট চলবো না।
–    তুমি ভালোই করেছ হাশেম মিয়া। চলি মফিজ।
–    কোথায় যাবি? ইন্টারভিউ?
–    না।
–    তবে?
–    দেখি। জীবনে পরীক্ষা ছাড়া আছেই বা কি। এখন শেষ পরীক্ষাটা কবে দেবো ভাবছি।
তাতো কেউ জানে না। জীবনে একটা সময় আসে যখন নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়। ইচ্ছে হয় আত্মহত্যা করি। সে যাকগে। আমার কিন্তু একটা কাজ খুব খারাপ লাগে।
–    কি? জিজ্ঞাসা করল তিমির।
–    সাহেবদের টেবিলের সামনে গিয়ে হাতের তালু ঘষে ঘষে তোষামোদি করা। ইচ্ছা হয় দু’টো কড়া কথা শুনিয়ে দিই।
–    মফিজ, কিছু কাজ আছে খারাপ লাগলেও করতে হয়। সে শুধু সার্টিফিকেটটার জন্য। একটা মস্ত বড় বোঝা। এই করেই তার সৎকার করতে হবে। নয়তো শিক্ষার মূল্য কি রে। আজ চলি।
–    ঠিক আছে। আমি আজ কোথাও বের হচ্ছি না। বিকালে বাসায় আসিস। একসাথে কোথাও বের হবো।

(দুই)
হলুদ খামটা নিয়ে অপেক্ষা করে তিমির। তিন নম্বর বাস অফিস পাড়া হয়ে যাবে। এক টাকা বাস ভাড়া। টেম্পোতে চার টাকা। প্রতি তিরিশ মিনিট পর পর বাস। এর মধ্যে টেম্পোগুলো একের পর এক চলে যাচ্ছে। তিমির উঠতে গিয়েও উঠতে পারে না। হাত ঘড়িটা দেখে। ঘন্টার কাটাও এগারটা ছুইঁ ছুইঁ।
বাংলাদেশ সচিবালয় থেকে দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি পর্যন্ত অনেকগুলো অফিসের সাথে তিমিরের পরিচয় ঘটেছে। শুধু মাত্র এই হলুদ খামটার সুবাদে। তিমিরের চাক্ষুস পরিচয় না থাকলেও তিমিরকে সবাই চেনে। অনেকের ড্রয়ারে কিংবা ছেড়া কাগজের ঝুড়িতে যতেœ কিংবা অবহেলায় পড়ে আছে দুটো নাদুস নুদুস চেহারার পাসপোর্ট সাইজের ছবি। সে পরিচয় তেমন গুরুত্ব বহন করে না। তিমিরের চাক্ষুস পরিচয় ঘটলে যেন স্বর্গলাভ হয়। এটা যেন তিমিরের মত হাজারো যুবকের প্রত্যাশা। সবারই চাওয়া পাওয়া এক। প্রার্থীত পদে নিয়োগ দান করার জন্য আপনার সহানুভূতি কামনা করছি।
সেই ভিক্ষা শুধু প্রার্থনা করাই সার। সেই নিষ্ঠুর হাত ভিক্ষা দেয় না। ছুড়ে ফেলে দেয় ডাষ্টবিনে। তারপর কাগজ কুড়ানো টোকাইর দল মহানন্দে পুড়ে নেয় তাদের ঝুড়িতে। এক টাকা সেরে বিক্রি করার জন্য। হায়রে নিয়তি।
বাংলাদেশ শিক্ষা বিভাগের প্রথম শ্রেনীর নাগরিকের তালিকায় তিমিরের নাম আছে। জগদীশ বাবুর একটাই ইচ্ছা। সেই তালিকায় ছেলের নামটা লেখানো। ভগবার সেই ইচ্ছা পূর্ণ করেছেন। তালিকায় নাম উঠল। জগদীশ বাবু এর বেশী কিছু কখনও আশা করেন নি। সামর্থ্যওে মধ্যে এই ছিল তার স্বপ্ন। তারপর একটা লাল টুকটুকে বউ ঘরে আনবে। ব্যাস্ চলে যাবে জীবন। ভেসে যাবে আনন্দের ¯্রােতে। ছেলের জন্য বাবার গর্ব তো বটেই। সোজা কথা। ডিগ্রি পাশ ছেলে। কত মেয়ের বাপ জামাই করার জন্য উঠে পরে লাগবে।
অন্ততঃ ডিগ্রি পাশটা ছিল জগদীশ বাবুর কাছে এক কল্প লোকের চাবি। পুর্বপুরুষের মধ্যে একমাত্র তিনিই তিমিরকে দিয়ে সেই স্বপ্নের বাস্তব রুপ দিতে পেরেছেন। তিমির বলত- প্রথম প্রথম আমিও বাবার মত গর্ব করতাম। এখন করি না। অবশ্য বাবা এখনও সেই গর্বে গর্বিত। আমি ভাবি আর যাই হোক, আর কিছু পারি বা না পারি, বাবার ইচ্ছাটা পূর্ণ করতে পেরেছি। বাবা বলতেন-তিমিরকে ডিগ্রি পাশটা করিয়ে একটা বিয়ে দিতে পারলে আমার কলজেটা পোড়া যেত। এখন ভাবছি পাশ না করাটাই ভালো ছিল। বাবার দ্বীতিয় ইচ্ছাটা বুঝি আর পূরণ করা সম্ভব হবে না।
মানুষ জীবনের স্বপ্ন দেখে। সুন্দর একটা জীবন। হাসি আনন্দে ভরে থাকবে সারাক্ষন। তিমিরও দেখে। চাওয়া পাওয়া আছে। তবে খুব বেশী নয়। যা তার নিজের জন্য প্রয়োজন। যেটুকু তার পরিবারের জন্য প্রয়োজন। আনন্দ বেদনায়, হাসি কান্নায় পরিপূর্ন সুন্দর স্বাভাবিক একটি জীবন। এইতো। আর কি চায় ?
এই যুগ চরম আধুনিকতার যুগ। ¯্রােতের টানে গা ভাসিয়ে দেওয়া তিমিরের স্বভাব নয়। এই যুগে এসেও তিমির ভাবে, সুন্দর একটি জীবন গড়ে তোলার জন্য দু’টো জিনিষই যথেষ্ট। এক ভালোবাসা, দুই স্ব-উপার্জিত কিছু অর্থ। পরস্পর এক নিবিড় সম্পর্ক এই দু’টোর মধ্যে। থাকলে দুটোই থাকে। কি আশ্চার্য! কাউকে ছাড়া কেউ বাঁচতে পারে না। অভাব মানুষকে এতিম করে। সাদা কাপড়ে সমালোচনার কালো কালিমা পড়ায়। সে বোধ তিমিরের পায়ে পায়ে। বয়সের তুলনায় সচেতন বিবেকবোধ খুবই প্রখর। কাজের প্রতি তীব্র এক নেশা। কাজের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করতে চায়। নিদ্দিষ্ট একটা বয়সে মানুষের কিছু খ্যাতি জুটে। বয়ো বার্ধক্যে তা ম্লান হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ ছোটবেলায় ঘোষবাবুদের বাড়ীর আম চুরি করেছিল বলে এখন কেউ আমচোরা রবীন্দ্রনাথ বলবে না। এখন তিঁনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সর্বজন পূজনীয়। আগেরটা নিতান্ত বয়সের ব্যাপার।
সব মানুষের জীবনেই কিছু না কিছু ঘটনা থাকে যা নিতান্ত মন্দ। বয়সের ভারে সেই একই কাজটি যখন আর একজন করে তখন গম্ভীর গলায় বলবে-এ কাজটি ভালো নয়। অথচ দেখা যায় সেই মন্দ কাজটিই একসময় তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে করেছেন। জীবনের সিড়িগুলো এরকমই হয়। যতই উপরে উঠা যায়, ততই নীচের দিকটা ঝাপসা হয়ে আসে। অচেনা মনে হয়। সবশেষে একটা নতুনত্ব সৃষ্টি হয়। আদুরে গলায় বলতে ইচ্ছা করে, কতদিন পরে তোমার সাথে দেখা। কতদিন ভেবেছি এ পথে যাওয়ার সময় একবার ঘুরে যাবো, যাওয়া হয় না। আসলে সময়ই যেন সব কিছু পাল্টে দেয়। এই সময়ের কাছে আমরা বড় অসহায়।
চলবে…..

লেখক সম্পর্কে জানুন |
সর্বমোট পোস্ট: ০ টি
সর্বমোট মন্তব্য: ১ টি
নিবন্ধন করেছেন: মিনিটে

মন্তব্য করুন

go_top