ফার্ষ্টবয়
পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। আমরা প্রশ্নপত্র পেয়ে খাতায় লিখতে শুরু করেছি মাত্র। এরই মধ্যে কয়েকজন স্যার অস্থিরভাবে জনে জনে গলা খাটো করে বলতে লাগলেন, “কি রে, পরীক্ষা যে শুরু হয়ে গেল, মনির তো এখনও আসেনি। তার কি কোনো সমস্যা-টমস্যা হলো নাকি! তোরা কিছু বলতে পারবি?“ আমরা আশ্চর্য হয়ে জবাব দিলাম, “না, আমরা তো কিছুই জানি না স্যার।“ খুব বিমর্ষ মনে ছোটাছুটি করতে লাগলেন স্যারেরা।
আমাদের ৫ম শ্রেণীর ফার্ষ্টবয় মনির। সে আজ অনুপস্থিত। তার অনুপস্থিতির কারণ জানি না কেউ।
আমাদের ৩ টি সেকশনে ১৬৫ জন ছাত্র। আমার রুল নম্বর ২। যতই পড়ি না কেন, মনিরের সাথে পড়ালেখায় কোনোভাবেই কুলিয়ে উঠতে পারি না। মনে মনে খুব হিংসা করি তাকে। সে স্কুলে না এলে, অসুস্থ হলে কিংবা কদাচিত পড়া একটু কম পারলে মনে মনে খুব খুশি হই। কিন্তু আজ সে পরীক্ষা দিতে না আসায় যতটা আনন্দিত হওয়ার কথা ততটা আনন্দ লাগছে না; তার জন্য কেন জানি খুব মায়া লাগছে আমার।
আজকের পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর বাসায় যেতে আন মন চাইল না। আমাদের ক্লাশের রনি ও শুভকে নিয়ে আমি মনিরের খবর জানতে বের হয়ে গেলাম। কিন্তু তার বাসা কোথায় তা আমরা জানি না। ষষ্ঠ শ্রেণীর একজন ছাত্র আমাদের চিনিয়ে নিয়ে গেল। আধ ঘন্টার মত হাঁটার পর ছেলেটি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমাদের বলল, ‘ওই যে বস্তিটা দেখছ না, মনির ওইখান থেকেই আসে।
বস্তিটা পানিতে ভাসছে। ছোট ছোট খুপড়ি ঘর। মাঝে মধ্যে দু‘এক জনের খল খল করে হাঁটা-চলার ও শিশুর কান্নার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। আমরা নেমে গেলাম পানিতে। আস্তে করে হাঁটছি। মনে হলো, ঢেউয়েরা দাঁড়িয়ে থাকা বস্তির নড়বড়ে ঘরগুলোকে ঠেলে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করছে।
মনিরের কথা বলতেই বস্তির একজনকে হাত ইশারায় একটা নড়বড়ে ছোট ঘর দেখিয়ে দিল। ঘরে হাঁটু পরিমাণ পানি। চুপি দিয়ে দেখি, খুঁটির উপর জোড়াতালি দেওয়া কয়েকটা কাঠের ওপর জবুথবু হয়ে বসে আছে মনির। “মনির তুই যে আজ পরীক্ষা দিতে যাসনি! সবাই চিন্তা করছি। কী হয়েছে তোর?“ বলতেই সে চমকে উঠল। সে কিছু বলার আগেই বুঝতে পারলাম, সে খুব অসুস্থ। কপালে হাত দিয়ে অনুভব করলাম তার প্রচন্ড জ্বর। সে কাঁপছে। ঠোঁট-মুখ শুকিয়ে গেছে। তার সামনে একটা টিনের বাসনে চাল ভাজা ও পাউরুটির কিছু অংশ পড়ে আছে। এতে মাছিরা ভনভন করছে। তার বাবা নেই। তার মা ও বোন অন্যের বাড়িতে ঝি এর কাজ করতে গেছে। ঘরে সে একা। মনির লজ্জায় আরো ছোট হয়ে ক্ষীণ স্বরে বল্ল, “ভাই আমি তোদের বসতেও বলতে পারছি না। তোরা কেন খালি খালি কষ্ট করছিস? পরীক্ষা কেমন হলো রে“ বলেই সে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল সে।
বৃষ্টি ও বন্যার জলে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে তার। ঘরের কোণায় দেখলাম তার খাতা, বই ভাসছে। তার ইউনিফর্ম নাকি পানিতে ভেসে গেছে। তার ওপর প্রচন্ড জ্বর। এসব দেখে আমাদের চোখও ভিজে গেল। আমরা অনুমানও করিনি আমাদের কাশের ফার্ষ্টবয় মনির যে এত গরিব।
আমরা তার দুরবস্থা দেখে অবাক হয়ে গেলাম। সে লজ্জায় বারবার বলছে, “কোনো চিন্তা করিস না ভাই। আমি এমনিতেই ভাল হয়ে যাব। পরীক্ষার জন্য ভীষণ কষ্ট হচেছ!“ আমরা আর কোনো কথা বাড়ালাম না। দ্রুত বের হয়ে মেইন রোডে এসে তিন জন পরামর্শ করলাম, কী করা যায় তার জন্য। চট করে বুদ্ধি পেয়ে গেলাম। আমরা তিন জন একত্রে তিন জনের বাসায় গিয়ে বাবা মাকে বিষয়টা খুলে বল্লাম। তাঁরা আমাদের অস্থিরতা দেখে খুব খুশি হলেন। তিনজনের আব্বুর কাছে ৫০০/- টাকা করে চাইলাম। তাঁরা সাথে সাথে দিয়ে দিলেন। আমরা ১,৫০০/- টাকা নিয়ে মনিরের বাসায় রওনা হয়ে গেলাম। যাওয়ার পথে একটা চকি, স্যালাইন, ফিটকিরি, ডাক্তারের পরামর্শে কিছু ঔষধ ও পথ্য নিয়ে হুড়মুড়িয়ে গিয়ে হাজির হলাম তার ঘরে। আমাদের হাতে ওসব দেখে তার মা, বোন ও মনিরের চোখ তো ছানাবড়া। আশপাশের কেউ কেউ এসে আমাদের অনেক প্রশংসা করতে লাগলেন। আমরা চকি পেতে বসলাম। মনির এবং তার মা ও বোনের চোখ আনন্দ-কৃতজ্ঞতায় অশ্রুসজল হয়ে উঠল। আমরা মনিরকে অবশিষ্ট টাকা ও অভয় দিয়ে চলে এলাম।
স্কুলে এসে স্যারদের কাছে সব খুলে বললাম। আমাদের উদ্যোগের কথা শুনে স্যারেরা অনেক খুশি হলেন। স্যারেরা আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘ভালো কাজ কখনও হারিয়ে যায় না রে। তোমাদের এই ছোট্ট একটা ভাল কাজের দৃষ্টান্ত ভবিষ্যতের বৃহৎ কাজের অণুপ্রেরণা হয়ে রইল।‘ স্যারের এসব কথায় আমরা ভাল কিছু করার আনন্দ নিয়ে বাসায় ফিরলাম।
পরীক্ষা শেষ হওয়ার তিন দিন পরে মনির দুর্বল শরীর নিয়ে স্কুলে এলো। তার বিষয়টি নিয়ে স্যারেরা জরুরি মিটিং করলেন। পরে বিশেষ ব্যবস্থায় মনিরের পরীক্ষা নেয়া হলো।
পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন সবার চু ছানাবড়া। এবারও ফার্ষ্ট হয়েছে মনির!