সুখ-লহরী(প্রথম পর্ব)
বাস থেকে নেমেই আয়েশার চপ্পল ছিঁড়ে গেল। ফিতে ছেঁড়া চপ্পল নিয়ে হাঁটা
যায় না।এদিক-ওদিক তাকিয়ে সে চপ্পল খুলে পলিথিনের ব্যাগে ভরল।খালি
পায়ে হাঁটতে শুরু করল পিচ রাস্তায়।
বর্ষাকাল।সকালের রোদ।তবু পিচ রাস্তা তেতে গেছে।হাঁটতে ইচ্ছে করছে না।
তবু বেশ জোর পায়ে হাঁটছে আয়েশা।চেষ্টা করছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লোকচক্ষুর
আড়ালে চলে যেতে।
ভোরবেলা আয়েশা যখন রওনা হওয়ার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে তখন ছোট মেয়েটির ঘুম
ভেঙে গেছিল।জড়ানো গলায় বলল: এত সাজগোজ করে কোথায় যাবেন আম্মু?
হায়-রে পোড়া কপাল।আয়েশা চলেছে এমন একজনের কাছে যার নাম বলা যাবে
না।সে কষ্টের হাসি হেসে বলল:আমি একটু শহরে যাব সোনা।তোমরা দুই বোনে
শান্ত হয়ে থেকো।কেতলিতে চা করা থাকল।মুড়ি-বেরেস্তা রাখা আছে গামলায় দুই
বোনে ভাগ করে খেও।দুপুরের আগেই আমি চলে আসব।
বড়মেয়ে তবসুম কিছুটা বোঝে।তবু সে অবুঝের মত বলল:আপনি আব্বুর খোঁজ
করেন না কেন মা?
—তোদের আব্বু হারিয়ে গেছেরে,তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।বলে চোখে
আঁচল চাপা দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছিল আয়েশা।
পিচরাস্তা ছেড়ে নদীর পাড় ধরল আয়েশা।নদীর পাড়ে কেউ ঘাস কাটছে।কেউ ছোট
জালি নিয়ে মাছ ধরছে।সকলেই দেখছে আয়েশাকে।তাদের অবাক দৃষ্টি দেখে লজ্জায়
কুঁকড়ে যাচ্ছে সে।তবু থামছে না।লোকটার সঙ্গে দেখা করে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে।
নদীর পাড়ে ছোট্ট কুঁড়েঘর।সেখানে এক ফকিরসাহেব বসে আছেন চাটাইয়ে।পরনে
আলখাল্লা।চোখ বন্ধ।দুটি মেয়ে বসে আছে তার সামনে।তারা হয়ত দোয়া-তাবিজ নিতে
এসেছে।তাদেরও চোখ বন্ধ।
আয়েশা চুপি-চুপি বসে পড়ল মেয়ে দুটির পাশে।
একসময় চোখ খুললেন ফকিরসাহেব।হাতে ধরা একটি মাদুলি এগিয়ে দিলেন একটি
মেয়ের দিকে।বললেন,এই তাবিজ ডান হাতে পরবি,জোহরের নামাজ পড়ে।ইনশাল্লাহ
সাতদিনের মধ্য তোর স্বামী ফিরে আসবে।
অন্য মহিলা বোধকরি ওই মেয়েটির শাশুড়ি,সে আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে-মুছতে বলল,
কোন ডাইনি যে আমার বাছাকে বশ করল বাবা!যদি সে ফেরে আপনার দরগায় খাসি
মানত দিয়ে যাব।
মেয়ে দুটি যখন চলে যাওয়ার জন্যে উঠে দাঁড়াল তখন আয়েশা বলল,আমার স্বামী
কবে ঘরে ফিরবে ফকিরসাহেব।
—তোমার স্বামী আর ফিরবে না।সে এখন সর্বত্যাগী ফকির।
মেয়ে দুটি চলে গেছে বুঝতে পেরে আয়েশা মুখ বিকৃত করে বলল,ওরে আমার ফকির
রে,মানুষ খুন করে এসে ফকিরগিরি ফলানো হচ্ছে। সোজা বাড়ি চল,নইলে আমিই
পুলিশ নিয়ে এসে ধরিয়ে দেব তোমাকে।
ফকিরসাহেবের প্রশান্ত মুখে আতঙ্কের বলিরেখা ফুটে উঠল।বলল,বিশ্বাস কর আয়েশা,
আমি খুন করিনি।
—কি-করে বিশ্বাস করব,সব প্রমাণ তোমার বিরুদ্ধে গেছে।বাড়িতে পুলিশ আসছে।
মেয়ে দুটিও কত শত প্রশ্ন করছে।
—ধৈর্য ধর,সবুর কর,আল্লাহকে ডাক।
—সে তো সব সময় ডাকছি কিন্তু রব্বুল আল আমিন,এই অভাগীর ডাক শোনেন
না।কত লোক খারাপ প্রস্তাব নিয়ে আসছে তা জানো?
—কে,কে বলো তো? আমি তাকে বাণ মেরে শেষ করে দেব।
—ওসব ফালতু আড়ফি ছাড়,তোমার মুরোদ কত তা আমার জানা আছে।
আয়েশার ধমক খেয়ে রীতিমত বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল ফকিরবেশী আরিফ।আমতা-আমতা
করে বলল,আমার দোয়া-তাবিজের কত গুণ তা ওদের ভিড় দেখে বুঝতে পারো না?
আয়েশা হাসল।তার হাসির ঢেউ ছুঁয়ে গেল উজ্জ্বল দুই চোখে। বলল,সত্যি করে
বলো তো মেয়েটাকে খুন করলে কেন?
দাড়ির বেশ কয়েকটি সফেদ হয়ে গেছে। তাতে হাত বুলোতে-বুলোতে আরিফ বলল,
তুমি তো ভাল করে জানো,আমি একটা মুরগী জবাই করতে পারি না,সেই লোক কি
কোন মেয়ের গলা কাটতে পারে।
—আমি তো জানতাম আরিফ সেখ,যে কি আসানসোলে গিয়ে রাজমিস্ত্রীর যোগাড়ের
কাজ করে,সে ভাল করে নামাজ পড়তে পারে না,বউয়ের কাছে কুরানের উচ্চারণ ঠিক
করে নেয়,সে কিনা এখন আমলের জোরে ফকির-দরবেশ। তার দরগায় মেয়েরা এসে
দোয়া-তাবিজ পাচ্ছে।
—সবই আল্লাহপাকের ইচ্ছা।
—তার মানে তুমি বলতে চায়ছো,আল্লাহ’র ইচ্ছায় তুমি মেয়েটিকে খুন করেছো?
—ছিঃ ছিঃ তা কেন বলবো। তুমি কি জানো ওই মেয়েটিকে আমি একদিন রক্ত দিয়ে
বাঁচিয়ে ছিলাম।
রক্ত দানের ঘটনাটি আয়েশা জানে। আসানসোলের উপকন্ঠে বস্তিতে ছোট-ছোট টালির
ঝুপড়িতে থাকতে হয় বিভিন্ন জেলা থেকে আসা রাজমিস্ত্রী,মজুররা।তাদের ফুর্তি দেওয়ার
জন্য কিছু মেয়েও ভিড় জমায় বস্তিতে। তাদেরই একজন সন্তান প্রসবের সময় মরণাপন্ন
হয়ে পড়ে।আরিফ তাকে রক্ত দিয়ে বাঁচায়। এখন মেয়েটি খুন হয়েছে। তথ্য-প্রমাণ সবই
নাকি আরিফকে চিহ্নিত করছে।
—তুমি না একটা ভাল মানুষ,একটা খারাপ মেয়েছেলেকে রক্ত দিয়ে বাঁচাতে গেলে কেন?
—মেয়েটি মা হতে গিয়ে মরছিল,মায়ের কোন জাত-ধর্ম-পেশা থাকে না,আমারও মনে
ছিল না।তার রক্ত কারো সাথে মেলে না,আমার মিলে ছিল।
—সেই সাথে মনের মিলও হয়ে গেল?
—আবার সেই বাঁকা কথা,তোমাকে কতবার বলেছি,মেয়েটা দুষী হলেও ভাল ছিল,আমাকে ‘ভাইজান’ ডাকত।
—সেদিনের নবজাতক আজ আট বছরের বালিকা,সে কিন্তু তোমার বিরুদ্ধে স্বাক্ষী দিয়েছে।
সে তো কই একবারও বলেনি তার মাকে তুমি বাঁচিয়েছো।
(পরের কথা আগামী পর্বে)