অগ্নিকান্ডের কারণ ও প্রতিরোধ
প্রতিদিন অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে তার সব খবর কি পত্রিকায় ছাপানো হয়? অনেক ছোট খাট অগ্নিকান্ডের ঘটনা গ্রামাঞ্চলে ঘটে যা সাংবাদিকদের কানে পৌঁছায় না। এভাবে অগ্নিকান্ডে পুড়ে আমাদের দেশের কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হচ্ছে। জানি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স একটি সেবা ও ত্যাগের প্রতিষ্ঠান। তারা যেখানেই অগ্নিকান্ড ঘটে সেখানেই দ্রুত সেবা দেয়ার জন্যে চলে যায়। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে এমনও জায়গা আছে যেখানে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ী যাওয়া সম্ভব হয় না। যার ফলে তারা সেখানে সেবা দিতে ব্যর্থ হয়। আবার অনেকে ফায়ার সার্ভিসের টেলিফোন নম্বর জানে না যার ফলে অগ্নিকান্ড ঘটার সাথে সাথে ফায়ার সার্ভিসকে সংবাদ দিতে পারে না। শুধু অগ্নিকান্ড নয় যে কোন দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা ও রোগী পরিবহনের জন্য ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সাহায্য করে থাকে। যা হয়তো অনেকে জানে না।
অসাবধানতাই অগ্নিকান্ডের প্রধান কারণ। অতএব অগ্নি প্রতিরোধে আমাদেরকে সচেতন হতে হবে। এবার দেখা যাক কি কি কারণে অগ্নিকান্ড ঘটে।
শহরে অগ্নিকান্ডের মূল কারণ: (১) বৈদ্যুতিক গোলযোগ, (২) চুলার আগুন, (৩) সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা, (৪) রাসায়নিক দ্রব্যের সংমিশ্রণ, (৫) মশার কয়েল ইত্যাদি।
গ্রামাঞ্চলে অগ্নিকান্ডের মূল কারণ: গ্রামাঞ্চলে শহরাঞ্চলের উপরোক্ত কারণগুলো ছাড়াও আরো অনেক কারণ আছে। সেগুলো হলো- (১) ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা মোমবাতি, কুপি ও হারিকেন জ্বালানো অবস্থায় পাঠকাঠি দিয়ে আগুণ ধরিয়ে খেলা করা, (২) ভেজা কাপড় লাকড়ীর চুলার উপর শুকাতে দেয়া (৩) একে অপরের প্রতি শত্র“তা বশত খড়কুটা পাড়ার মধ্যে আগুণ ধরিয়ে দেয়া ইত্যাদি।
উপরোক্ত কারণগুলোর ফলে শহরে ও গ্রামাঞ্চলে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়। তাই আমাদেরকে অগ্নিকান্ড ঘটার পূর্বে অগ্নিকান্ড যাতে না ঘটে সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। অগ্নি প্রতিরোধে নিম্নোক্ত কাজগুলো করুন।
(১) বৈদ্যুতিক তার ত্র“টিমুক্ত কি না মাঝে মাঝে পরীক্ষা করুন। (২) খোলা বাতির ব্যবহার বন্ধ রাখুন। (৩) ইস্ত্রিতে বৈদ্যুতিক সংযোগ রেখে কখনো সরে যাবেন না। (৪) রান্না করার পর চুলা নিভিয়ে রাখুন। (৫) অকারণে একটা ম্যাচের কাঠি বাঁচানোর জন্য গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে রাখবেন না। (৬) বাড়ি-ঘর, কল-কারখানা, অফিস ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নি নির্বাপনী যন্ত্র স্থাপন করুন। (৭) ধূমপান করার পর সিগারেটের অবশিষ্ট অংশ নিভিয়ে নিরাপদ স্থানে ফেলুন। (৮) ছোট ছেলে-মেয়েদেরকে আগুনের কাছ থেকে দূরে রাখুন। (৯) প্রতিটি শিল্প কারখানায় ফায়ার সার্ভিস অধ্যাদেশের বিধান মতে ওয়ার হাউজ, ওয়ার্কশপ লাইসেন্স নিশ্চিত করুন। (১০) বিয়ারিং ও অন্যান্য চলমান যন্ত্রাংশ নিয়মিত লুব্রিকেন্ট দিন। (১১) অনভিজ্ঞ লোক দিয়ে রাসায়নিক ও দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। (১২) রান্না ঘরের মুলি ও বাঁশের বেড়ার উপর মাটির প্রলেপ দিন। (১৩) মিল কারখানায় ধূমপান বর্জন করুন। (১৪) একান্ত বাধ্য না হলে গ্যাসের চুলায় জামা কাপড় শুকাবেন না। (১৫) শিল্পকারখানা ও বাড়ি-ঘরের সামনে সব সময় পর্যাপ্ত পানি রাখুন। (১৬) স্থানীয় ফায়ার সার্ভিস ষ্টেশন থেকে অগ্নি নির্বাপনী ও প্রতিরোধ সর্ম্পকে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করুন। (১৭) অগ্নি নির্বাপণের লক্ষ্যে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তুলুন। (১৮) নিকটস্থ ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের টেলিফোন নম্বর নিজ দায়িত্বে সংগ্রহ করুন। (১৯) অগ্নিকান্ড ঘটার সাথে সাথে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিন। (২০) মশারীর নিকট মোম বাতি বা কুপি রাখবেন না। (২১) কয়েল বিছানা থেকে দূরে রাখুন।
মনে রাখবেন আগুন আমাদের বন্ধু। কারণ আগুন আবিষ্কারের ফলে খাদ্য দ্রব্য রান্না করে খেতে পারছি। তা না হলে আদিম সমাজের মত আমাদেরকে কাঁচা খেতে হত। বিদ্যুৎ ও এক প্রকার আগুন। বিদ্যুৎ আবিষ্কারের ফলে আজ আমরা আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়েছি। আধুনিক সভ্য ও উন্নত জীবনে সর্বক্ষেত্রে বিদ্যুতের প্রয়োজনীয়তা আমরা অনুভব করে থাকি। শহরের চেয়ে আমাদের দৈনন্দিন গ্রামীণ জীবনে বিদ্যুতের ব্যবহার কম হলেও বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানো, ধান ভাঙানোর মেশিন চালানো, পানি সেচের মেশিন চালানো, টিভি, টেপ রেকর্ডার বাজানো, বৈদ্যুতিক হিটার, ইস্ত্রী চালানো, কম্পিউটার চালানো ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিদ্যুতের ব্যবহার অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন কলকারখানা চালানো, গাড়ী চালানো ও চিকিৎসা ক্ষেত্রেও বিদ্যুতের উপর নির্ভরশীল। এই বিদ্যুৎ বা আগুন আমাদেরকে যেভাবে বন্ধুর মতো সেবা দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু এই বন্ধুই একদিন হয়তো আপনার শত্রু হয়ে যেতে পারে যা অস্বাভাবিকের কিছু নয়। তাই এই প্রয়োজনীয় বন্ধুকে সব সময় বন্ধুর মত আগলে রাখতে হবে। এই বন্ধু যাতে শত্র“ না হয় সেদিকে সকলকে নজর রাখতে হবে।
এখন কথা হচ্ছে এত সচেতনতার পরেও যদি দৈবাত আপনার বাড়ি, মিল-কারখানায় বা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে আগুন লেগে যায় তাহলে কি করবেন। অযথা দৌঁড়াদৌঁড়ি, হৈ হুল্লোর, চেচামেচি, কান্নাকাটি না করে, বিচলিত বা আতংকগ্রস্থ না হয়ে প্রথমে আগুন লাগার সাথে সাথে নিকটস্থ ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিন। তারপর আগুন কোথায় লাগল, কেন লাগল তা সনাক্ত করুন। প্রাথমিক অবস্থায় সাধ্যানুযায়ী নিজেরা যতটুকু পারেন তা দিয়ে আগুন নেবানোর চেষ্টা করুন। আশে পাশের সবাইকে ডাকুন। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আসার পূর্ব পর্যন্ত আগুন মোকাবেলা করুন। অনেক সময় অগ্নিকান্ডস্থল থেকে ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের দূরত্ব, যানজট ও অপ্রশস্ত রাস্তা ইত্যাদি কারণে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ী অগ্নিকান্ডস্থলে পৌঁছাতে দেড়ি হতে পারে তাই ততক্ষণ হাত পা গুটিয়ে বসে চেঁচামেচি না করে আগুন নিভানোর কাজে লেগে যান। আগুনের সূচনাতেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গের উপর পানি নিক্ষেপ করুন। তেল জাতীয় আগুনে কাঁথা, ছালা বা মোটা কাপড় ভিজিয়ে চাপা দিন। যদি বৈদ্যুতিক আগুন লেগে থাকে তাহলে দ্রুত মেইন সুইচ বন্ধ করুন। আশে পাশে যেখানে আগুন লাগার সম্ভবনা আছে সেখান থেকে প্রয়োজনীয় বস্তু সরিয়ে ফেলুন।
এতক্ষণ আমরা অগ্নিকান্ড ঘটার কারণ, অগ্নি প্রতিরোধে করণীয় ও অগ্নিকান্ড ঘটার পর আমাদের কি করণীয় সর্ম্পকে জানলাম। পরিশেষে জানব অগ্নিকান্ডের ফলে আপনি আগুণে পুড়ে গেলে কি করবেন। অথবা অপর কোন ভাই-বোন আগুনে পুড়ে গেলে কি করা উচিত। প্রথমে আক্রান্ত ব্যক্তিকে এমনভাবে শুয়ে দিবেন যাতে তার পুড়ে যাওয়া অংশ খোলা থাকে এবং তার শরীরে যাতে পর্যাপ্ত আলো বাতাস লাগে। তারপর ঠান্ডা পানি বা বরফ এনে পোড়া জায়গায় ঢালবেন যতক্ষণ জ্বালা যন্ত্রণা না কমে। আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর থেকে লজ্জাস্থান ঢেকে সমস্ত কাপড় খুলে ফেলবেন। পুড়ে যাওয়া অংশে যদি কাপড় লেগে যায় তাহলে টানাটানি না করে কেটে ফেলুন। তারপর জীবানুমুক্ত কাপড় দিয়ে ক্ষতস্থান হালকা করে বেঁধে দিন। মুখ যদি পুড়ে যায় তাহলে এমনভাবে মাস্ক তৈরি করতে হবে যাতে নাক, মুখ ও চোখ খোলা থাকে। তারপর যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়া যাবেন।
পরিশেষে বলব, আমরা সবাই যদি অগ্নি প্রতিরোধে সচেতন হই তাহলে এই ভয়াবহ অগ্নিকান্ড থেকে আমাদের জানমালকে নিরাপদে রাখতে পারবো।