জটের ফাঁদে বটেশ্বর
ছায়াটা নড়ছে। চলছে। কখনও সামনে, কখনও পেছনে। দেখছেন বটেশ্বর। ঘাড়
ঘুরিয়ে মানুষটিকে দেখতে পাচ্ছেন না। ভূত নয়ত ?
ঘাড় মটকালে বিপদ। স্পন্ডেলাইটিস বড় ব্যথা দেয়। একে তো পায়ের ব্যথায়
কাহিল। খুঁড়িয়ে হাঁটছেন। ঘাড় মটকানি নিশ্চয় আরো যন্ত্রণার!
রাস্তা ছেড়ে এবার গলিপথ ধরলেন বটেশ্বর। তখনই যেন অন্ধকার কথা বলে উঠল,
‘আপনি কি চোর?’
থতমত খেয়ে এদিক-ওদিক দেখলেন বটেশ্বর। লোডশেডিং কবলিত পিচ রাস্তা।
বাড়ি-পাঁচিল আর লাইট-পোস্ট আর সাইনবোর্ড এমন জড়াজড়ি করে আছে,
বোঝা যায় না,কোনটা কি! কেউ নেই। মনের ভুল ভেবে আবার হাঁটতে শুরু
করলেন । ফের প্রশ্ন, ‘উত্তর দিলেন না যে?’
— ‘যাদের আমি দেখতে পাইনে,তাদের কথার জবাব দিই না। তা তুমি কে হে
বাপু,একবার সামনে এসে বদনখানা দেখাও।’
—‘না,আপনার সামনে যাব না,যদি আপনি পুলিশের লোক হন।’
—‘কেন, আমার চেহারা দেখে কি তোমার চোর মনে হচ্ছে?’
—‘শরীরখানা বাদ দিলে,আপনার চেহারা চালচলন,সবই যেন চোরের মত।’
—‘এই অন্ধকারে তুমি আমার চেহারা দেখতে পাচ্ছ?’
—‘হ্যাঁ,দেখছি,আপনার গোঁফের নিচের তিল অব্দি স্পষ্ট।’
—‘তুমি দেখছি সাংঘাতিক লোক,তা কি করা হয়,তুমিও কি চোর?’
—‘না বাবু,আমার এখন ট্রেনিং চলছে,ওস্তাদ বলে দিয়েছে,পুলিশ ছাড়া সবার
সামনে যাবি’।
—‘কেন,পুলিশকে ভয় কেন?’
বটেশ্বরের নস্যি নিতে ইচ্ছে হচ্ছে।নাকটা কেমন সুড়সুড় করছে। নস্যি নিলে
হাঁচি হানা দেবে,হ্যাঁ-চোর,হ্যাঁচ,কমপক্ষে সাত-আটটা। তাতে চারিদিকে শুনশান
ভাব দুধের ছানা কাটার মত কেটে যাবে। অভিযানের আনন্দ,আতঙ্ক সব মারা
যাবে অন্ধকার, শুনশান এই গলিপথে।
—‘পুলিশ নাকি ছাইয়ের দড়ি পাকায়।’
নাকি সুরে নয়,স্বাভাবিক স্বরে কথা বলল অন্ধকার।
—‘হুম,পুলিশের সে রমরমা আর নেই,এই তো আমি তখন থেকে তোমার
সঙ্গে কথা বলছি কিন্তু চোখে দেখছি অন্ধকার।’বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন বটেশ্বর।
—‘এবার আমি আপনাকে দেখা দেব,বুঝতে পারছি আপনি বেশ ভাল লোক।’
অন্ধকার ফুঁড়ে উঠে এল ছেলেটি। সারা গায়ে যেন কালিমাখা। বটেশ্বর
মনে মনে বললেন, ‘ব্রাইট বয়।’ প্রকাশ্যে বললেন, ‘কি করে নিজেকে আড়াল
করে রেখেছিলে বাপু?’
—‘আপনি রাস্তায়-রাস্তায় হাঁটছিলেন,আমি পাঁচিলে।’বলে খিকখিক করে হাসল
ছেলেটি।
—‘কিন্তু এই গলিতে তো কোন পাঁচিল নেই।’
—‘পাঁচিল নেই তো কি হয়েছে,বকুল গাছ তো আছে।’
একরাশ অন্ধকার কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছটি এবার দেখতে পেলেন
বটেশ্বর। লোডশেডিং হলে গাছগুলোও কি নিজেদের অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ?
—‘হুম,বকুল,বেশ মিষ্টি ফুলের গন্ধ,তা বাবাজীবন, তুমি আমাকে ফলো
করছিলে কেন?’
—‘আপনার হাঁটাচলা দেখে চোর মনে হয়েছিল,তাই পিছু নিয়েছিলাম।’
—‘আমাদের মানে পুলিশদের এখন চোরদের চেয়ে খারাপ অবস্থা,তাই চোরের
মতই লুকিয়ে বেড়াচ্ছি।’
—‘কেন স্যার,আপনাদের আবার অসুবিধে কোথায়?’
—‘কোথায় অসুবিধে নেই বলো,এই আমার বন্ধুর কথায় ধরো,সে বেচারা দুটো
গরু-ভর্তি ট্রাক পাকড়াও করল। ড্রাইভার দুজন কেঁদে-কঁকিয়ে বললো,কাগজপাতি
কিছু নাই। অথচ আদালতে গিয়ে আমার বন্ধু পড়ল চুরির দায়ে।’
—‘পুলিশ কি করে চুরির দায়ে পড়ে?’
—‘তোমরা তো জানো পুলিশ নাকি ছাইয়ের দড়ি পাকায়,আর উকিলরা যে
বাতাসের দড়ি পাকায় তা জানা গেল আদালতে। ট্রাক-দুটি নাকি
মহাবিপদপুরের হাট থেকে আসছিল ১২০টা গরু নিয়ে। উকিল কাগজপত্র
পেশ করলেন। তাঁর কাগজের সাথে আমার বন্ধুর সিজার-লিষ্ট মিলল না। নগদ
১৭টা গরু কম। জজসাহেব হুকুম দিলেন,বাকী ১৭টা গরু যেখান থেকে হোক
খুঁজে আনুন। কাজীর বিচার বলে কথা,থানার বড়বাবু এখন দলবল নিয়ে গরু-
খোঁজায় ব্যস্ত’।
বকুল গাছে বসে থাকা পাখি ডেকে উঠল,ক্যাঁ-য়া-চ,ক্যাঁ-য়া-চ! ঝিকিমিকি
করে উঠল জোনাকি। ফুলের গন্ধ ভরা বাতাস বয়ে গেল একরাশ।
—‘বেশ মজা,তা আপনার বিপদটা?’
—‘আমারটা তো আরো বিপদের,আমি চোরের লাশ খুঁজছি।’
—‘ চোরের আবার লাশ হয় নাকি, চোর সবসময় চোর,মরে গেলে ডেডবডি,
এটাই তো সোজা হিসেব স্যার।’
—‘হুম,এই জন্যেই বলে,গাধার সাথে তার লেজের তুলনা হয় না ,তোমার মত
এক চোরের সাগরেদের বুদ্ধিতে আমার পা খোঁড়া হয়েছে,তা জানো ?’
ছেলেটা মাথা চুলকে বলল,‘আমার ওস্তাদও তাই বলে,আমার নাকি গাধার লেজের
মত বুদ্ধি,চুরি-বিদ্যা আমার দ্বারা হবে না। সে যাক গে,আপনি স্যার গল্পটা বলুন।’
—‘গল্প নয়-রে বাপু,সে এক যল্প,যল্প মানে বোঝ তো? যল্প মানে হচ্ছে যন্ত্রণা দায়ক
গল্প,এককথায় যল্প। তোমার মতই এক সাগরেদকে ধরে লক-আপে পুরলাম। সে
বেচারা কেঁদেকেটে অস্থির। বলে কিনা,আমি স্যার বাপ-মা মরা ছেলে,এক চোর দয়া
করে কাজ শেখাচ্ছিল,তাকেও গুলি করে মেরে দিল চরিত-মহাজন।’
—‘চরিত মহাজন,নামটা যেন ওস্তাদের কাছে শুনেছি।’
—‘হ্যাঁ,সব চোরই তার নাম জানে,চোরদের নিয়েই তার কারবার,তাই তার সুচরিত
নামটা ‘চরিত’ হয়ে গেছে।’
—‘আমার ওস্তাদও বলে,চরিতের গদিতে যে একবার চুরি করতে পারবে,সারাজীবন
পায়ের উপর পা দিয়ে বসে খাবে।’
—‘হুম,সব চোরই এক ভুল করে,ওই ছোকরার ওস্তাদও করেছিল। বেচারা জানতো
না,চরিত রাত জেগে গদি পাহারা দেয়। হাতে থাকে ছোট বন্দুক। গুলি খেয়ে মরল
বেচারা। সাগরেদটা অনাথ হয়ে গেল।তার কান্নাকাটি শুনে আমি পড়লাম বিপদে।’
—‘আপনিও কি স্যার গুলি খেলেন?’
—‘খেলাম,তবে সেটা বুদ্ধির গুলি। চরিতের বাগানের বেলতলার নিচে চোরটার
লাশ পোঁতা আছে। পাক্কা খবর। দলবল নিয়ে গেলাম বেলতলায়। দেখি খুব সুন্দর
টেবিল ফুলের বাগান সেখানে। বললাম এই বাগান আমি খুঁড়ে দেখব।’
—‘চরিত মহাজন বাধা দিল না?’
—‘না,না,বাধা দিল না,বিনয়ী গলায় বলল,স্যার মিছিমিছি আমাকে সন্দ করছেন,
চোরের ডেডবডি কি গুপ্তধন নাকি যে বাগানের নিচে পুঁতে রাখব!’
—‘আপনি কি করলেন স্যার?’
—‘ কি আর করব,আমার দলবল কেউ সাহস করছে না দেখে নিজেই কোদাল
হাতে নিলাম।’
—‘তারপর?’
—‘ভুরভুরে মাটি খুঁড়ে বাগান তছনছ যখন শেষের দিকে তখনই ধ্বস ছাড়ল
মাটির,আমার পাতাল-প্রবেশ হয়ে গেল।’
—‘তারমানে স্যার,আপনি মরে গেলেন?’
—‘না-রে বাপু মরিনি,তবে হাসপাতালে শুনলাম,আমাকে ক্রেন দিয়ে তোলা
হয়েছিল।’
—‘চোরের ডেডবডির কোন সন্ধান পেলেন?’
—‘কি করে পাব,হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছি,আজ বিকেলে,শুনলাম চরিত
নাকি আমার উপরে বাগান-তছরুপ সহ পাঁচরকম কেস দিয়েছে।’
—‘তাহলে স্যার বাকী খবরটা আমার কাছে শুনে নিন,আপনার দূর্ঘটনার পরে
সেই চোরের কংকাল চরিত-মহাজন সরিয়ে ফেলেছে।’
—‘কোথায় বল তো?’
—‘সে আপনি খুঁজে পেলেও কিছু করতে পারবেন না,সেখানে একটা চোর-মন্দির
তৈরী হয়েছে। সব চোর সেখানে প্রণাম করে তবেই কাজে বের হয়।’
—‘তুমি এত কথা জানলে কি করে বাপু?’
—‘আমার ওস্তাদ যে সেই মন্দিরের পুরুত। আমাকে সেই-ই পাঠিয়েছে আপনাকে
ফলো করতে।’
পকেট থেকে পিস্তল বের করলেন বটেশ্বর। মোলায়েম স্বরে বললেন,‘কোথায় বাপু
তুমি,দেখতে পাচ্ছি না কেন?’
অন্ধকার থেকে আওয়াজ ভেসে এল, ‘আমি স্যার আপনার পিস্তল দেখতে পাচ্ছি,
তাই আমাকে আর দেখতে পাবেন না। টা-টা।’
আশেপাশে তাকিয়ে শুধু অন্ধকার দেখছেন বটেশ্বর। বকুল গাছে জোনাকির
ঝিকমিক। শব্দ শুনছেন,খিক-খিক!
পিস্তল পকেটে পুরে বিড়বিড় করলেন বটেশ্বর, ‘একেই বলে পুলিশের যন্ত্রণা!’
*